সিন্ধুদেশে আরব শাসনের গুরুত্ব:

আরবগণ কর্তৃক সিন্ধুদেশ বিজয় ও তিনশত বৎসর স্থায়ী শাসনব্যবস্থা কোনো স্থায়ী বা সুদূরপ্রসারী ফল দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল না। স্ট্যান্‌লি লেপুল (S. Lanepool) আরবদের সিন্ধুবিজয়কে “ভারতবর্ষ ও ইসলামের ইতিহাসে একটি ক্ষুদ্র উপাখ্যান, একটি নিষ্ফল বিজয়” (“merely an episode in the history of India and Islam, a triumph without results”) বলে গণ্য করেছেন। মূলগতভাবে এই বক্তব্যের সাথে অধিকাংশ পণ্ডিতই একমত। অধ্যাপক শ্রীবাস্তব (A. L. Srivastava) এই বিজয়ের রাজনৈতিক গুরুত্বহীনতা বর্ণনা করে লিখেছেন : “From the political point of view the Arab conquest of Sind was an insignificant event in the history of Island and also in that of India.” স্যার ওলসি হেইগ (W. Haig)-এর মতে, “সিন্ধুতে আরবদের অধিষ্ঠান ছিল একটি সামান্য উপাখ্যান এবং একটি বিরাট দেশের অতি ক্ষুদ্রতম অংশে তাদের স্বল্পস্থায়ী কর্মকাণ্ড সীমিত ছিল।” অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ভারতে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আরবরা অগ্রসর হয়নি। বিশাল এই ভারত মহাদেশের একপ্রান্তকে তাদের আক্রমণ নাড়া দিতে পেরেছিল মাত্র; এবং তাও মিলিয়ে গিয়েছিল স্বল্পকালের মধ্যেই।”

সিন্ধুদেশে আরবদের অভিযান এবং তার দুঃখজনক পরিণতি উল্লিখিত মন্তব্যগুলির যথার্থতা প্রমাণ করে। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য যে, স্বল্পকালের মধ্যে একাধিক মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় যে আরবদেশের বিজয়পতাকা উড্ডীন হয়েছিল, ভারতবর্ষে তারা ছিল অনেক নিষ্প্রভ। ভারতের রাজনৈতিক জীবনের মূল ধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন সিন্ধুদেশের ক্ষুদ্রতম গণ্ডির মধ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। স্বভাবতই বিশাল ভারত-ভূখণ্ডের রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনে তাঁদের উপস্থিতি অনুভূত হয়নি, আর তাকে প্রভাবিত করার প্রশ্ন তো অবান্তর। এই সত্য আরও দৃঢ় হয় যখন লক্ষ্য করা যায় যে, সিন্ধু থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার জন্য ভারতীয় শক্তিগুলি আদৌ কোনো সংঘবদ্ধ উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এমনকি আরব-বাহিনীর এহেন সাফল্যলাভের ঘটনা থেকে ভবিষ্যতের বৃহত্তর ও ব্যাপক কোনো আক্রমণের সম্ভাবনা রোধ করার জন্য সীমান্ত সুরক্ষা বা ঐক্যবদ্ধ থাকার শিক্ষাও ভারতীয় রাজন্যবর্গ গ্রহণ করেননি। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আরবগণ কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাননি। অনুর্বর সিন্ধুর অর্থনীতিকে সবল করার কোনো চেষ্টাও তারা করেনি। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে আরবদেশ যথেষ্ট অগ্রণী ছিল। ইসলামধর্ম প্রসারের কাজেও তারা ছিল ব্যর্থ। ‘জিজিয়া’ কর প্রদানের বিনিময়ে অধিকাংশ ভারতবাসী তাদের স্বধর্মে দৃঢ় ছিল। হিন্দুদের কাছে আরবগণ ছিল ‘বর্বর আক্রমণকারী’ মাত্র। তাই আরবদের সাথে তারা কখনও একাত্ম হতে পারেনি। আর আরব-শাসকরাও নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও দুর্বলতার কারণে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।

রাজনৈতিক দিক থেকে নিষ্ফল হলেও সিন্ধুদেশে আরব-শাসনের কিছু পরোক্ষ ফল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব মনে করেন, আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করে এদেশে ইসলামের যে ভিত রচনা করে যায়, তার ওপরে ভর রেখে পরবর্তীকালে তুর্কিরা ইমারত গড়ে তুলেছিল। তিনি লিখেছেন: “The Arab conquest of Sind was destined to sow the seed of Islam in this land. …It became the endeavour of future invadors from the north-west to help this religion expand and flourish…” শ্রীবাস্তবের এই মূল্যায়নকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সিন্ধুতে আরব শাসনের ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সকল ঐতিহাসিক একমত। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, ভারতবর্ষের সাথে সংযোগের ফলে বেশি উপকৃত হয়েছিল আরবের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। মন্দির, দুর্গ, প্রাসাদ ইত্যাদি ভারতের বহু সুদৃশ্য ইমারত আরবদের সদম্ভ আঘাতে ধ্বংস হয়েছিল। তাদের নির্মিত দুর্গ ও প্রাসাদ কালের করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ভারতের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন থেকে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পেরেছে। ভারতীয় সভ্যতার উন্নত মান তাদের অবাক করেছিল। ভারতীয় দর্শনের অন্তর্নিহিত ভাবধারা এবং ভারতীয় পণ্ডিতদের জ্ঞানের গভীরতা বিস্মিত করেছিল নবণত আরবদের। এখানে এসে তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে যে, ইসলামের মূল তত্ত্ব একেশ্বরবাদ হিন্দু-দর্শনে অজানা বা অস্বীকৃত নয়। আরবরা ভারতীয়দের কাছ থেকেই রাষ্ট্রশাসনের গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত হয়। তাই আরবদেশের প্রশাসনে তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়।

