প্রশ্নঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিকাশে আরাকান রাজসভার অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম শাসকদের অবদান আলোচনা কর।

অথবা, আরাকান রাজসভায় রচিত বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা, আরাকান রাজসভার সহায়তায় বাংলা কাব্যের যে সমৃদ্ধি ঘটে, তার পরিচয় দাও।

অথবা, আরাকান রাজসভায় যারা সাহিত্য চর্চা করেছিলেন তাদের সম্পর্কে ক্ষুদ্র নিবন্ধ লেখ।

অথবা, আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য চর্চার সাধারণ কারণ ব্যাখ্যা করে সেই সভার কবিদের সাহিত্য কীর্তির পরিচয় দাও।

অথবা, “মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি সাধিত হয়েছিল।”— আলোচনা কর।

অথবা, রোসাঙ্গে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ বর্ণনা কর এবং রোসাঙ্গের কবিদের রচিত কাব্যগুলোর নামোল্লেখ কর।

অথবা, রোসাঙ্গ রাজসভায় রচিত বাংলা কাব্যধারার মৌল বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর। 

উত্তরঃ শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য যখন একান্তভাবে দেবদেবীর লীলাভূমি হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই সময় বাংলার সুদূর সীমান্তে আরাকানের মুসলিম কবিদের কাব্যসাধনার আসরে শোনা গিয়েছিল আর এক নব সুরের আলাপন, ফুটে উঠেছিল দেবদেবীহীন বলিষ্ঠ লৌকিক প্রেমকাহিনী। এ চিত্র একান্তভাবেই মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠ মানবজীবনের প্রতীক। এখানে দেবদেবীর বিলাস লীলার কোন স্থান ছিল না। এভাবে মুসলিম কবিদের কাব্যসাধনার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। বৈষ্ণবকাব্য, মঙ্গলকাব্য কিংবা জীবনচরিত সাহিত্যের দেবতা বা দৈবতম নরের ‘চরিত্রাঙ্কনে নয়, মাটির মানুষের কথা— প্রাণের ব্যথা নিয়েই এসব কাব্য সার্থক মানবীয় সৌন্দর্যলোকের সৃষ্টি করেছে। দেবনির্ভর গাথা কাব্যের বুকে দেবত্বহীন মানবতার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আরাকান রাজসভার মুসলিম কবিদের মূল বৈশিষ্ট্য এখানেই। 

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রায় দেড়শ বছর। এ সংযোগের ফলে আরাকান রাজ্যে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপক ও গভীর হয়। আরাকানদের ধর্মসহিষ্ণুতার দরুন বৌদ্ধ ও ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়েছিল। পঞ্চদশ শতক থেকে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও কেবলমাত্র সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানে সমৃদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল সেখানকার রাজা ও রাজপরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায়। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা খাঁটি বৌদ্ধ ছিলেন না। বাংলা সাহিত্য চর্চায় তাদের গভীর অনুরাগ ছিল। তাছাড়া আরাকান রাজারা দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম উপাধি ব্যবহার করেছেন তাঁদের নামের সঙ্গে। তাদের রাজসভার উচ্চপদগুলোতে মুসলমানেরাই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মূল কারণ আরাকানের নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতির চেয়ে মুসলিম সংস্কৃতি অনেকাংশে উন্নত ছিল। আরাকান রাজসভায় আরবি, ফারসি এবং তুর্কি মতবাদে অনুরক্ত কবিদের আবির্ভাব ঘটে এবং বিদগ্ধ মুসলমান ফারসি রচনা ছেড়ে বাংলা রচনায় উৎসাহ বোধ করলেন।

আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের আনুকূল্যে বাংলা সাহিত্যের চর্চা করে যে সকল মুসলিম কবি খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের পরিচয় নিচে দেয়া হলঃ

১. সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮ খ্রিঃ): খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে আবির্ভূত মুসলিম কবিদের মধ্যে সৈয়দ সুলতান একটি সমুজ্জ্বল দীপশিখা। তিনি সুফিসাধক এবং রাধাকৃষ্ণের পদাবলির গায়ক। তার জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত চক্রশালা নামক স্থানে। তার স্থায়ী নিবাস ছিল চট্টগ্রাম জেলার পরাগলপুরে। কবি সৈয়দ সুলতান রচিত কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে (ক) নবীবংশ, (খ) রসুলবিজয়, (গ) শব-ই-মিরাজ, (ঘ) ওফাৎ-ই রসুল, (ঙ) জ্ঞান প্রদীপ, (চ) জয়কুম রাজার লড়াই উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি কিছু সংখ্যক পদাবলি ও মারফতি গান রচনা করেছেন।

২. মুহম্মদ খান (১৫৮০–১৬৫০ খ্রিঃ): মুহম্মদ খান সৈয়দ সুলতানের শিষ্য। মুহম্মদ খানও সপ্তদশ শতকের অভিজাত গোষ্ঠির আরেক কবি। তার রচিত গ্রন্থাবলি— (ক) মক্তুল হোসেন, (খ) হানিফার লড়াই, (গ) কিয়ামত নামা, (ঘ) কাসেমের লড়াই। তার ‘মক্তুল হোসেন’ গ্রন্থে নবীবংশের কথা থাকলেও তাতে চট্টগ্রামের কথা, নিজ বংশের পরিচয়ও বিদ্যমান।

