আরবদের সাফল্যের কারণ:

আরব-আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বিলম্ব হলেও রাজা দাহিরের প্রতিরোধ ছিল যথেষ্ট তীব্র। বীরের মতোই যুদ্ধক্ষেত্রে অসংখ্য সঙ্গীসহ তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এমনকি রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পত্নী রানীবাঈ অসম সাহসিকতা ও দেশাত্মবোধের পরিচয় দিয়ে রাওর দুর্গ থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যান। চূড়ান্ত পরাজয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমানরাই বিজয়ী হয়। আরবদের এই সাফল্যে ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ বা সুদূরপ্রসারী কোনো পরিবর্তন হয়তো ঘটাতে পারেনি, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তুর্কি আক্রমণকারীদের সাফল্যের প্রেক্ষাপট বিচারের দিক থেকে আরব-বাহিনীর এই সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ। নানা কারণে মুসলমানরা সিন্ধুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল।

প্রথমত, মহম্মদ-বিন্-কাশিমের দক্ষ নেতৃত্ব এবং মুসলমানদের উন্নত সামরিক কৌশল অবশ্যই তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল। মুসলমানদের দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সাম্যবোধ ও ধর্মীয় প্রেরণা তাদের প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। কিন্তু কেবল ক্ষাত্রশক্তির তারতম্য একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাজ ও রাজনীতির পতন ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। এই ব্যর্থতা ও পতনের জন্য তার অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধুর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিও এজন্য কম দায়ী ছিল না। রাজা দাহিরের পিতা চাচ্ অন্যায়ভাবে সিন্ধুর ক্ষমতা দখল করেছিলেন বলে এই বংশের প্রতি সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন ছিল না। তাই দাহিরের সিন্ধুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের আক্রমণ সাধারণ মানুষকে বিশেষ প্রভাবিত করেনি।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক শ্রেণিভেদ ও বৈষম্য এবং রাজশক্তি কর্তৃক তাকে সমর্থন সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে রাজতন্ত্রের বিরোধীতে পরিণত করেছিল। জাঠ, মেড এবং অন্যান্য নিম্নশ্রেণির মানুষেরা সরকারি কর্তৃপক্ষ দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হত। উচ্চশ্রেণির মানুষের সাথে এইসব নিম্নশ্রেণির মানুষের বিভেদ ও বৈষম্য সামাজিক সংহতি ব্যাহত করেছিল। ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দুরা। এর পরে ছিল বৌদ্ধ ও জৈনরা। স্বভাবতই ধর্মের ক্ষেত্রেও কোনোরূপ ঐক্যবদ্ধ প্রেরণা-সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল না। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জাঠ ও মেড জাতিভুক্ত মানুষেরা সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী রাজা দাহিরের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এইসব গোষ্ঠী আরব-আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজা দাহিরকে সাহায্য তো করেইনি; পরস্তু, আক্রমণকারীদের সাথে গোপন সমঝোতা দ্বারা দাহিরের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। ‘চাচনামা’ গ্রন্থে এই সকল ব্যক্তিকে ‘জাতীয়তাবাদীচেতনা-বঞ্চিত বিশ্বাসঘাতক’ অভিহিত করে বলা হয়েছে, “The Buddhist fifth-columnists welcomed the Arabs and entered into a pact with them against their own governor of Schwan.” অবশ্য একথা সত্য নয় যে, সমস্ত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষ দাহিরের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। আবার এটাও সত্য যে, অনেক অ-বৌদ্ধ ভারতীয় মুসলিম আক্রমণকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের সাফল্য ত্বরান্বিত করেছিল। প্রকৃত সত্য এই যে, উল্লিখিত বিবরণ তৎকালীন সিন্ধুদেশের তথা ভারতের সামাজিক বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার একটা ছবি তুলে ধরে, যা ভারতীয়দের রাজনৈতিক পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। চাঁদ বরদৈ রচিত ‘পৃথ্বীরাজ রসোঃ’ গ্রন্থের বিবরণও এই মতকে সমর্থন করে।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে সিন্ধুদেশ ছিল অনুর্বর। স্বভাবতই বিশাল সেনাবাহিনী বা অতি উন্নত যুদ্ধসরঞ্জাম সংগ্রহ করা সিন্ধুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আক্রমণকারী সেনাদের সংখ্যাধিক্য অবশ্যই তাদের সাফল্যের একটা কারণ ছিল। তবে সাহসিকতার দিক থেকে সিন্ধুর বাহিনীকে পশ্চাৎপদ বলা চলে না। কিন্তু শুধুমাত্র সাহসিকতাকে ভর করে আরবদের মতো শক্তিশালী আক্রমণকারীর গতিরোধ করা সম্ভব ছিল না।