ভারতীয় ভাস্করদের অমর সৃষ্টি দেখে বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে আরবরা তাদের দেশে সসম্মানে নিয়ে যায় ভারতীয় শিল্পীদের। ভারতীয় পণ্ডিতদের পদতলে বসে দর্শন, ভেষজ, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতি শাস্ত্রে তারা দক্ষতা অর্জন করে। খলিফা মনসুরের আমলে (৭৫৩-৭৭৪ খ্রিঃ) বাগদাদে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন বহু ভারতীয় পণ্ডিত। আরবীয় শিক্ষার্থীরাও ভারত থেকে বাগদাদে প্রত্যাবর্তন করেন খলিফার আগ্রহে। তাঁরা এই সময় ব্রহ্মগুপ্ত রচিত ‘ব্রহ্ম-সিদ্ধান্ত’ ও ‘খণ্ড-খাদ্যক’ নামক দুটি পুস্তক আরবে নিয়ে যান এবং ভারতীয় পণ্ডিতদের সহায়তায় সেগুলিকে আরবিতে ভাষান্তরিত করেন। এখান থেকেই আরবগণ বৈজ্ঞানিক জ্যোতির্বিদ্যার মূলতত্ত্ব শিক্ষালাভ করে। খলিফা হারুণের আমলে (৭৮৬-৮০৮ খ্রিঃ) এই যোগাযোগ আরও সম্প্রসারিত হয়। আরবীয় লেখকদের গ্রন্থে ভালা, মনাকা, বিজয়কর, সিন্দবাদ প্রমুখ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রশংসনীয় ভূমিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, মনাকা একবার এক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে খলিফা হারুণকে মুক্ত করেছিলেন। বাগদাদের একটি চিকিৎসালয়ে প্রধান চিকিৎসক হিসেবে ধনা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। বস্তুত, ইউরোপের ভাবজগৎ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান একদা বাগদাদের আলোকস্পর্শে আলোকিত হয়েছিল; এবং একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, বাগদাদের এই গৌরবের মূল স্থপতি ছিল ভারতবর্ষ। ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন : “A great many elements of Arabian culture, which afterwards had such a profound effect upon European, civilization were borrowed from India.” আরবদেশের মাধ্যমে ভারতীয় সুপ্রাচীন ও সুমহান জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা ইউরোপে সম্প্রসারিত হয়েছিল। তাই অষ্টম ও নবম শতকে ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তির আড়ালে ভারতের সাথে আরবদের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অধ্যাপক শ্রীবাস্তব লিখেছেন যে, “Much of the enlightenment of the early Europeans of the 8th and 9th centuries A. D., was therefore due to the Arab contact with India.” ঐতিহাসিক হ্যাভেলও স্বীকার করেছেন যে, ভারতের সাথে সংযোগের ফলে আরবীয় তথ্য ইউরোপীয় দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি পুষ্ট হয়েছিল।

এই উজ্জ্বল চিত্রের অন্ধকারময় দিকটিও উল্লেখ্য। আরবগণ ভারতীয় দর্শন ইত্যাদির স্পর্শে সঞ্জীবিত হলেও, ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদিকে তারা কোনোভাবে সাহায্য করেনি বা করতে চায়নি। তাই সেদেশের মহত্তর দিক, যা কিছু কিছু নিশ্চয় ছিল, এদেশের মাটিতে প্রচারিত হতে পারেনি। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মনে করেন, আরবদেশের শাসককুলের অনুদারতা এজন্য অবশ্যই দায়ী ছিল। তিনি আরও মনে করেন যে, আরবীয় পণ্ডিতেরা যেভাবে বাগদাদের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছিলেন, ভারতীয় পণ্ডিতেরা ঠিক ততটা স্বাধীনতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন কিনা সন্দেহের অবকাশ আছে। এটি অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। তবে সান্ত্বনা এই যে, ভারতবর্ষ তার উদারতা ও আতিথেয়তা সুমহান ঐতিহ্য বহিরাগত আরবদের ক্ষেত্রেও উন্মুক্ত হাতে বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।