হজরত মহম্মদ (৫৭১-৬৩২ খ্রিঃ) ইসলামধর্মের প্রচার শুরু করেন সপ্তম শতকের প্রথম দশকে। তিনি ঘোষণা করেন, “ঈশ্বর (আল্লাহ) অদ্বিতীয়। তিনিই সৃষ্টিকর্তা। তিনি জন্ম ও মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক। তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।” ঈশ্বরের মহিমা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রত্যেককেই কতকগুলি মানবিক গুণের অধিকারী হবার পরামর্শ দেন, যার অন্যতম হল—দয়াদাক্ষিণ্য, সহমর্মিতাবোধ, সৌভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি। ধর্মাচরণের জন্য ঘোষণা করেন অতি সহজ, সরল, অনাড়ম্বর, ব্যয়বাহুল্যবর্জিত কয়েকটি নির্দেশিকা। প্রাথমিক তীব্র বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামধর্ম খুব দ্রুত মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং হজরত মহম্মদের জীবনাবসানের (৬৩২ খ্রিঃ) এক শতকের মধ্যেই ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে; এবং এই সম্প্রসারণের কাজে মূল ভূমিকা নেয় আরবদেশ।
ইসলামের জন্মভূমি আরবদেশ বিশ্বের বৃহত্তম উপদ্বীপ এবং গোলার্ধের শুষ্কতম অঞ্চল। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মিলনভূমি দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার এই উপদ্বীপটি পূর্ব গোলার্ধের কেন্দ্রভূমি হিসেবে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামধর্মের উত্থানের কালে আরবদের মোট জনসংখ্যা দেড় লক্ষের বেশি ছিল না এবং সমাজ ছিল উপজাতিভিত্তিক। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা, সামাজিক জীবনে বৈষম্য ও নৈতিক অধঃপতন দ্বারা জর্জরিত। আরব ভূখণ্ডে নতুন যুগের সূর্যোদয় ঘটে ইসলামের নেতৃত্বে। আরবদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা ইসলামধর্মের দ্রুত প্রসার ও শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ইসলামের স্পর্শে অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবভূমি যেমন আলোকের সন্ধান পায়, তেমনি আরবভূমিকে ভিত্তি করেই ইসলামের ধর্ম, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে। হজরতের মৃত্যুর পর ইসলামের বাণী বহন করার দায়িত্ব অর্পিত হয় খলিফা’র ওপর। প্রথম চারজন মহান খলিফা, যথা— আবুবকর (৬৩২-৩৪ খ্রিঃ), ওমর (৬৩৪-৪৪ খ্রিঃ), ওসমান (৬৪৪-‘৫৬ খ্রিঃ) এবং আলি (৬৫৬-৬১ খ্রিঃ)-র নেতৃত্বে আরবদেশে একটি সুষ্ঠু ও সবল শাসনকাঠামো গড়ে ওঠে এবং আরবের সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। আলির আমলে এক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এবং সিরিয়ার শাসনকর্তা মোয়াবিয়া আলিকে হত্যা করে খলিফা-পদ দখল করেন। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল খলিফা-পদ ‘উমায়েদ’ বংশের অধীনে থাকে। এই পর্বেই আরবগণ ভারতের সিন্ধু দখল করে তাদের শাসন প্রবর্তন করে। যাইহোক, ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই সিরিয়া ও মিশর আরবগণ কর্তৃক অধিকৃত হয়। ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পারস্য আরব সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অক্ষু নদী ও হিন্দুকুশ পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চল আরব শাসনাধীনে চলে আসে। অষ্টম শতকের মধ্যেই ইসলামের বিজয়পতাকা উড্ডীন হয়েছিল অতলান্তিক মহাসাগর থেকে সিন্ধুনদ এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে নীলনদ পর্যন্ত সুবিস্তৃত ভূখণ্ডে এবং স্পেন, পোর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্স, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, আরব, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, আফগানিস্তান, পারস্য, বালুচিস্তান ও ট্রান্স-অক্সিয়ানার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশাল আরব সাম্রাজ্য। পারস্য জয় করার পর আরবদের দৃষ্টি পড়ে পূর্বদিকে ভারতভূমির ওপর।