চতুর্থত, সিন্ধুদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যই ভারতের অবশিষ্ট অংশ থেকে দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন ছিল। এমনিতেই ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল ভঙ্গুর ও আত্মধ্বংসী। কোনো কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব ছিল না। সেই সঙ্গে সিন্ধুদেশের একক অস্তিত্ব তাকে ভারতীয় মৈত্রী বা সাহায্যলাভে বঞ্চিত করেছিল নিদারুণভাবে।

পঞ্চমত, ব্যক্তিগতভাবে রাজা দাহিরের অদূরদর্শিতা ও অযোগ্যতা মুসলমানদের সাফল্যকে সহজলভ্য করেছিল। রাজ্যবিস্তারে আগ্রহী এবং শক্তিশালী আরবগণ সিন্ধুর সীমান্ত অঞ্চলে ‘মাকরান’ পর্যন্ত অগ্রসর হবার পরেও দাহির নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সামান্যতম চিন্তিত হননি। একজন রাজার বুদ্ধিবিবেচনার এই দৈন্য সত্যই কষ্টদায়ক। শুধু তাই নয়, মুসলমান বাহিনী যখন সিন্ধুর একের পর এক অঞ্চল দখল করছে, বিজয়োল্লাস করছে, নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন চালাচ্ছে, তখনও দাহির ব্রাহ্মণাবাদে বসে অলসভাবে চিন্তা করছেন কখন, কীভাবে তাঁর আক্রমণে যাওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একের পর এক পরাজয়ের ফলে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে ভারতীয় বাহিনীর মনোবল এবং একই কারণে আক্রমণকারীদের মনোবল তখন তুঙ্গে। (“as the Arabs, on account of their repeated success, were flushed with enthusiasm and our people, proportionately, dispirited and demoralised for the same reasons.”-A. L. Srivastava.)

ষষ্ঠত, আরব আক্রমণকালে সিন্ধুবাসীর মধ্যে আক্ষরিক অর্থে জাতীয়তাবোধ ছিল খুবই ক্ষীণ। ব্যক্তিগত তাৎক্ষণিক লাভের জন্য আক্রমণকারীদের গোপন খবর দিতে বা সহযোগিতা করতে তারা আদৌ দ্বিধা করত না। দেবল এবং মুলতানে আরবদের সাফল্যের মূল কারণই ছিল ভারতীয়দের বিশ্বাসঘাতকতা। অধ্যাপক শ্রীবাস্তবের মতে, বহুজাতিবাদের ভ্রান্ত ধারণা এবং দেশাত্মবোধের অভাব সমন্বিত হয়ে সিন্ধুবাসীর মানসিকতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যখন দেশীয় ও বিদেশীয় শক্তির মধ্যে প্রভেদ করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। তিনি লিখেছেন, “Defection and treachery were, without doubt, important causes of the fall of Sindh.”

সপ্তমত, স্ট্যানলি লেনপুল (S. Lanepoole) মনে করেন, আরব সেনাদের ধর্মীয় জেহাদ তাদের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ছিল। তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ইচ্ছানুয়ারী তারা পৌত্তলিকদের ধ্বংস করতে দায়বদ্ধ এবং এই কাজে তাদের সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে এমন কোনো ধর্মীয় প্রেরণা ছিল না। পরন্তু অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস তাদের প্রকৃত প্রতিরোধ ক্ষমতা শিথিল করেছিল। লেনপুল লিখেছেন, “The very bigotry of their cread (Islam) was an instrument of self preservation; in mere defence they must hold together as God’s elect in the face of the heathen and they must win over proselytes from the infidels.”