ইতিহাস সৃষ্টির আদিপর্বে গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর জীবনে প্রাগৈতিহাসিক ছবির সূত্রপাত হয়েছিল। তখন এই শিল্পে ছিল সৃষ্টি প্রেরণা। প্রাকৃতিক উপকরণের সাহায্য নিয়ে মাটির বুকে ও পাহাড়ের গুহায় নানা ধরনের শিল্প সৃষ্টি করেছিল সে যুগের শিল্পীর দল। সে শিল্পের যুগে কোনো জটিলতা ছিল না। সহজ স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীর ভাষা বা কথা বলার ভঙ্গিমা সবকিছুর মধ্যে ছিল আদিমতা ও বিচ্ছিন্নতা। এই শিল্পকে অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে মানব জীবনে যে শিল্পের বাসনা সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল ঘরোয়া শিল্প। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে তার অনেকটাই সাদৃশ্য লক্ষণীয়। তখনকার শিল্পীদল গ্রাম্য জীবনের সহায়তায় প্রতিমা গড়ত, ছবি আঁকাত। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই শিল্পীগণ শহরে এসে সভ্যতার তালে তাল মিলিয়ে ছবি এঁকে চলল। এ ছবি তাই আসল পটুয়া ছবির গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিকতার আঙিনায় এসে স্থান লাভ করল।

প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে কোনো সংহত জগৎ কিংবা পরাণের ভিত্তি ছিল না। কিন্তু পরবর্তীকালে ছবি হয়ে উঠল পুরাণ নির্ভর। তাই প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়—“অন্যান্য দেশের প্রাগৈতিহাসিক চিত্র কোনো নাচের ছন্দ এঁকেছে। কোনো মানুষ এঁকেছে, কোনও হরিণ এঁকেছে। কিন্তু খাপছাড়া ভাবে।” নগর সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ছবির মধ্যে সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি হলেও আদিমতার লক্ষণ অতি সহজে শেষ করা সম্ভব নয়। আধুনিক শিল্পীর দল তাই প্রাগৈতিহাসিকতার পায়ে পা মিলিয়ে কৃত্রিমতাকে পাথেয় করে নতুন শিল্প সৃষ্টি করে গেল। মূল পটুয়া ছবির মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক ছবির সাদৃশ্য থাকলেও সংহত ও পুরাণের বিশ্বাস ছিল তা ঘরলোকের জগৎ ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে অন্য অন্ধকার সীমানায়। রসবোধই কোনো শিল্পের মূল ভাব। পটুয়া শিল্পে সেই ভাব একটা মূলক সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। শিল্পের মূল সত্যের সন্ধান শিল্পীরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আবিষ্কৃত করেছিল।

সভ্যতার অগ্রগামিতার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ জীবনে চাকচিক্য ও নানা উজ্জ্বলতা এসেছিল। এমনই সময়ে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের প্রাণসত্তা হারিয়ে গেল। শিল্পীর দল শৌখিনতার জগতে নেমে পড়ল পালিশ করার কাজে। শিল্পের প্রকৃত ভাবসত্যকে তারা ভুলে যেতে লাগল। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছবিতে এমন শৌখিনতা ছিল না, ছিল না কোনো সৌন্দর্যবোধ। আবার আধুনিকতার আলোকে পৌঁছে শিল্প ভাষার মধ্যে এল পরিবর্তন। আটপৌরে ভাষার পরিবর্তে এল পোশাকি ভাষা। পটুয়া শিল্পে পটুয়ারা শিখেছিল আশ্চর্যরকম ঘরোয়া বক্তব্য তার মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ ছিল না, বিলাসের চিহ্নও ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে সাধুভাষার শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার গাম্ভীর্য ও বিলাসিতা প্রাধান্য লক্ষণীয়। কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব না রেখে প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে লেখক শিল্পের আসল সত্যকে প্রকাশ করেন সামান্য ছবির রূপ এঁকে দেন। কিন্তু তার মূল্য শেষ পর্যন্ত অনেক কমে যায়। তাই লেখকের স্পষ্ট বক্তব্য—“পৃথিবীর প্রায় বাকি সব জায়গাতেই প্রাগৈতিহাসিক ছবি লুপ্ত হয়ে গেছে, পটুয়া ছবি সম্পূর্ণ মরেনি।” এইভাবে সমস্ত দেশের চিত্রশিল্পীর দল তাদের শৌখিন চিত্রকলার মধ্য দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের ভগ্নপ্রায় অবস্থার কথা বিশ্লেষণ করেছেন।

পুরাণ নির্ভর পটুয়া শিল্পের পৌরাণিক বিশ্বাস ইউরোপীয় শিল্পসাধনার বিশেষ অঙ্গ বলে বিবেচিত। ইউরোপীয় সাহিত্যে সংস্কৃত শিল্প বহুদিন খ্রিস্টের পুরাণে বিশ্বাস অটুট রাখতে পেরেছিল। জিশুখ্রিষ্ট জীবনের প্রকৃত স্বরূপকে উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে শিল্প সাধনা প্রাণলাভ করেছিল। পুরাণ বিষয়কে অনুকরণ করে শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল ততদিন কোনো অশান্তি জোটেনি। রেমব্রান্টের পর সামাজিক অবস্থার প্রভাবে ইউরোপীয় শিল্পীরা পুরাণে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। শিল্প পুরাণ নির্ভরতা ছেড়ে এল অশান্তি। পৌরাণিক ঘটনাকে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শিল্প সৃষ্টির সৌন্দর্যতা বোধ নিয়ে এলেন ইউরোপীয় শিল্পীরা। ইউরোপীয় শিল্পীর জগৎ থেকে ধীরে ধীরে পুরাণ নির্ভরতা দূরে সরে যেতে থাকল। শিল্প সাধনার মধ্যে এল বিলাসিতা। পটুয়া শিল্পের মতো ইউরোপীয় শিল্পের সহজ সরলতা দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পের প্রসারকে আরও প্রসারিত করেছিল। ইউরোপীয় কতকগুলি বিশিষ্ট শিল্পী গ্রামীণ সরলতা ও খ্রিস্টের পুরাণকে আঁকড়ে ধরে রাখবার চেষ্টা করল। কিন্তু তা সম্ভব হল না।

পশ্চিম ইউরোপীয় শিল্প প্রকাশে কোনো জীবন নির্ভর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিল্প সৃষ্টির মহিমা প্রকটিত হয়েছে। সংস্কৃত ভাবধারা আধুনিক সভ্যতার আঙিনায় দাঁড়িয়ে পুরাণ নির্ভরতা দিয়ে শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। ইউরোপীয় শিল্প বিকাশে মূল পটুয়া ছবির অবদান লক্ষণীয়, শিল্প বিকাশের সীমানায় দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় শিল্প আধুনিকতার আলোকে পৌঁছে শিল্পের আঙ্গিক ও প্রসঙ্গে এল পট পরিবর্তন। লেখকের ভাষায়— “যদিও উত্তরকালে এ বিশ্বাস নেহাৎ অভ্যাসে পরিণত হবার পর শিল্পীর দল যখন গতানুগতিক পট এঁকে চলল, তখন এ ভিত্তি তারা বিস্মৃত হয়েছে অভ্যাসের অন্ধকারে।” ইউরোপীয় শিল্পগোষ্ঠী আদিমতার শিল্প প্রসারে এই ভাবে তাদের শিল্প চিন্তাকে চিত্রায়িত করে। চলিত চিত্রকলার জগতে পটুয়া শিল্পের পাশাপাশি ইউরোপীয় শিল্প চলতে থাকলেও আধুকিতার শীর্ষে পদার্পণ করেছিল। এই ভাবে লেখক যামিনী রায় অধুনা পূর্ব ইউরোপীয় ইতিহাসকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রকাশিত করেছেন।

প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের মতো ইউরোপীয় শিল্পে ছিলনা পুরাণের স্থিতি এবং তারা জানতো না পোশাকি ছবির ভাষা। এই শিল্পের সত্যকে পরিষ্কার করলেও তারা ধরে রাখতে পারলো না। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করার মন্ত্র নিয়ে শিল্পীর দল এগিয়ে গেল কিন্তু সেই স্রোতের পথে হঠাৎ ভাটার প্রভাব দেখা দিল। আধুনিক নাগরিকতার চমৎকারিত্বের প্রবল আকর্ষণে যে শিল্প ভেঙে গেল, প্রখর আলোয় চোখে লাগল ধাঁধা। শিল্পীর দল কোমর বেঁধে লেগে পড়ল পালিশ করার কাজে। লেখকের ভাষায় আমাদের দেশের কথা বলতে গিয়ে বলা যায়—“বিভূতির আকর্ষণে যোগভ্রষ্ট হওয়া অনেকটা সেই রকম। ছবি নিখুঁত হল, ছবির পালিশ এল।” এত নিখুঁত সংস্কৃত কল্পনা করা কষ্টকর। এরপর শিল্প সাধনার ইতিহাসে ইউরোপীয় শিল্পীদের আজ হঠাৎ চেতনা জেগেছে এবং নেশা ভেঙেছে। ইউরোপীয় শিল্পধারায় ধীরে ধীরে পথ দুর্গম হতে থাকল, রুদ্ধ হয়ে গেল সামাজিকতার দর্পণ, লেখকের সিদ্ধান্তে—“অনেকটা দাবা খেলার মতো।”

দাবা খেলার মধ্যে দুটি শ্রেণি মানুষের বিরোধ আর বঞ্চনা প্রকটিত। ঠিক তেমন ইউরোপীয় সংস্কৃত শিল্প এবং অগ্রসরমান চিত্রকলার মধ্যে এমন একটা মতানৈক্য বিভেদ সৃষ্টি হল। ইউরোপীয় শিল্প কোন পথে চলবে ভাষার ভঙ্গিমা কোন গতানুগতিতে প্রসারিত হবে তা জানার অবকাশ না দিয়ে পথ হয়ে গেল রুদ্ধ। খ্রিস্টের পুরাণে তাদের বিশ্বাস শেষ হয়ে গেছে এবং আর গতানুগতিক পুরাণ খুঁজে পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে পড়ল ইউরোপীয় শিল্পীমহল। খেলার যে ছক দিয়ে তারা এগিয়েছিল সে ছক ভেঙে শেষ হয়ে গেল। দাবা খেলার যে চাল তারা চেলেছিল তা ফিরিয়ে নিয়ে দূরে সরে যেতে লাগল। এরপর ইউরোপীয় শিল্পে ভাঙনের রূপ প্রত্যক্ষ করার মতো। যামিনী রায় ইউরোপীয় শিল্প চেতনার বিকাশে এক পরিবর্তন এনে সমস্ত শিল্প ধারার রূপ বদলে দিতে থাকল। তাই প্রসঙ্গক্রমে লেখকের কথা অনুসরণ করা যায়—“ওরা যদি গোড়া বেঁধে খেলতে শিখত তাহলে এ অবস্থা নিশ্চয়ই এমন হত না।”