৩. আব্দুল হাকিমঃ কবি আব্দুল হাকিম বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এ পর্যন্ত তার রচিত কাব্য— (ক) ইউসুফ জুলেখা, (খ) লালমতী সয়ফুলমুলুক, (গ) শিহাবউদ্দিন নামা, (ঘ) নূরনামা, (ঙ) নসীহৎ নামা, (চ) চারি মোকামভেদ, (ছ) কারবালা, (জ) শহরনামা। 

৪. ফকির গরীবুল্লাহ (১৬৭০ – ১৭৭০ খ্রিঃ আনুমানিক): বর্তমান হুগলী জেলার বালিয়া পরগনার অন্তর্গত হাফিজপুর নামক গ্রামে পুঁথিকার শাহ্ গরীবুল্লাহর জন্ম হয়। তার রচিত পুঁথি— (ক) আমীর হামজা, (খ) ইউসুফ-জোলায়খা, (গ) জঙ্গনামা, (ঘ) সোনাভান, (ঙ) সত্যপীরের পুঁথি।

৫. দৌলত কাজী (১৬০০–১৬৩৮ খ্রিঃ): দৌলত কাজীর জন্ম চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে। আরাকানরাজ শ্রীসুধর্মার রাজত্বকালে অমাত্য আশরাফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় দৌলত কাজী ‘সতীময়না ও লোর-চন্দ্রানী’ নামে কাব্যটি রচনা করেন। ১৬২২-৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি তিনটি কাব্য রচনায় হাত দিয়ে অসমাপ্ত রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনিই প্রথম তার কাব্যে মানবের জয়গান করেছেন-

“নিরঞ্জন সৃষ্টি নর অমূল্য রতন।

ত্রিভুবন নাহি কেহ তার সমান।”

৬. আলাওল (১৬০৭-১৬৮০ খ্রিঃ): আরাকানে সপ্তদশ শতকে রচিত বাংলা সাহিত্যের কবি সৈয়দ আলাওল। সপ্তদশ শতকে কাব্য সাধনায় ব্রতী সাহিত্যিকদের মধ্যে আলাওল অবিসংবাদিত রূপে শ্রেষ্ঠ। তিনি ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত ‘জোবরা’ নামক গ্রামে প্রখ্যাত সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কবি আলাওলের যে সমস্ত পুঁথি পাওয়া গেছে তার সংখ্যা ছয়টি। ফারসি সাহিত্য থেকে ‘সেকেন্দারনামা’, ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’, ‘হপ্ত পয়কর’- ধর্ম বিষয়ক ‘তোহফা’ এবং মাগণ ঠাকুরের আদেশে কবি ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন। এছাড়াও তিনি পদাবলি এবং কিছু সংখ্যক অধ্যাত্ম সঙ্গীত রচনা করেন। তদুপরি মহাপাত্র সোলেমানের আদেশে তিনি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য সমাপ্ত করেন।

৭. মরদন (১৬০০-১৬৪৫ খ্রিঃ): আরাকানের অন্য আর একজন লৌকিক্ প্রেমগাথার কবি মরদন। তিনি রাজা শ্রী সুধর্মার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘নসীরা নামা’ নামক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। কবি সম্ভবত রোসাঙ্গের কাঞ্চি নামক নগরে বসবাস করতেন। তার কাব্যের বিশেষত্ব এখানেই যে, কাহিনী সম্পূর্ণ লৌকিক ধারার অনুগামী। দেশীয় উপাদানে এমন কাব্য রচনার কৃতিত্বে কবি মরদন গৌরবান্বিত।

৮. কোরেশী মাগন ঠাকুর (১৬০০ – ১৬৬০ খ্রিঃ): আরাকান রাজসভার অন্যতম খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে কোরেশী মাগন ঠাকুরের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘চন্দ্রাবতী’ নামক কাব্যের রচয়িতা এবং কবি আলাওলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন মাগণ ঠাকুর রোসাঙ্গরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং আরাকানেই বসবাস করতেন।

৯. আব্দুল করিম খন্দকারঃ আরাকান রাজসভাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার যে বিকাশ সাধিত হয়েছিল তার প্রভাবেই আব্দুল করিম খন্দকারের আবির্ভাব ঘটে। তিনি আরাকানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি রাজ কোষাধ্যক্ষ আতিবর নামক এক ব্যক্তির আদেশে ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দুল্লা মজলিস’ কাব্য রচনা করেন। পরে ‘হাজার মসাইল’ ও ‘নূরনামা’ নামে দুটি কাব্যও রচনা করেন।

উপসংহারঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকান রাজসভার কবিগণের অবদান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগের ধর্মীয় বিষয় অবলম্বনে রচিত কাব্যের পাশাপাশি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করে তারা এক স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। মানবিক প্রণয় কাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে তারা মধ্যযুগের সাহিত্যকে বৈচিত্র্যধর্মী করে তোলেন। সংস্কৃত ভাষার বাইরে হিন্দি ও ফারসি ভাষায় রচিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদের প্রথম কৃতিত্ব আরাকান রাজসভার কবিদের। উন্নততর সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপনে, কাব্যের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য আনয়ন করে আরাকানবাসী কবিগণ ১৬২২-১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে যে অগ্রগতি সাধন করেছিলেন তা সে সময়ে বাংলা ভাষার আপন ঘরেও সম্ভব হয় নি। বস্তুতপক্ষে এ কবিরাই মধ্যযুগে মানবিক প্রণয় কাহিনী পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দ সম্পদে, ছন্দ বৈভবে, পাণ্ডিত্য গর্বে ও ভাষার ঝঙ্কারে বাংলা সাহিত্যকে সুসমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন।