আরবীয় শাসনব্যবস্থা ও প্রকৃতি:

মহম্মদ-বিন্-কাশিম যে নিছক লুণ্ঠনকারী ছিলেন না—তার প্রমাণ পাওয়া যায় এদেশে তাঁর যুদ্ধবিজয়ের পরবর্তী কর্মধারা থেকে। সিন্ধুদেশে প্রবেশ করে এক-একটি নগর বা অঞ্চল দখল করার পরেই তিনি সেখানে আরবীয় শাসন নিযুক্ত করেন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৈন্য মোতায়েন করেন। তবে সিন্ধুর রাজা দাহিরকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর চিন্তাধারা ছিল একজন গোঁড়া ধর্মপ্রচারক ও সম্পদ সংগ্রাহকের। এই পর্বে মহম্মদ-বিন্-কাশিম প্রশাসনিক পদে কেবলমাত্র আরবীয়দের নিযুক্ত করেন, এবং বিজিত অঞ্চলে লুঠতরাজ ও পরাজিতদের ইসলামধর্মে দীক্ষিত করার কাজকেই তাঁর প্রশাসনের একমাত্র লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেন। তাঁর প্রভু হজ্জাজ ছিলেন প্রচণ্ড গোঁড়া। স্বভাবতই তাঁর নির্দেশে কাশিম নির্বিচারে লুণ্ঠন ও ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু এই যুদ্ধে রাজা দাহিরের পরাজয় ও মৃত্যুর পরে সমগ্র সিন্ধুদেশ আরব-বাহিনীর করতলগত হলে, এখানে স্থায়ী ও কার্যকরী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। কারণ আরবরা সংখ্যায় ছিল খুব কম এবং অধিকাংশই যোদ্ধা। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা তাদের ছিল না। ভারতের প্রশাসনিক পরিকাঠামো, ভাষা, রাজস্বব্যবস্থা ও আইনকানুন ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। অন্যদিকে হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমণকারী ও ধর্মনাশকারী বিধর্মী এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আরবদের সাথে অসহযোগিতা না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বস্তুত, আরব-বাহিনীর অনুপ্রবেশকাল থেকে তাদের কার্যকলাপ এই বিরূপতা তৈরি করার পক্ষে যথেষ্টই ছিল। এমতাবস্থায় মহম্মদ-বিন্-কাশিম দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হজ্জাজ ও সিন্ধুর অধিবাসীদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য কাশিমকে নমনীয় ও বাস্তববাদী নীতি গ্রহণের অনুমতি দেন। ‘বিনা প্রশ্নে ইসলাম গ্রহণ অথবা মৃত্যুবরণ’—হিন্দুদের প্রতি এই নীতির আক্ষরিক প্রয়োগের পরিবর্তে তিনি কিছুটা সামঞ্জস্যবিধান নীতি গ্রহণ করেন। নিয়মিত ‘জিজিয়া কর প্রদানের পরিবর্তে হিন্দু ও বৌদ্ধদের এবং ইহুদি বা খ্রিস্টানদের (জিম্মি) মতো নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকার দেওয়া হয়। মহম্মদ-বিন্-কাশিম মুলতানে ঘোষণা করেন : “খ্রিস্টানদের গির্জা, ইহুদিদের ধর্মসভা ও পারসিক পুরোহিতদের পূজাবেদির মতো হিন্দুদের মন্দিরও পবিত্র থাকবে।” স্যার উইলিয়াম মুর (W. Muir)-এর মতে, এই ব্যবস্থা ইসলামের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারার সূচনা করে। কারণ এতদিন পর্যন্ত আল-কিতাবী হিসেবে স্বীকৃত হিব্রু বা খ্রিস্টানগণ ব্যতীত কাউকে জিজিয়া প্রদানের পরিবর্তে ধর্মানুসরণের স্বাধীনতা দেওয়া হত না। সিন্ধুদেশে কাশিম- প্রবর্তিত এই সমঝোতা পরবর্তীকালে মুসলমান শাসকদের পথ দেখিয়েছে বলেও স্যার মুর মনে করেন। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তবও এই মন্তব্যের সাথে একমত। তবে তিনি মনে করেন, মুসলমানদের এই আংশিক ধর্মসহিষ্ণুতা তাদের মনে উদারতার ফসল নয়। একটা দেশের সমস্ত মানুষকে ধর্মান্তরিত করা অসম্ভব ও অবাস্তব জেনে তারা এহেন মধ্যপন্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়েছিল। যাই হোক, এই ব্যবস্থায় মহম্মদ-কাশিম সিন্ধুর হিন্দুদের সহযোগিতা অর্জনে সক্ষম হন এবং তাদের সাহায্যে সিন্ধুদেশে একটি কার্যকরী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

সিন্ধুর বিজিত ভূখণ্ডকে কয়েকটি জেলায় (ইতা) বিভক্ত করা হয় এবং সরকারের প্রয়োজনে সামরিক সেবাপ্রদানের শর্তে প্রতিটি জেলার শাসনভার একজন করে আরবদেশীয় সামরিক অফিসারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। জেলার নিম্নস্তরের প্রশাসনিক দায়িত্ব হিন্দু কর্মচারীদের হাতে থাকে। সৈন্যদের নগদ বেতনের পরিবর্তে অনেককেই ‘জায়গির’ জমি দেওয়া হয়। মুসলমান সম্ভ এবং ইমামরাও দান হিসেবে জমি ভোগ করার সুযোগ পান। এই ব্যবস্থার ফলে সিন্ধুদেশে বেশ কয়েকটি আরবীয় সামরিক উপনিবেশ গড়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় শাসন-দায়িত্ব আগের মতোই স্থানীয় মানুষের হাতে থাকে। গ্রামাঞ্চলে আইনকানুনও অপরিবর্তিত থাকে। কিছু নতুন আইন রচিত হয় মূলত শহরাঞ্চলের জন্য।

আরবদের শাসনে সিন্ধুর করব্যবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ‘ভূমি রাজস্ব’ এবং ‘জিজিয়া’। উৎপন্ন ফসলের দুই-পঞ্চমাংশ বা এক-চতুর্থাংশ হিসেবে সংগ্রহ করা হত। এ ছাড়া নিলামের মাধ্যমে কিছু কিছু এককালীন কর আদায় করা হত। ‘জিজিয়া’ ছিল একপ্রকার ধর্মকর, যা অ-মুসলমানদের প্রদান করতে হত। প্রত্যেকের আয়ের ভিত্তিতে তার প্রদেয় ‘জিজিয়া’র পরিমাণ নির্ধারণ করা হত। “জিজিয়া’ নির্ধারণের জন্য অ-মুসলমানদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। তথাকথিত ধনীদের মাথাপিছু জিজিয়ার হার ছিল ৪৮ দিরহাম। মধ্য-আয়ী ব্যক্তিদের দিতে হত ২৪ দিরহাম করে এবং নিম্ন আয়কারীদের প্রদেয় জিজিয়ার হার ছিল মাথাপিছু ১২ দিরহাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিকভাবে অক্ষম, অন্ধ, কর্মহীন প্রমুখকে জিজিয়া প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। আরবদের আমলে বিচারব্যবস্থা ছিল বিশৃঙ্খলায় ভরা। বিচারালয়ের সুনির্দিষ্ট স্তরবিন্যাস ছিল না। জেলা আধিকারিক বা অভিজাতগণ নিজ নিজ এলাকার বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। নির্দিষ্ট বা লিপিবদ্ধ কোনো আইন নয়, বিচারকের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারাই শাস্তি নিরূপিত হত। স্বভাবতঃই হিন্দুদের ওপর শাস্তির বোঝাটা ছিল অনেক বেশি। সামান্য চুরির অপরাধে কোনো কোনো হিন্দুকে চরমভাবে নির্যাতন করা কিংবা তার স্ত্রী-পুত্রদের পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনার অভাব ছিল না। হিন্দু ও মুসলমান-এর মধ্যে কোনো বিরোধ ঘটলে কাজি কোরানের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বিচার করতেন। অবশ্য হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ স্থানীয় পঞ্চায়েত ফয়সালা করতে পারতেন। তবে পরবর্তীকালে আগত তুর্কিদের তুলনায় আরবদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল অনেক কম। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, “জিজিয়া কর প্রদানের বিনিময়ে হিন্দুরা ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ভোগের অধিকারী ছিল। অধুনা কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ‘জিজিয়া’-কে নিছক ধর্ম-কর না বলে ‘সামরিক বৃত্তি রেহাই-কর’ বলাই ভালো। কারণ ইসলামীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী একজন মুসলমান রাষ্ট্রকে সর্বদা সামরিক সেবা দিতে বাধ্য ছিল, কিন্তু অ-মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই সামরিক সেবা বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই তাদের ‘জিজিয়া’ কর দিতে হত। কিন্তু ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব এই ব্যাখ্যাকে ‘ভ্রান্তিমূলক’ মনে করেন। কারণ যে সকল হিন্দু সামরিক বৃত্তি অবলম্বন করত, তাদেরও ‘জিজিয়া কর দিতে হত। সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা আরবদের শাসনব্যবস্থায় ছিল না। রাজা দাহিরের আমলে জাঠ, মেড প্রভৃতি নিচুতলার মানুষ যে অভাব ও অমর্যাদার সাথে বসবাস করত, আরবদের শাসনকালেও তা অপরিবর্তিতই ছিল।

আরব শাসনের স্বল্পস্থায়িত্বের কারণ :

খলিফার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের অঙ্গ হিসেবে সিন্ধুদেশ টিকেছিল মাত্র দেড়শো বছর। তার পরেও সিন্ধুতে আরবদের শাসন অব্যাহত ছিল প্রায় দেড়শো বছর; কিন্তু এটি ছিল নিছক শব্দবর্ণহীন একটি মৃতপ্রায় অধ্যায় মাত্র। ৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর শাসকদের সাথে খলিফার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং মুলতান ও মনসুরা’কে কেন্দ্র করে দুজন আরব শাসক প্রায় স্বাধীন শাসন চালাতে থাকেন। তুর্কিদের আগমনের আগেই আরবদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে যায়। যে প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে আরবগণ সিন্ধু দখল করেছিল, তার এহেন স্বল্পস্থায়ী ও গুরুত্বহীন পরিণতি বিস্ময়কর। সম্ভাবনা সত্ত্বেও ভারতভূমিতে আরবদের এই ব্যর্থতার অনেকগুলি কারণ ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে।

প্রথমত, সিন্ধুবিজয়ী আরবদের ভারতব্যাপী কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তারা সিন্ধুকে ভারত-বিজয়ের ভিত্তিকেন্দ্র রূপে ব্যবহার করার পরিবর্তে অবশিষ্ট ভারত-জীবন থেকে সিন্ধুদেশকে বিচ্ছিন্ন রেখেই সন্তুষ্ট ছিল। ইতিপূর্বেই আরবদের সাথে ব্যাপক বাণিজ্যের সূত্রে সিন্ধুপ্রদেশ বহির্ভারতীয় মুসলমান রাষ্ট্রগুলির সাথে অধিক সম্পর্কিত ছিল। রাজস্থানের মরুভূমির ওপারে হিন্দু-জগৎ থেকে এটি ছিল বিচ্ছিন্ন। আরবগণ সিন্ধুর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করার পরেও ভারতের রাজনৈতিক জীবনের মূল স্রোতের সাথে সিন্ধুর যোগ ঘটানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

দ্বিতীয়ত, আরবদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা সিন্ধুতে তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট করেছিল। ওমায়িদ বংশের সাথে আব্বাসিদ বংশের বিরোধ ও ক্ষমতাদখলের লড়াই, সিন্ধুর আরব শাসকদের স্বাধীনতাস্পৃহা বৃদ্ধি করেছিল। তা ছাড়া সিন্ধু-বিজয়ের প্রথম পর্বে খলিফার উদার হাতে আক্রমণকারীদের সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই খলিফার দরবারে এ সত্য প্রকাশ পায় যে, সিন্ধু একটি অনুর্বর দেশ এবং সেখান থেকে প্রচুর রাজস্বলাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে খলিফার দপ্তর সিন্ধুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং মাঝে মাঝে সিন্ধুনদীর গতিপথ পরিবর্তনের ঘটনা এই ধারণাকে আরও জোরদার করে।

তৃতীয়ত, আরব-আক্রমণকারীরা যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ঐক্যবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সিন্ধুদেশের বিরুদ্ধে আক্রমণে নেমেছিল, সিন্ধু-বিজয়ের পর তা দ্রুত অন্তর্হিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের সুখ তাদের অলস ও উদ্যোগহীন করেছিল। ইতিমধ্যে খলিফা হারুণ-অল্-রশিদ-এর আমলে (৭৮৬-৮০৮ খ্রিঃ) বাগদাদের নৈতিক জীবনেও ইসলামের ত্যাগ, সংগ্রাম ও ভালোবাসার মূল সত্যের পরিবর্তে বিলাস ও দার্শনিক সুখবাদের প্রাবল্য ঘটেছিল। এই প্রভাব পড়েছিল সিন্ধুতেও। স্বভাবতই সামরিক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আরব-প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ আর সম্ভব ছিল না।

চতুর্থত, হিন্দু-অধ্যুষিত ভারতবর্ষের সাথে আরবদের হৃদয়ের মেলবন্ধন ঘটানোর কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সিন্ধুবাসীদের কাছে আরবগণ নিছক আক্রমণকারী হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে সমগ্র হিন্দুসমাজের মনে যে গোপন প্রতিরোধ-বাসনা গড়ে উঠেছিল, আরব শাসনের অস্থায়িত্বের জন্য তার দায়িত্ব কম নয়। শ্রীবাস্তব লিখেছেন : “The generality of the Hindus, under the influence of the priestly class, considered themselves and their culture superior that of the Arabs, who were, in their eyes, nothing more than unclean barbarians.”

পঞ্চমত, পূর্ব ও উত্তর ভারতের পরাক্রান্ত রাজপুত শক্তিগুলির, বিশেষত গুর্জর-প্রতিহার বংশের উপস্থিতি আরবদের ভারতব্যাপী সাম্রাজ্যের সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছিল। অনেকেই মনে করেন, রাজপুতদের সামরিক পরাক্রমের কাছে আরবদের অবস্থান ছিল দুর্বল। এ ছাড়া মহম্মদ-বিন্-কাশিমের মতো দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতার অভাব, সিন্ধুর ভৌগোলিক অবস্থিতি, আধুনিক তুর্কিশক্তির উত্থানের ফলে খলিফার ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি একাধিক কারণের সমন্বয়ে আরবদের উজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘায়িত হতে পারেনি।