কবি এখানে বাতাসকে তার প্রকৃতি অনুযায়ীই তিনি ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং তার প্রকৃতি সুনিশ্চিতভাবে বোঝাবার জন্য তিনবার তিন নামে তাদের অভিহিত করেছেন।

উত্তরের বাতাস বা উত্তর বায়ু প্রবাহিত হয় শীতকালে। শীতকালের এই বাতাশ শুষ্ক এবং কঠোর, মানুষকে তা নিষ্ক্রিয় করে তোলে, স্থবির করে দেয়। এই বাতাস প্রাণের স্পর্শবর্জিত, রসকষহীন সন্ন্যাস জীবনের মতো এই বাতাস জীবনানন্দ বঞ্চিত। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে—

“উত্তর বায় জানায় শাসন, 

পাতলো তপের শুষ্ক আসন।”

মলয়-অনিল বা মলয় বাতাস বয় বসন্তকালে। কথিত আছে, বসন্তকালে যে বাতাস প্রবাহিত হয় তা আসে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে আছে চন্দন গাছ, তাই সেখান থেকে যে বাতাস আসে তা চন্দনের গন্ধে ভরপুর। এই বাতাসকেই বলে মলয় পবন বা মলয় বাতাস। এই হাওয়া অতি সুস্নিগ্ধ, মানুষের জীবনকে সে ভরিয়ে তোলে, তাকে প্রাণচঞ্চল করে তোলে। উত্তরের হাওয়ার একেবারে বিপরীত এটি—জাঢ্য নয়, অস্থিরতা এবং চাঞ্চল্যই এর লক্ষণ।

পূরবী হাওয়া বলতে কবি দুটি ব্যাপার বুঝিয়ে থাকতে পারেন। প্রথমত, পূর্বী হাওয়া বা পূর্বদিকের হাওয়া। বর্ষাকলে পূর্বদিক থেকে হাওয়া দেয়, রবীন্দ্রনাথের বর্ষার বহু গানে পূর্ব-বাতাসের উল্লেখ আছে। বর্ষাকালে মন উদাস হয়ে পড়ে, বহু স্মৃতি এবং বহু কথা রুদ্ধগৃহে বসে মনে পড়ে। বৈষ্ণব কবি বলেছেন—

“এ ভরা বাদর

মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।”

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

“মন মোর মেঘের সঙ্গী

উড়ে চলে দিক্‌দিগন্তের পানে।”

এছাড়া, অন্য একটি অর্থেও কবি ‘পূরবী হাওয়া’ কথাটি ব্যবহার করে থাকতে পারেন। সংগীত শাস্ত্র মতে পূরবী রাগিণী উদাস এবং বৈরাগ্যের ভাব প্রকাশ করে। ‘প্রতিনিধি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ জীবন সায়াহ্নে শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামীর সংগীত সম্পর্কে লিখেছেন—

“পূরবীতে ধরি তান   এক মনে রচি গান

গাহিতে লাগিলা রামদাস।”

উদাস পূরবী হাওয়া বলতে কবি হাওয়ার সেই বৈরাগ্যের মূর্তিটিও বুঝিয়ে থাকতে পারেন।

কবি নিজেকে যে এই তিন রকমের হাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তার বিশেষ তাৎপর্য আছে। কবির বিদ্রোহী সত্তায় যেসব রকম শক্তির সম্মিলন আছে, কবি সেকথা বার বার বলেছেন। কবি একথা বেশ জোর দিয়ে বলেছেন যে তাঁর ধ্বংসাত্মক শক্তি অতি প্রচণ্ড। অন্যত্র তিনি তাঁর যৌবনোন্মদ শক্তির অফুরন্ত চাঞ্চল্যের কথাও বলেছেন। আবার তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন বিখ্যাত মুনিঋষিদের সঙ্গে, তিনি এমন কথাও বলেছেন—

“মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।”

এই তিনটি আপাত-বিরোধী সত্তার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার জন্য কবি অনেক উপমা ও অভিন্নতা কল্পনা করেছেন। এখানেও সেই কারণেই তিনি তিন প্রকারের বাতাসের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা ঘোষণা করেছেন। এই তুলনাটি অপরূপ কাব্যসৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে পড়েছে, এই প্রসঙ্গে সেকথাও অবশ্য উল্লেখ করতে হবে।