আমির খসরু (১২৫৪-১৩২৫ খ্রিঃ):
সুলতানি আমলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন আমির খসরু। একাধারে কবি, ইতিহাসিবিদ ও অধ্যাত্মবাদী সাধক আমির খসরুর পিতা সৈফুদ্দিন ছিলেন তুরস্কের লাচিন উপজাতির নেতা। মোঙ্গলগণ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তিনি সপরিবারে দিল্লিতে সুলতান ইলতুৎমিসের কাছে আশ্রয় পান। পাটিয়ালি শহরে ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দে খসরুর জন্ম হয়। তাঁর মা ছিলেন বলবনের যুদ্ধমন্ত্রী, মূল্ক-এর কন্যা। মাত্র সাত বছর বয়সে খসরু পিতৃহীন হন। অবশ্য পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে তাঁর শিক্ষালাভে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। অতঃপর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অগ্রসর হয়। তখন দিল্লি শহর ছিল। একাধারে আলোক ও অন্ধকারের সমন্বয়ে এগিয়ে চলা এক জাদু-নগরী। মোঙ্গল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে যেমন মধ্য-এশিয়ার বহু পণ্ডিত, বিজ্ঞানী ও রাজনীতিকরা দিল্লিতে এসেছিলেন, তেমন এখানে জীবিকার সন্ধানে জড়ো হয়েছিল অসংখ্য ঠগ্, প্রতারক, জুয়াড়ি-বারাঙ্গনা ও দালাল শ্রেণির মানুষ। এই আলো-আঁধারিতে আলোকের পাল্লা ভারী করেছিল তৃতীয় একটি শক্তি। মহম্মদ হাবিবের ভাষায় : “এরই পাশাপাশি ঈশ্বর প্রেরিত প্রতিষেধকের মতো এসেছিলেন অসংখ্য সুফি ও ধর্মপ্রচারক, যাঁদের সর্বাত্মক প্রয়াসের ফলেই রাজধানী শেষ পর্যন্ত নরকে পরিণত হয়নি।”
সুফিসাধকের অতিন্দ্রীয়বাদ, দালাল শ্রেণির প্রতারণা ও মিথ্যাচার, রাজদরবারের কাঠিন্য, রহস্যময়তা ও বিলাস-বৈভব, নর্তকীর লাস্যময়তা অর্থাৎ সমাজদেহের প্রতিটি অংশ থেকে অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে খসরু হয়ে উঠেছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। কালি ও কলমের আঁচড়ে ভাবগম্ভীর বা আবেগ-বিহ্বল কাব্য রচনার পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারি চালনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার উদার মানবতাবাদী অধ্যাত্মদর্শন তত্ত্ব শোনার জন্য খসরুর হৃদয় যেমন আকুল হত, তেমনি আনন্দ উপভোগের হৈ-হুল্লোড়ে অংশ নিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে নেবার কাজেও তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন।
মধ্যযুগের রীতি অনুযায়ী সুদীর্ঘ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও পৃষ্ঠপোষকতার মধ্যেই খসরুর জীবন কেটেছে। রাজনীতির অঙ্গনে তিনি প্রথম প্রবেশ করেন ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রথম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ‘আমির-ই-হাজিব’ মহম্মদ কশলি খাঁ (মালিক চম্বু)। তাঁর শেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক। দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর ধরে তিনি দিল্লি-সুলতানির রাজনৈতিক উত্থান-পতন, ঘৃণা ভালোবাসা, ষড়যন্ত্র সংগঠন, সংকীর্ণতা উদারতা প্রত্যক্ষ করেছেন সামনে থেকে। মালিক চৰ্জ্জু’র উদারতা ও দানশীলতার কথা তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন তাঁর কবিতায় (কসিদা)। ভুল বোঝাবোঝির কারণে চঞ্জুর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। খসরু অতঃপর বলবনের পুত্র বুগরা খাঁ’র পৃষ্ঠপোষকতা পান। কিছুকালের মধ্যেই তিনি বলবনের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলতান মহম্মদের দৃষ্টিতে পড়েন। সুলতান মহম্মদ ছিলেন আদর্শ চরিত্রের মানুষ। নির্ভীক, সদাচারী, মার্জিত এই শাহাজাদার কাব্যপ্রীতি ছিল গভীর। আমির খসরুকে তিনি সুলতানে নিজের দরবারে নিয়ে যান। মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে আকস্মিক যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন সুলতান মহম্মদ (১২৮৫ খ্রিঃ)। এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে আমির খসরু মোঙ্গলদের হাতে বন্দি হন। মোঙ্গলদের অত্যাচার আর ক্ষুধাতৃষ্ণায় কিছুদিন কাটিয়ে সৌভাগ্যবশত কোনোক্রমে তাদের কবল থেকে পালিয়ে জীবনরক্ষা করেন।
