প্রশ্নঃ আন্তজাতিক আইন কাকে বলে? আর্ন্তজাতিক আইনের উৎসগুলি কি কি?

অথবা, আর্ন্তজাতিক আইন কাকে বলে? আর্ন্তজাতিক আইনের উৎসসমূহ আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেকটি রাষ্ট্র একে অপরের ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল; কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহযােগিতা ও তাদের পারস্পরিক বন্ধন, পারস্পরিক ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে আন্তর্জাতিক আইনের।

আন্তর্জাতিক আইন কিঃ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র যেসব বিধি-বিধান ও নিয়মকানুনের মধ্যে নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখে তাই আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইন মূলত যেসব বিধি-বিধানের সমন্বয়ে গঠিত, সেগুলােকে জাতিসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বলে বিবেচনা করা হয়।

আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তা নিম্নে আলােচনা করা হলােঃ

Oppenheim তার International Law নামক গ্রন্থে বলেন, যেসব চিরাচরিত সামাজিক বিধি-বিধানসমূহ সভ্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বৈধভাবে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করে সেগুলােকে আন্তর্জাতিক আইন বলে বিবেচনা করা হয়।

Fenwick-এর মতে, আন্তর্জাতিক আইন হলাে সেসব সাধারণ নীতি এবং নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি যা আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্যগণ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে মেনে চলে।

সুতরাং বলা যায়, যে সব বিধি-বিধান রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, রক্ষা, আন্তর্জাতিক বিরােধ নিষ্পত্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করে তাই আন্তর্জাতিক আইন।

আন্তর্জাতিক আইনের উৎসঃ আন্তর্জাতিক আইন কোন আইনসভা কর্তৃক পাসকৃত বিধিবদ্ধ কোন আইন নয়। একে প্রথা আইন হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। নিম্নে আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলি আলােচনা করা হলােঃ

(১) চুক্তিঃ অনেক সময় চুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন নিয়মাবলি উদ্ভাবন করে দ্বন্দ্বরত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে যেসব চুক্তির শর্তাবলি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বহুপক্ষীয় চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসাবে কাজ করে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের একটি অন্যতম উৎস।

(২) চিরাচরিত প্রথাঃ পৌর আইনের উৎস হিসেবে চিরাচরিত প্রথা যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, এক্ষেত্রেও তার ভূমিকা তেমনি উল্লেখযােগ্য। বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের পারস্পরিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে কতকগুলাে প্রথা বা আচার মেনে চলে। কোনাে রাষ্ট্র যদি কোনাে ব্যাপারে বিশেষ আদর্শ স্থাপন করে তাহলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ তা অনুসরণ করে প্রথার সৃষ্টি করে।

(৩) রাষ্ট্র প্রধানগণের ঘােষণাঃ বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যে সময়ােপযােগী ঘােষণা প্রদান করেন তা পরবর্তিতে আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। সুতরাং রাষ্ট্রপ্রধানদের গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণাগুলাে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়।

(৪) সম্মতিঃ সম্মতিই এ আইনের প্রাণস্বরূপ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি অতিক্রম করে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে যখন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়, তখন স্বেচ্ছায় শর্তাবলি পালন করে অন্য রাষ্ট্রের জন্য আদর্শ স্থাপনের দ্বারা ভবিষ্যতের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন নিয়মাবলির সৃষ্টি করে। তাছাড়া সম্মতির উপর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক আইন আইনের মর্যাদা পেতে চলেছে।

(৫) আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তঃ আন্তর্জাতিক বিরােধ মীমাংসার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত যে সিদ্ধান্ত ও রায় প্রদান করে তা আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে পরিগণিত হয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক বিরােধ ও প্রশ্ন বিবেচনা করে এমন সালিশী ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কমিশন বা আদালতের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম উৎস।

(৬) জাতিসংঘের উদ্যোগঃ বর্তমানে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইনের এক বিরাট উৎস হিসাবে কাজ করছে। বিরােধ মীমাংসায় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে জাতিসংঘের উদ্যোগ আয়ােজনকে আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে স্বীকার করা হয়।

(৭) বিশেষজ্ঞদের রচনাঃ আইন বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন রচনা ও গবেষণা প্রবন্ধ আইন সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইনের আর একটি অন্যতম উৎস হলাে আইন বিশেষজ্ঞদের রচনাবলি। অধ্যাপক হল লরেন্স, ওপেনহেইম প্রমুখ আধুনিক বিশেষজ্ঞের রচনাবলির মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের অনেক উৎস খুঁজে পাওয়া যায়।

(৮) প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতিঃ রাষ্ট্রীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনের একটি উৎস হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কিছু রীতিনীতি। বিশ্বের সব রাষ্ট্রই পারস্পরিক সম্পর্ক ও কাজকর্মের ব্যাপারে কতগুলাে নিয়ম ও রীতিনীতি মেনে চলে। এগুলাে পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়।

(৯) আন্তর্জাতিক সম্মেলনঃ বিভিন্ন সময় পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন সমস্যা ও প্রয়ােজনে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন করে। এ সম্মেলনের সম্মিলিত ঘােষণা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়।

(১০) যুক্তিঃ যুক্তি বা বিচার-বিবেচনাও আন্তর্জাতিক আইন গঠনে প্রভূত সাহায্য করে। সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক আইনের বিধানকে মূলধন করে রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয় করত। প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিও বিচার-বিবেচনা বা বিবেকপ্রসূত সহানুভূতি। বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহকে ভিত্তি করে এবং বিচার-বিবেচনার ফলে নতুন নতুন নিয়মাবলি রচনা করে রাষ্ট্রসমূহ তাদের আন্তর্জাতিক কর্মপথে নিয়ম ও শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতের বিধান-এর ৩৮নং ধারার আন্তর্জাতিক আইনের নিম্নোক্ত উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- (i) বিবদমান রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত এবং সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট নিয়মাবলি, (ii) আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ যা আইনের মত বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত, (iii) সভ্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মসমূহ, (iv) বিশিষ্ট আইনবিদদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা এবং (v) আদালতের সিদ্ধান্ত।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন সত্যিকার অর্থে আইন কিনা তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত রয়েছে। তবে বর্তমান বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়ােজনীয়তা উত্তরােত্তর বদ্ধি পাচ্ছে। তাই বর্তমানকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আন্তর্জাতিক আইনকে পরিপূর্ণ আইনের মর্যাদা দিতে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক আইনের একটি বড় অনুমােদন হলাে জাতিসংঘ ও বিশ্বজনমত।