বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেম, ধর্ম চেতনা, রুচিবোধ, সংযম, নীতিজ্ঞান, সংস্কার আকাঙ্ক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছিল মানবপ্রীতি ও সাহিত্যপ্রীতি। তাঁর সকল বক্তব্যের মূলে যে সূক্ষ্ম সংবেদনশীল হৃদয়টি তা সৎ ও সত্যচারী। দেশের মানুষকে তিনি নিজ অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন, তাদের সুখ দুঃখে ছোটোগুণে বিচলিত হতেন। তাঁর এই নিভৃত ব্যথিত ঘনিষ্ঠ মনেরই প্রতীক কমলাকান্ত, যিনি বলেন : ‘সুখের কাথায় বাঙালির অধিকার নেই—কিন্তু দুঃখের কথায় আছে। আবার, ‘প্রীতি সর্বব্যাপিনী প্রীতিই ঈশ্বর। মনুষ্যৎ প্রীতি ব্যতিত মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য উপায় নেই। এই মনেরই প্রকাশ ঘটেছে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর বিবিধ রচনায়। কমলাকান্ত এই বিষয়টি ভাবুকতার সঙ্গে উপস্থাপিত করেছেন, হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে পাঠককে গুরুগম্ভীর বিষয়ে উপনীত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মতে, বাংলা সাহিত্যে ‘নির্মল শুভ্র সংযত হাস্যরস’ বঙ্কিমই সর্বপ্রথম আনয়ন করেছিলেন। সেই কান্না ভেজানো হাসির বিচিত্র রূপ ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর বিষয় গম্ভীর, কিন্তু বাগভঙ্গি লঘু। এতে ব্যঙ্গ আছে, বিদ্রুপ আছে, বাগবৈদগ্ধ্য আছে; সবার ওপর আছে ‘হিউমার’—হাসিকান্নার গঙ্গা যমুনা সংগম। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তকে পাগল সাজালেন কেন? তার কারণ ? বঙ্কিমচন্দ্র দেখেছেন চারিদিকেই চলেছে নিরুঙ্কুশ ভ্রান্তিবিলাস; সকলে যাকে ‘সোজা রাস্তা’ মনে করছে, তিনি দেখেছেন, তা বাঁকা রাস্তা। এটা মনুষ্যত্বের পথ নয়। সুতরাং তাঁর উক্তি সাধারণের নিকট পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী ? তা ছাড়া পাগলের ভান করলে অনেক বাঁকা কথা সোজা করে বলা যায়, যা সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ভদ্রতা ও সৌজন্যের কোনো বাঁধনই পাগলের কাছে কেহ-আশা করে না; সুতরাং মন খুলে সব কথাই অকপটে ব্যক্ত করা যায়। কিন্তু এ পাগল তো গম্ভীর সুরে কথা ও বলে ; তবে গুরু বিষয়ের এমন লঘু প্রকাশ কেন ? তার কারণ—সত্য কথা কঠিন করে বললে কেহ শোনে না, উপদেশে কেহ কর্ণপাত করে না। হালকা করে বললে সকলে কান পাতে। হাসির প্রলেপ দিয়ে কঠিন কথা শুনালে তা মনে গভীর ভাবে দাগ কাটে। তাই কলমাকান্ত হাসির মাধ্যমে বাঙালিকে কাঁদাতে চেয়েছেন এবং ঠিক এই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের বড়ো বড়ো চরিত্র অপেক্ষা কমলাকান্তের চরিত্র বাঙালি পাঠকের কাছে অনেক প্রিয়তর।
‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর এই বৈশিষ্ট্যগুলি পাঠ্য ‘আমার মন’ প্রবন্ধে সহজলভ্য। লঘু গুরুর সংমিশ্রণে রচনাটি হাস্যরসের আবর্ত সৃষ্টি করে, অথচ গাম্ভীর্য বিন্দুমাত্র কমে না।
প্রবন্ধটির মূলবেদী—স্বজাতিপ্রীতি। দেশের মানুষ বাহ্যসম্পদে আকৃষ্ট হয়ে স্বার্থপরতা শিক্ষা করেছে, এবং যথার্থ সুখ বিসর্জন দিচ্ছে—এটাই বঙ্কিমচন্দ্রের মূখ্য বক্তব্য। মন হারানোর অর্থই হল সুখের অভাব। কিন্তু একথাটি প্রথমে বললেন না। তিনি সু-কৌশলে এমন কাব্যিক রীতিকে আরম্ভ করলেন, পড়ামাত্র পাঠকের মন এক অনিবার্য আকর্ষণ বোধ করল। সে হয়তো ভাবল—মন আবার হারায় নাকি ? আচ্ছা, দেখি, লেখক কী বলেন।