প্রাণাধিক প্রিয়পুত্র মহম্মদের অকালমৃত্যুর সংবাদে সুলতান বলবনের শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ে এবং তিনিও মারা যান। দিল্লির রাজনীতিতে অস্থিরতা প্রকটিত হয়। আমির খসরু দিল্লির অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে সরে গিয়ে অযোধ্যার সুবাদার আমির আলি সরজন্দর-এর দরবারে আশ্রয় নেন। ‘হাতিম খাঁ’ নামে অধিক পরিচিত সরজন্দর ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অতি উদার ও দানশীল। খসরু তাঁকে সমুদ্রের থেকেও অধিক উদার বলে প্রশংসা করেছেন। দু-বছরের মধ্যেই মা’র আহ্বানে খসরু দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং সুলতান কাইকোবাদের দরবারে সভাকবি হিসেবে যোগ দেন। এই সময় তিনি প্রথম মসনভি ‘কিরণ-উস-সদাই’ রচনায় মনোনিবেশ করেন।
মাদকাসক্ত, উচ্ছৃঙ্খল ও অসুস্থ কাইকোবাদকে হত্যা করে জালালউদ্দিন খলজি ক্ষমতা দখল করলে (১২৯০ খ্রিঃ) দিল্লি-সুলতানির ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। এই পরিবর্তনে আমির খসরুর বিশেষ অসুবিধা হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত তুর্কি-আমিরদের সাথে যেমন তাঁর মিত্রতা ছিল, তেমনি জালালউদ্দিন খলজিও তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ হলেও জালালউদ্দিন ছিলেন প্রাণোচ্ছল ও সংস্কৃতিমনস্ক। তিনি আমির খসরুকে প্রধান সভাসদ-পদে নিয়োগ করেন। দরবারের নৃত্যগীতের উপযোগী অসংখ্য গজল এই সময় তিনি রচনা করেন। জালালকে হত্যা করে আলাউদ্দিন খলজি সিংহাসন দখল করলে খসরু যথারীতি তাঁর দরবারে স্থান পান। অবশ্য আলাউদ্দিন এই প্রতিভাবান কবিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। তবুও খসরু আলাউদ্দিনকে নায়ক করে এমন বহু কাসিদা লিখেছেন যা সুলতানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল। আলাউদ্দিনের কুড়ি বছরের শাসনকালেই খসরু সবথেকে বেশি সাহিত্য রচনা করেন।
সুফিসাধক শেখ নিজামউদ্দিন আওলিয়ার একান্ত গুণগ্রাহী ছিলেন আমির খসরু । আলাউদ্দিনের পুত্র ও উত্তরাধিকারী মুবারক শাহ খসরুকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথেই দরবারে স্থান দেন। কিন্তু শেখ নিজামউদ্দিনের সাথে মুবারকের সম্পর্ক মধুর ছিল না। সুলতান ও নিজামউদ্দিনের সংঘাতের মাঝেও খসরু উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পেরেছিলেন। আমির খসরুর শেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। মাত্র ছয় মাস আগে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন হজরত নিজামউদ্দিন। তাঁর কবরের পদতলে খসরুকে সমাধিস্থ করা হয়।
আমির খসরু অসংখ্য গজল, কাসিদা বা মসনভি এবং গদ্যসাহিত্য রচনা করেছেন। এদের মধ্যে অন্তত ছয়টি রচনায় ইতিহাসমূলক তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলি হল কিরান-উস্ সাদিন, মিফতা-উল-ফুতুহ, নুহ সিপহর এবং খাজাইন-উল-ফুতুহ। এদের মধ্যে প্রথম তিনটি কবিতার এবং শেষেরটি গদ্যাকারে রচিত। এগুলি বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণে সমৃদ্ধ। এ ছাড়া, ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রণে রচিত দুটি কাব্য হল ‘দেবলারানি খিজির খান’ ও ‘তুঘলকনামা’। এই ছয়টি বই মোটামুটিভাবে দিল্লি-সুলতানির প্রায় চল্লিশ বছরের (১২৮৫-১৩২৫ খ্রিঃ) সুসংবদ্ধ ও চিত্তাকর্ষক বিবরণ প্রদান করে। ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ গ্রন্থের বিশেষ ইতিহাসমূল্য আছে। এতে আলাউদ্দিন খলজির পনেরো বছরের ইতিহাস, বিশেষত যুদ্ধাভিযানের বিবরণ স্থান পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতে সুলতানের রাজনৈতিক কার্যাবলি এখানে সুসংবদ্ধভাবে পরিবেশিত হয়েছে।
