জীবনকে দুঃখের তপস্যা বলার কারণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় জীবনকে ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা’ বলেছেন। কবির কাছে জীবন হল আঘাত সংঘাত, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সত্যকে উপলদ্ধি করা। সত্যের স্বরূপ অত্যন্ত কঠিন। সুখ এবং আনন্দকে অতিক্রম করে দুঃখের নির্মমতায় তার বিস্তার। সত্যকে পাওয়ার জন্য মানুষের যে সাধনা, তা অত্যন্ত কঠিন। তাকে উপলব্ধি করার জন্য কল্পনার সৌধ থেকে নেমে আসতে হয় বাস্তবের অমসৃণ জমিতে। ‘রক্তের অক্ষরে’ নিজের রূপ দেখতে পাওয়া যায়, নিজেকে চিনতে পারা যায় আঘাতে-বেদনায়। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে কবি সত্যের যে কঠিন স্বরূপ, তা চিনতে পারেন এবং সেই কঠিনকেই তিনি ভালােবাসেন। কারণ, সত্য কখনও বঞ্চনা করে না। সত্যের প্রতি এই আকর্ষণ এবং তার স্বরূপের যথার্থ উপলব্ধি থেকেই কবির মনে হয় জীবন হল ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা’।

কবিমনের বিবর্তনের ছবি : সত্যের যে উপলদ্ধিতে কবি পৌঁছেছেন তা আসলে কবিমনের এক স্পষ্ট বিবর্তনের ইঙ্গিত-কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের বুক্ষ জমিতে নেমে আসা। কবিতার সূচনাতেই তাই কবি লিখেছেন “রপনারানের কুলে/জেগে উঠিলাম,/জানিলাম এ জগৎ/স্বপ্ন নয়।” ‘রূপনারানের কুলে’ অর্থাৎ রুপময়, প্রবহমান জীবনকালের প্রান্তে উপনীত হয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর রূপ দেখে অশীতিপর কবি তাই নিরাবরণ, প্রত্যক্ষীভূত ও অনিবার্য সত্যকে ভালােবেসে গ্রহণ করেছেন। ত্যাগ করেছেন স্বপ্নচারিতাকে। কল্পনা থেকে সত্যের পথে কবিচেতনার বিবর্তন এভাবেই ফুটে উঠেছে।