সুপ্রাচীনকাল থেকেই আরবের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আরবদেশে ইসলাম ধর্ম প্রসারের পর এই বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিছুটা সংকীর্ণতা ও প্রাচীন রীতি অনুসারে ভারতীয়রা কালাপানি পার হতো না। ফলে ভারতীয়দের প্রয়োজনেই বিদেশি বণিকরা ভারতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল। ভারতের জন্য আরবী ঘোড়া এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের মুক্তোর বিশেষ চাহিদা ছিল। অন্যদিকে বিদেশিদের প্রয়োজন ছিল ভারতের রেশমবস্ত্র, চিনি এবং তরবারি। তাই আরব বণিকরা ভারতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়। অষ্টম শতকে রাষ্ট্রকুটদের রাজত্বকালে আরবীয় বণিকরা ভারতে যথেষ্ট অভ্যর্থনা পেয়েছিল। দক্ষিণ ভারত ও দাক্ষিণাত্যের বহু ভূখণ্ডে, বিশেষত শহর ও গঞ্জ এলাকায়, মুসলমান নির্মাণ কর্মীদের বসতি গড়ে উঠেছিল। মহম্মদ বিন কাশিম কর্তৃক সিন্ধুদেশ দখলের পর উত্তর ভারতেও মুসলিমদের অনুপ্রবেশ ঘটে। তবে মুসলিম অভিবাসনের ঢেউ দ্রুততর হয়েছিল গজনীর সুলতান মামুদ কর্তৃক ভারত বিজয়ের পর।
তবে এই অভিবাসন খুব সুখের হয়নি। অলবেরুনী লিখেছেন যে, সুলতান মামুদের ভারত অভিযানে সীমাহীন লুণ্ঠন কার্য এবং ধর্মস্থানের ওপর আক্র । বহিরাগত মুসলমানদের সম্পর্কে হিন্দুদের মনে প্রবল ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল। তাই মামুদের মৃত্যুর পর গজনীর সরকারী কর্মচারীদের ভারত থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। কিন্তু মধ্য-এশীয় রাজনীতির পট্ পরিবর্তন পুনরায় দলে দলে মুসলমানদের ভারতে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করেছিল। দশম-একাদশ শতকে মধ্য-এশীয় রাজনীতিতে সেলজুক তুর্কীদের দ্রুত উত্থান ঘটেছিল। এরা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এবং ইসলাম-বিদ্বেষী। সুলতান মামুদ ও তাঁর পুত্র মাসুদের রাজত্বকালে পারস্য ও মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলি বার বার তুর্কী উপজাতির আক্রমণ ও লুণ্ঠনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এমতাবস্থায় সুলতান মাসুদ বহু অনুগামী সহ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই সময় পাঞ্জাব অঞ্চলে বিপুল সংখ্যায় মুসলমান অনুপ্রবেশ ঘটে। সেলজুক সাম্রাজ্য সংগঠিত হলে (১০৩৭-১১৫৭ খ্রিঃ) উপজাতীয় আক্রমণ কমে যায় এবং অভিবাসন প্রক্রিয়াও প্রায় থেমে যায়। কিন্তু দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি তুর্কীস্থানে কারা-খিজ ক্ষমতাসীন হলে পুনরায় পারস্য ও আফগান অঞ্চলে উপজাতীয় আক্রমণ ও লুঠ-পাঠের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই সময় শুরু হয় ভারতে মুসলিম অভিবাসনের দ্বিতীয় পর্ব।
দ্বাদশ শতকের অভিবাসনের কালেও প্রথমে পাঞ্জাব অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ক্রমে উত্তর-ভারতেও তাদের বসবাস সম্প্রসারিত হয়। এই সময় মুসলমানরা তাদের কারিগরি বিদ্যা, দক্ষতা এবং সংস্কৃতি সহ ভারতের ভূমিতে উপস্থিত হয়েছিল। ভারতের জনগণও তাদের চিরাচরিত সহনশীল মানসিকতা দ্বারা এই নতুন সংস্কৃতির পাশে সহাবস্থান শুরু করেন। অষ্টম শতকে আরব যোদ্ধাদের হাত ধরে ভারতীয় যোদ্ধারা পাথর ছোঁড়ার যন্ত্র ‘মুঞ্জানিক’-এর কারিগরী বিদ্যা ও ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এখন ভারতের হিন্দু (রাজপুত) রাজাদের অধীনে একটি করে মুসলমান বাহিনী রাখার রীতিও গড়ে উঠতে থাকে। চিনদেশ থেকে কাগজ তৈরির প্রযুক্তি শিক্ষা করে অধিবাসী মুসলমানদের মাধ্যমেই তা ভারতে পৌঁছায়। যথেষ্ট কম দামের এই কাগজ ভারতে প্রচলিত বৃক্ষপত্রের স্থান দখল করলে, সাহিত্য-সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রচারের কাজ সহজতর হয়। পশমের পোষাক বয়নের কাজেও মুসলিম শিল্পীরা দক্ষ ছিলেন। ঘুরীর আক্রমণের আগেই মুসলিম জনজাতি ও সংস্কৃতির সাথে ভারতের পরিচয় ঘনিষ্টতর হয়েছিল।
আরবদের সিন্ধুবিজয়ের পটভূমি ও কারণ :
ইসলামের বিজয়পতাকা বাহিত হওয়ার তথ্যমূলক বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু ভারতভূমিতে তাদের প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব অনুভূত হয়। আরবি ও ফারসিতে লেখা কিছু গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত অবশ্যই করা হয়েছে। তবে সেগুলির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। এ বিষয়ে প্রধান উপাদান হল অল-বিলাদুরি নামক গ্রন্থ। এতে আরবদের ভারত অভিযানের ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উল্লিখিত সন-তারিখের পরস্পর-বিরোধিতা কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তবে আল-তারি এবং খুলাস-উৎ-আকবর নামক গ্রন্থ দুটির সাহায্যে অল-বিলাদুরি’র বিভ্রান্তি কিছুটা নিরসন করা যায়। সিন্ধুর রাজা চাচ-এর নামাঙ্কিত চাচনামা গ্রন্থটি আরবদের সিন্ধু অভিযান সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান। এখানে ঘটনার ধারাবাহিকতা যথার্থভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া পরবর্তীকালে রচিত তারিখ-এ-সিন্ধ (মির মহম্মদ মাসুদ) এবং তুফাতুল কিরাম (আলিশের কানি) গ্রন্থ দুটিও এ বিষয়ে আমাদের আলোকপাত করে।
স্মরণাতীত কাল থেকে ভারতবর্ষ এবং আরবদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সপ্তম শতকে ইসলামধর্ম গ্রহণের আগেই আরবীয় বণিকেরা ভারতের পশ্চিম উপকূলে উপস্থিত হয়ে বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত। সিরাজ, হরমুজ প্রভৃতি বন্দর থেকে আগত বণিকেরা ভারতবাসীর কাছে বরণীয় ছিল অন্তত অর্থনৈতিক কারণে। ইসলামধর্ম প্রসারের অব্যবহিত পরেও এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রকৃতিগত বা গুণগত বৈশিষ্ট্য অব্যাহত ছিল। কিন্তু ইসলামধর্ম গ্রহণ করার পরে আরবদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে। ইসলামধর্ম আরবদের মধ্যে একদিকে যেমন রাজনৈতিক স্থিতি ও দৃঢ়তা আনে, অন্যদিকে তাদের মনে নতুন ভূখণ্ড ও ইসলামের বাণী প্রসারের উন্মাদনার জন্ম দেয়। ইতিপূর্বে ভারতে আগত বণিকদের মাধ্যমে এদেশের ঐশ্বর্য-সম্পদের বিষয়ে তারা অবহিত হয়েছিল। এখন আপন শক্তিবলে সেই সম্পদ দখল এবং পৌত্তলিকদের ধ্বংসসাধন করে ইসলামের সম্প্রসারণ—এই অর্থনৈতিক ও ধর্মনৈতিক দ্বৈত কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য তারা অস্ত্র হাতে অগ্রসর হয় ভারতের বিরুদ্ধে। আরবদের ভারতভূমি দখল কর্মসূচির প্রথম লক্ষ্য হয় সিন্ধুদেশ।
ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে আরবদের প্রথম সামরিক অভিযান প্রেরিত হয় খলিফা ওমর-এর আমলে। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেরিত এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল বোম্বাই-এর নিকটবর্তী থানা অঞ্চল। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সমুদ্রপথে এরূপ অভিযানের বিপদ-সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল বলে খলিফা এই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ প্রাথমিকভাবে নিষিদ্ধ করে দেন। ওমরের মৃত্যুর পর আবার আরবদের ভারত অভিযানের কর্মসূচি গৃহীত হয়। সমস্ত বিপদকে তুচ্ছ করে এবং একইসাথে জলপথ ও স্থলপথে ভারতের বিরুদ্ধে তারা পর কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করে। ৬৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লা-বিন্ অমর-বিন্-বাবি’র নেতৃত্বে আরবগণ ‘সিস্তান’ দখল করে এবং ‘মাক্রান’ (বালুচিস্তান) পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে জাঠ সম্প্রদায়ের মানুষ আরবীয়দের প্রবলভাবে বাধা দেয়। ভারত অভিযানের সমস্যা প্রসঙ্গে আবদুল্লা খলিফাকে এক পত্রে লেখেন : “এখানে পানীয় জলের খুব অভাব, ফলমূল নিম্নমানের, কিন্তু ডাকাতরা ভয়ংকর। খুব কম সৈন্য নিয়ে অভিযানে এলে তাদের নিহত হবার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু বেশি সংখ্যায় এলে তাদের উপোসী থাকতে হবে।” এমতাবস্থায় খলিফার নির্দেশে অভিযান পরিত্যক্ত হয়। এরপর ৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আল-হারি অভিযান চালিয়ে কিছুটা সাফল্য পান। কিন্তু ৬৬২ খ্রিস্টাব্দের অভিযানকালে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে আল-মুহাল্লব আর একটি ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যান্য কয়েকটি অভিযানে এসে আরব সেনাপতি আবদুল্লা, সিমান-বিন্ সালমা, রসিদ-বিন্-আমির, আল-মুধির প্রমুখ সাফল্য ও ব্যর্থতার মিলিত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। অবশ্য সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার ভার ছিল অনেক বেশি। অতঃপর ইরাকের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর আল হজ্জাজ সিন্ধুদেশের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের নেতৃত্ব দেন। খলিফা ওয়ালিদ মালিকের অনুমতি ও শুভেচ্ছা পেতেও তাঁর দেরি হয়নি। সিন্ধুর রাজা দাহির-এর সঙ্গে সামান্য একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হজ্জাজের মতবিরোধ ঘটলে, তিনি সিন্ধুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পাঠান। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে ওবেদুল্লা ও বুদাইল-এর নেতৃত্বে যে দুটি অভিযান পাঠান, তা আরবদের ধারাবাহিক ব্যর্থতারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়। যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন আরব সেনাপতিদ্বয়। ক্ষুব্ধ হজ্জাজ পরবর্তী অভিযানের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। অভিযানের নেতৃত্ব দেন নিজের জামাতা সপ্তদশ বর্ষীয় যুবক ইমাদ-উদ্দিন-মহম্মদ-বিন্-কাশিমকে (৭১২ খ্রিঃ)।