লেখক বললেন, কিন্তু প্রত্যক্ষ নয়, পরক্ষোভাবে প্রায় গল্পের আকারে এবং সরস ভঙ্গিতে পাকশালা—গোহালঘর ঘুরে আসলেন ; তারপর পথে কাল্পনিক যুবতীর সঙ্গে নাটকীয় সাক্ষাৎকার ও বিচিত্র সংলাপ। পাঠকের মনটি মধুতে ভ্রমরের মতো আবদ্ধ হয়ে গেল। অতঃপর মূল বক্তব্যটি সোজাসুজি আসরে উপস্থিত করলেন অনেকটা প্রবন্ধের আকারে—আত্মসুখ, বাহ্য সম্পদ সুখের সেতু নয়, পরার্থে জীবনদানেই সুখ। অথচ নব্য সভ্যতায় অভীভূত বাঙালি (তথা ভারতবাসী) এ শিক্ষা বিস্তৃত হয়ে অর্থালালসায় মেতে উঠেছে, নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছেন। কমলাকান্ত তাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন—এপথ মনুষ্যত্বের পথ নয়। এমনকি সংসারের আপনজনদের মধ্যে ভালোবাসাকে সীমাবদ্ধ করে রাখাও মানুষের ধর্ম নয়। মানব প্রেমের গণ্ডি বাড়াতে হবে, বিশ্বজনকে আপন করতে শিখতে হবে, তবেই মনে, সুখ, শান্তি স্থায়ী হবে। অন্তিমে একটি হাস্যরসাত্মক বাক্য দিয়ে প্রবন্ধ শেষ হয়েছে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন : প্রবন্ধের প্রথম ভাগে যে কবিতা, গল্প ও নাটকীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, তা কি কেবলমাত্র পাঠকের মন ভোলাবার জন্য? সেটা কি কুইনিনের সুগার কোটিং? না, এই আপাত লঘু অংশের মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আছে। বস্তুত পাকশালা প্রসন্ন প্রীতি, যুবতী সুদর্শন প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা, প্রবন্ধের রীতিবৈচিত্র্য বিশেষ। তারপর বাহ্য-সম্পদের প্রতি অনুরাগ জীবনের সুখতত্ত্ব প্রভৃতি গুরু বিষয় আলোচিত হলেও ভাবে ও ভঙ্গিতে হাস্যরস প্রধান পূর্বাংশের বিসদৃশ হয়নি। কারণ, গুরুতর বিষয়গুলি যুক্তিসংযত তত্ত্বের বিবৃতির রূপলাভ করেনি। তা ভাবরসে সিক্ত হয়েছে, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের দ্বারা রমণীয় হয়েছে। বাহ্য সম্পদের প্রতি লেখকের এই রমণীয় বক্তোক্তি তাঁর গোয়ালিনী ও গাভীর প্রসঙ্গে আনীত হাস্যরস অপেক্ষা কম আকর্ষণীয় নহে—‘কোথা ভাই ই উটিলেটেরিয়ান কামার। পঁটো হাড়িকাঠে–ফেলেছি ; একবার বাবা পঞ্চানন্দের নাম করে এক কোপে পাচার করো। কমলাকান্ত দাঁড়িয়ে আছে, মুড়িটি দাও। এই চিত্তকর্ষক ভঙ্গিই উভয় অংশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করেছে। তাছাড়া সর্বত্র ভাবাবেগ ও কবিত্বের প্রবাহ ও বর্তমান রয়েছে।
ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণ এবং সুখ ভোগচ্ছার প্রতি বঙ্কিমচন্দ্র যে তীব্র কটাক্ষ করেছেন এবং মানবপ্রীতিত্ব সে পথ নির্দেশ দিয়েছেন তাতে অবশ্য রচনাটি গৌরবমণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু ভাব মিশিয়ে চিত্তাকর্ষক করে না বলে তার মূল্য এরূপ বর্ধিত হত কিনা সন্দেহ। বস্তুত কমলাকান্তের মধ্য দিয়ে রসিক ও শিক্ষক বঙ্কিমচন্দ্রের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। লঘু ও গুরু বিষয় মিশে একটা অখণ্ড সাহিত্যিক রচনায় পরিণত হয়েছে। এই তিন স্তরকে ভিত্তি করে তিনি স্বজাতি সম্পর্কে মূলকথাটি পেশ করেছেন। প্রবন্ধের দ্বিতীয় ভাগে ভঙ্গিটি আর লঘু নেই ঠিকই, কিন্তু এরও চরণে চরণে লঘু বাক্যের নূপুর ধ্বনি যত্রতত্র বেজে উঠেছে। অর্থাৎ গুরুলঘুর প্রথম ভাগে হালকা সুরের প্রাধান্য, দ্বিতীয় ভাগে গাম্ভীর্যের। সমস্ত অংশ মিলিয়ে তবে বঙ্কিমের বক্তব্যকে হৃদয় গ্রহণ করতে হবে।
Leave a comment