“আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির দুর্জয়
জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি, পুরুষোত্তম সত্য”
– কবি মানব দানব এবং দেবতার ভয় কেন? নিজেকে চির দুর্জয় বলার কারণ কী? জগদীশ্বর ঈশ্বর বলতে কী বোঝায়? কবি নিজেকে পুরুষোত্তম বলেন কেন?

কবি যে ত্রিভুবনে ভীতি জাগিয়ে তুলেছেন সেকথা ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বার বার বলা হয়েছে। এই পৃথিবীতে কবির আবির্ভাব যে সাইক্লোনের মতো বিপর্যয়কারী, টর্পেডোর মতো অব্যর্থ এবং তিনি যে দাবানল দাহের মতো পৃথিবীকে দহন করতে পারেন—এসব কথা কবি আগে বলেছেন। তিনি এও বলেছেন, পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাব অত্যন্ত অশুভ মূর্তির মতো। তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন—

“আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি অশনি,

আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!”

সুতরাং পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি যে ভয়ংকর, তাকে অকারণ বলা যায় না।

কবি দানবদেরও ভয়ের কারণ। তাঁর রণহুংকার শুনলে এবং তাঁর বীভৎস উন্মত্ততা দেখলে দানবও ভয় পেয়ে যায়, কারণ এরকম প্রচণ্ডতার কথা তারাও চিন্তা করতে পারে না। কবির মূর্তি দেখে যে দানবশক্তিও ভয় পেতে পারে কবি সেকথা এই কবিতায় বেশ কয়েকবার বলেছেন। একবার কবি লিখেছেন— 

“আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার কলরোল-কল-কোলাহল।”

এমন কথাও কবি লিখেছেন যে তাঁর রুষ্ট মূর্তি দেখলে শাস্ত্রোক্ত নরক এবং মুসলমান ধর্মশাস্ত্র-কথিত নরকও ভয় পেয়ে যায়—

“আমি রুষে উঠি’ ঘবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,

ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিজে যায় কাঁপিয়া।”

কবি দানবের চেয়ে অনেক ভয়ংকর, কারণ তিনি হাসি মুখে ভয়ানক কাজ করতে পারেন। কবি বলেছেন—

“আমি জাহান্নমের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।”

কবিকে দেখে দেবতাদের ভয় পাওয়ারও সঙ্গত কারণ রয়েছে। কবি যে বিশ্ববিধাত্রীর বিদ্রোহী-সন্তান সেকথা তিনি ঘোষণা করেছেন। তাঁর অভ্যুদয় ঘটেছে যে বিধাতাকে অস্বীকার করবার জন্যই, সে আভাস কবিতার প্রারম্ভেই তিনি দিয়েছেন—

“ভূলোক দ্যুলোক, গোলোক ভেদিয়া, 

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া

উঠিয়াছি চিরবিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!”

কবি নিজের ধ্বংসাত্মক মূর্তির যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে দেবতাদেরও নিশ্চিন্ত থাকার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেছেন, ‘মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ’, তিনি লিখেছেন, ‘আমি বজ্র, তিনি এ-ও লিখেছেন—

“আমি পিনাক-পাণির ডমরুত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, 

আমি চক্র মহাশঙ্খ, আমি প্রণব নাদ-প্রচণ্ড!”

সুতরাং কবির উত্থান দেখে দেবতার মনে ভীতি জাগা অস্বাভাবিক নয়।

জগদীশ্বর ঈশ্বর বলতে বোঝায় দেবতার প্রভু। কবি যে কিছুই মানেন না, দেবতাকেও মেনে চলেন না একথা তিনি বলেছেন। কবিতার প্রথমে এরকম আভাসও আছে যে তাঁর মহিমা ঈশ্বরকেও ছাপিয়ে যাবে—সুতরাং কবি এখানে ‘জগদীশ্বর-ঈশ্বর’ বলতে দেবতার প্রভু হওয়ার কথা অর্থাৎ দেবতাকে পদানত করার কথা চিন্তা করে থাকতে পারেন। কিন্তু এখানে কবির শব্দ ব্যবহারে আর একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কবি যে সময় এই কবিতা রচনা করেন তখন ব্রিটিশরাজই প্রায় জগতের ঈশ্বর হয়ে বসেছিল, কারণ সমস্ত পৃথিবীময় তাদের রাজত্ব ছড়িয়ে ছিল। কবি এখানে জগদীশ্বর বলতে ব্রিটিশ জাতিকেও বুঝিয়ে থাকতে পারেন। কবি বোধহয় বলতে চান—মানুষের শক্তি যখন জেগে উঠেছে তখন তাকে আর রোধ করা যাবে না, শক্তিশালী ব্রিটিশকেও নতি স্বীকার করতে হবে।

কবি নিজেকে পুরষোত্তম বলেন খুব সাধারণ অর্থেই তিনি পুরুষ-শ্রেষ্ঠ—এই হিসাবে। মানুষকে জড় অবস্থা থেকে জাগ্রত করে তাদের প্রকৃত শক্তি সম্বন্ধে সচেতন করে তিনি বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছেন সুতরাং তিনি যে মানব-শ্রেষ্ঠ এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। কবি বোধহয় এখানে আর একটি কথাও দৃঢ়ভাবে বলতে চেয়েছেন—তিনি ত্রিভুবনে যতই ত্রাস সঞ্চার করে বেড়ান, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল তাঁর ভয়ে যতই প্রকম্পিত হোক, তিনি শক্তিতে উদ্বুদ্ধ এক প্রকৃত মানুষ, এই তাঁর প্রকৃত পরিচয়।