আরবগণ কর্তৃক সিন্ধু আক্রমণের এই পর্বের তাৎক্ষণিক কারণ সম্পর্কে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে। একটি মতানুযায়ী সিংহলে বসবাসকারী কয়েকজন মুসলমান বণিকের মৃত্যুর পর সিংহলরাজ মৃত বণিকদের কন্যাদের একটি জাহাজে করে খলিফার পূর্ব সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা হজ্জাজ-এর কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু সিন্ধুর উপকূলে জলদস্যুরা ওই জাহাজগুলি লুঠ করে। অন্য একটি মতে, সিংহলের রাজা স্বয়ং ইসলামধর্ম গ্রহণ করে খলিফার উদ্দেশ্যে কিছু উপঢৌকন একটি জাহাজে প্রেরণ করেন। সিন্ধুর উপকূলে জাহাজটি লুণ্ঠিত হয়। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ সিংহলের রাজার ইসলাম গ্রহণ তত্ত্বটিকে সম্পূর্ণ অবাস্তব, অসম্ভব ও ভ্রান্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। তৃতীয় মতানুসারে, খলিফা ওয়ালিদ-এর পিতা আব্দুল মালিক ভারত থেকে কিছু মহিলা ক্রীতদাস ও দ্রব্যসংগ্রহের জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। এই প্রতিনিধিদল সিন্ধুর দেবল বন্দরে উপস্থিত হলে জলদস্যু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তাদের মালপত্র লুণ্ঠিত হয়। তিনটি বিবরণীর মূলকথা হল— খলিফার প্রাপ্য কিছু জিনিস সিন্ধুর বন্দরে লুণ্ঠিত হয়েছিল। এই ঘটনায় হজ্জাজ প্রচণ্ড মর্মাহত হন এবং এই কাজের জন্য সিন্ধুর রাজা দাহির-এর কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু দাহির এ ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করেন এবং ক্ষতিপূরণ দিতে অসম্মত হন। অতঃপর ক্ষুব্ধ হজ্জাজ খলিফার অনুমতিক্রমে সিন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান।
কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক ওলসি হেগ ‘জলদস্যুদের দ্বারা লুণ্ঠন-তত্ত্ব ‘টিকেই আরবদের সিন্ধু অভিযানের (৭১২ খ্রিঃ) মুখ্য কারণ বলে মনে করেন। কিন্তু ভারতীয় বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, এটি ছিল অন্যতম এবং প্রত্যক্ষ কারণ, কিন্তু একমাত্র বা মূল কারণ নয়। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব (A. L. Srivastava) মনে করেন, আরবদের সিন্ধু-আক্রমণের পশ্চাতে গভীর রাজনৈতিক ও ভৌমিক আকাঙ্ক্ষা লুকিয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ভারতীয় ধনসম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা। ইতিপূর্বেই ভারতের ঐশ্বর্য সম্পর্কে তারা অবহিত হয়েছিল। এখন সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সা পুরণের শর্ত ও সঙ্গী হিসেবে ভারতের অতুল সম্পদ তাদের আক্রমণ-স্পৃহাকে প্রবলতর করেছিল। তবে আরবদের সিন্ধু-আক্রমণের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধর্মীয় প্রেরণা। শ্রীবাস্তবের ভাষায় : “…the principal driving force was the religious zeal which made them feel and act as if God was using them as agents for the propagation of Islam and the uprooting of infidel fiath….” আরবরা যে সকল অঞ্চল দখল করেছে, সেখানে কেবল ইসলামধর্ম প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি; সেইসব অঞ্চলের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে মুছে দিয়েছে। সিন্ধু-আক্রমণের ক্ষেত্রেও এই মানসিকতা বজায় ছিল। তাই দেবল বন্দরে জাহাজ লুণ্ঠনের ঘটনাটি ছিল তাদের সিন্ধু আক্রমণের তাৎক্ষণিক কারণ বা অজুহাত মাত্র।