অধ্যাপক মহম্মদ হাবিবের মতে, “বইটিতে লেখক প্রশংসনীয় নৈপুণ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সাজানো তথ্যসম্ভারের মাধ্যমে সমকালীন ইতিহাস বিকৃত করেছেন।” কিরান-উস্-সাদিন’ গ্রন্থ থেকে সুলতান বলবনের কনিষ্ঠ পুত্র লখনৌতির শাসক বুগরা খাঁ’র সঙ্গে তাঁর পুত্র তথা দিল্লির সুলতান কাইকোবাদের সম্পর্ক ও ভালোবাসার টানাপোড়েনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে রচিত “মিফতা উল-ফুতুহ্’ গ্রন্থে খসরু সুলতান জালালউদ্দিন খলজির যুদ্ধযাত্রার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। আলাউদ্দিনের পুত্র সুলতান মুবারক শাহ’র রাজত্বকালের প্রধান প্রধান ঘটনাকে ভিত্তি করে পদ্যায়িত ইতিহাস ‘নুহ সিপহর’ রচনা করেন। খসরু তাঁর শেষ ঐতিহাসিক মসনভি ‘তুঘলকনামা’ রচনা করেন তাঁর শেষ পৃষ্ঠপোষক গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। এখানে সুলতানের ক্ষমতালাভের প্রেক্ষাপট থেকে রাজ্যাভিষেকের বিবরণ স্থান পেয়েছে।
ইতিহাসকার হিসেবে আমির খসরু’র মূল্যায়নে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, খসরু প্রথমে একজন কবি, পরে ঐতিহাসিক। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল কাব্যমাধুর্য দ্বারা মানুষের হৃদয়কে শান্ত করা। কাব্যের বিষয়বস্তু হিসেবে ঐতিহাসিক ঘটনা স্থান পেয়েছে। মহম্মদ হাবিব বলেছেন, “আমির খসরু তাঁর রচনায় প্রায়ই দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি মূলত ঐতিহাসিক কিন্তু তাই বলে সভাকবি বা সভাসদ পদের দায়িত্বপালনে অবহেলা করেননি।” বস্তুত খসরুর জীবনে ও মননে তিনটি সত্তা উপস্থিত ছিল— ঐতিহাসিক, সভাকবি ও অমাত্য।
কে. এম. আশরাফ-এর মতে, “খসরু তাঁর পাণ্ডিত্যাভিমান কিংবা ঐতিহাসিকের উন্নাসিকতা নিয়ে দরবারের উচ্চমহলে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি; কিংবা আবুল ফজলের মতো তাত্ত্বিক নির্লিপ্ততাভিত্তিক ইতিহাস রচনার কাছে নিজেকে বেঁধে রাখেননি। তিনি জনগণের মাঝ থেকেই উঠে এসেছেন এবং জনতার মধ্যে থেকেই তিনি নিজেকে খুঁজে পেতেন।”
খসরুর রচনার বিশেষত্ব হল যে, তিনি পাঠকের কাছে কিছুই গোপন রাখতে চাননি। সাহিত্যসৃষ্টির কাজে তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের অবদান এবং তাঁর নিজের দায়বদ্ধতা তিনি স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন। দিল্লি সুলতানির অস্থির ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে থেকে ঐতিহাসিকের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার কাজ আদৌ সহজ ছিল না। পৃষ্ঠপোষকদের জন্য ভিত্তিহীন প্রশস্তিগাথা রচনা করতে তিনি কষ্টও পেতেন। প্রকৃত সত্য লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি বিকল্প পথ খুঁজেছেন।
কাউয়েল (Cowell) বলেছেন যে, “আমির খসরুর রচনা অলংকার ও উপমায় ভারাক্রান্ত। আসলে জটিল বাক্যসম্ভার ছিল তাঁর বিকল্প পথ। সহজ-সরল বোধগম্য ভাষার পরিবর্তে তিনি বিচক্ষণতার সাথে পাশ-কাটানো তির্যক শব্দসম্ভার প্রয়োগ করে ক্ষমতাশালী প্রভুর প্রতি দায়বদ্ধতা এবং বাস্তব ঘটনার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে প্রয়াসী হয়েছেন।” খসরু’র সাহিত্যপ্রতিভার প্রশংসা করে সেকাল ও একালের দুটি অভিমত স্মরণ করা যায়।
জিয়াউদ্দিন বারাণী তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহিতে লিখেছেন, “রচনার প্রাচুর্য ও আদর্শের মৌলিকতার দিক থেকে আমির খসরু তুলনাহীন। কাব্যের সমস্ত শাখায় এমন বুৎপন্ন মনীষা অতীতে কখনো দেখা যায়নি এবং কেয়ামতের সেই দিনটির আগে হয়তো আর আসবেও না।” এ-কালের বিদগ্ধ সমালোচক ও ইতিহাসবিদ শিবলি নোমানী লিখেছেন যে, “তাঁর মতো (খসরু) এত ব্যাপক পারদর্শিতা নিয়ে গত ছশো বছরে ভারতবর্ষে কেউ জন্মায়নি, এমনকি পারস্যের উর্বর ভূমিতেও মাত্র তিন বা চারজন তুল্যব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেছেন গত সহস্রবর্ষে।”
Leave a comment