মহম্মদ-বিন্-কাশিম প্রায় পনেরো হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীসহ সিন্ধু অভিমুখে রওনা হন। ‘মাকরানে’ তিনি উপস্থিত হলে সেখানকার শাসক মহম্মদ হারুন তাঁর বাহিনীসহ কাশিমের সাথে অগ্রসর হন। আব্দুল আসাদ জাহানের নেতৃত্বে সাহায্যকারী আরও একটি আরবীয় বাহিনী সিন্ধুর উপকূলে কাশিমের সাথে যোগ দেয়। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী সিন্ধু-আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে মহম্মদ-বিন্-কাশিম দেবলে উপস্থিত হন। সিন্ধুর রাজা দাহির তাঁর অদূরদর্শিতার বা আলস্যের জন্যই হোক্, কিংবা তাঁর গুপ্তচরবাহিনীর অপদার্থতার জন্যই হোক্, আরবীয়দের এই আক্রমণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন এবং দেবল রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ ছাড়াই রাজধানী আলোরে (বা আরোর) বসে থাকেন। মহম্মদ কাশিম মাত্র ৪ হাজার রক্ষীর দুর্বল প্রতিরোধ ভেঙে খুব সহজেই দেবল দখল করে নেন। রক্ষীরা আপ্রাণ বাধা দেয়, কিন্তু আরব বাহিনীর সংখ্যাধিক্য এবং জনৈক ব্রাহ্মণের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে দেবল নগরীর পতন ঘটে। মুসলমানরা নির্বিচারে হত্যা, লুঠতরাজ ও ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালায়। সতেরো বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত পুরুষকে হত্যা করা হয়। নারী ও শিশুদের পরিণত করা হয় দাসে। লুণ্ঠিত অর্থের এক-পঞ্চমাংশ হজ্জাজ মারফত উপঢৌকন হিসেবে প্রেরিত হয় খলিফার কাছে। এইভাবে দীর্ঘ ব্যর্থতার পর আরবগণ সিন্ধুর বিরুদ্ধে প্রবল সামরিক সাফল্য অর্জন করে। এবং এই সাফল্যের জন্য আরবীয়দের দক্ষতা যতটা না দায়ী ছিল, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী ছিল রাজা দাহিরের অপদার্থতা। শ্রীবাস্তব লিখেছেন: “Thus did the first important town of India fall in to the hands of the Arabs not due to any cowardice on the part of the Indian soliders, but owing to the lethargy of an Indian ruler.”
দেবলে একজন আরবীয় শাসক নিযুক্ত করে মহম্মদ-বিন্-কাশিম দেবলের উত্তর-পূর্বে ‘নিরুণ’ শহরের দিকে অগ্রসর হন। নিরুণের অধিবাসীরা, যাদের অধিকাংশই বৌদ্ধ এবং রাজা দাহিরের ওপর বীতশ্রদ্ধ, বিনাপ্রতিরোধে আরবদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। অতঃপর মহম্মদ-বিন্-কাশিম সিন্ধুর উপনদী ‘মিরান’ অতিক্রম করে ‘ব্রাহ্মণাবাদে’ অবস্থানকারী রাজা দাহিরের মুখোমুখি হওয়ার উদ্যোগ নেন। রাজা দাহির আর কালবিলম্ব না করে আরব-বাহিনীকে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিশাল হস্তীবাহিনীসহ রাজা দাহির স্বয়ং যুদ্ধে অংশ নেন। ইতিপূর্বে দেবলে আক্রমণকারীদের বাধা না দিয়ে দাহির একটি ভুল করেছিলেন; কিন্তু এখন স্বয়ং যুদ্ধে অংশ নিয়ে আর একটা মহাভুল করলেন। কারণ রাজা হিসেবে নিরাপদ শিবিরে থেকে সৈন্যদের নির্দেশ দিলেই তিনি ভালো করতেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলমান সৈন্যর আঘাতে তাঁর পতন ঘটার ফলে সমগ্র সিন্ধু-বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। দাহিরের মৃত্যুর পরেও তাঁর পত্নী রানীবাঈ এবং রাওর দুর্গের অন্যান্য অধিবাসীরা প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। কিন্তু আরবদের তীব্র আক্রমণের সামনে দাঁড়ানো তাঁদের পক্ষে ছিল নিতান্তই অসম্ভব। তাই অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মহিলারা নিজেদের মর্যাদা রক্ষা রেন। রাওর দুর্গের পতনের পর আরবীয়-বাহিনী ব্রাহ্মণাবাদ আক্রমণ করে। দাহিরের অন্যতম পুত্র জয়সিংহ কিছু বাধাদানের পর সাফল্য অসম্ভব বুঝতে পেরে চিতোরে পালিয়ে যান। এখানেও বহু মানুষ নিহত হন এবং লুণ্ঠিত হয় বহু ধনসম্পদ। এখান থেকেই মহম্মদ-বিন্-কাশিম দাহিরের অপর স্ত্রী রানী লাদি এবং দুই কন্যা সূর্যদেবী ও পরমলদেবীকে সংগ্রহ করেন। অতঃপর কাশিম সিন্ধুর রাজধানী আরোর এবং মুলতান দখল করেন এবং কনৌজের বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণের প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার মুহূর্তে খলিফা ওয়ালিদ মহম্মদ-বিন্-কাশিমের প্রাণদণ্ড দেন।
অভাবনীয় সাফল্য দ্বারা খলিফার মানমর্যাদা বৃদ্ধি করার পরেও মহম্মদ-বিন্-কাশিমের আকস্মিক প্রাণদণ্ডাদেশ কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক। এ সম্পর্কে দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়। প্রথম কারণটি রোমাঞ্চকর। মহম্মদ-বিন্-কাশিম দাহিরের কন্যাদ্বয় সূর্যদেবী ও পরমলদেবীকে বন্দি করে খলিফার কাছে পাঠিয়েছিলেন। পিতার হত্যাকারীকে চরম শাস্তি দেবার বাসনায় এঁরা খলিফার কাছে নালিশ করেন যে, মহম্মদ কাশিম তাঁদের মর্যাদা হানি করার পরে খলিফার কাছে পাঠিয়েছেন। এহেন ধৃষ্টতার সংবাদে ক্রুদ্ধ খলিফা ওয়ালিদ তৎক্ষণাৎ মহম্মদ-বিন-কাশিমের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন এবং তা কার্যকর করা হয়। অবশ্য কাশিমের প্রাণহীন দেহ দেখার পর দাহিরের কন্যারা স্বীকার করেন যে, তাঁদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক। খলিফা অতঃপর এঁদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। আধুনিক কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, এই কাহিনিটি অবাস্তব ও অতিরঞ্জিত। এঁদের মতে, কাশিমের মৃত্যুদণ্ড ছিল আরবের রাজনৈতিক ক্ষমতাদ্বন্দ্বের পরিণতি মাত্র। খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যুর (৭১৪ খ্রিঃ) পর খলিফা হন তাঁর ভাই সুলেমান। নতুন খলিফা ছিলেন হজ্জাজের ঘোর শত্রু। তাই ক্ষমতা দখল করার পর তিনি হজ্জাজের জ্ঞাতিভাই তথা জামাতা মহম্মদ-বিন-কাশিমকে পদচ্যুত করেন এবং বন্দিরূপে মেসোপটেমিয়ায় এনে নৃশংসভাবে হত্যা করেন (৭১৫ বা ৭১৬ খ্রিঃ)। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব মনে করেন, দ্বিতীয় কারণটিই বেশি নির্ভরযোগ্য। তাঁর ভাষায় : “The other account which ascribes Muhammad’s death of political reasons, is more worthy of credence.”
মহম্মদ-বিন্-কাশিমের সামরিক ও প্রশাসনিক প্রতিভা সিন্ধুদেশে আরবীয়দের যে প্রাধান্যের সূচনা করেছিল; তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই অবক্ষয়ের ছাপ দৃষ্ট হয়। মহম্মদ কাশিমের স্থলাভিষিক্ত এজিদ, হাবিব, জুনাইদ প্রমুখ প্রত্যেকেই ছিলেন অসম্পূর্ণ প্রশাসক। আরবীয় রাজনীতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে এঁরা কেউই সিন্ধুর বাস্তব পরিস্থিতি ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেননি। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ওমায়িদ বংশের পতন ঘটিয়ে আব্বাসিদ বংশ খলিফাপদ দখল করে সিন্ধুর শাসক পরিবর্তন করলে এখানেও গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। মুসলমানদের অন্তর্বিরোধ এবং ভারতীয় গোষ্ঠীগুলির ক্ষমতাদখলের নতুন উদ্যোগ সিন্ধুদেশে আরবীয় শাসনের দুর্বল ভিত্তিকে দুর্বলতর করে দেয়। সিন্ধুতে খলিফার কর্তৃত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায় এবং সিন্ধুর শাসকরা স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে শুরু করেন।
Leave a comment