১২৯৯ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘সাধনা’ পত্রিকায় ‘একরাত্রি’ ছোটোগল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই ছোট্ট গল্পে রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। মানব জীবনের এক গভীরতর বিরহ বিষণ্ণতার পরিণতি মুহূর্তে এই বিশেষ ঋতুর একটা ভূমিকা থেকে গেছে। শিলাইদহ পর্বে পদ্মার উপর বোটে করে ঘুরে বেড়াবার সময় রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। এখানকার নিস্তরঙ্গ নির্জন নদীবক্ষে পাণ্ডুর বালুকা, জনহীন প্রান্তর, তৃণহীন রুক্ষ প্রকৃতিকে যেমন প্রত্যক্ষ করেছিলেন তেমনি বর্ষায় পরিপূর্ণা ধৌবিনবর্তী নদীকে প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। এইসব খণ্ড খণ্ড রহস্যময় প্রকৃতির মধ্য দিয়ে মানব জীবনকে উপলব্ধি করার মতো মানসিক প্রস্তুতি তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল। লোকালয়ের ছোটো ছোটো চলতি দৃশ্যগুলি কল্পনার দ্বারা ভরাট করে একটা পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি মেতে ওঠেন, সেখানে প্রকৃতি ও মানব দ্বৈরথ সমরে নেমে এসে একটা বিচিত্র ভাবের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে অপূর্ব শিল্প সুষমা। ‘একরাত্রি’ ছোটোগল্পটি তারই প্রতিভূ ।

গল্পের শুরুতেই কথকের সঙ্গে নায়িকা সুরবালার মধ্যেকার সম্পর্ক কী তা আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে উঠেছে। দুজনে একই পাঠশালার পড়ুয়া, বউ বউ খেলা, কারণে অকারণে ঝগড়া ঝাটি। সুরবালার উপর কথকের শাসন, উপদ্রব লেগেই থাকত। অর্থাৎ সুরবালার চেয়ে কথকের দাবি সেখানে মুখ্য হয়ে উঠত। কথক লিখেছেন—“আমি কেবল জানিতাম, সুরবালা আমার প্রভুত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এজন্য সে আমার বিশেষরূপ অবহেলার পাত্র।” এই উক্তির মধ্য দিয়ে গল্পের সূচনা অংশে ছোটো একটা ইঙ্গিতের পর তা ক্রম পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। কৈশোরের এই অবজ্ঞা মিশ্রিত ব্যবহার ক্রমেই তা সুরবালার প্রতি কথকের প্রেমের একটা সুষম সেতু নির্মাণ করে দেয়। অর্থাৎ একটা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে গল্পের দ্বারোদ্ঘাটন হলে পরে তা প্রেমের মধ্য দিয়ে একটা বিষণ্নময় পরিস্থিতে সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। এখানেই ছোটোগল্পের অনন্যতা সূচিত হয়েছে।

জমিদারের নায়েব অর্থাৎ কথকের পিতার লক্ষ্য ছিল পুত্রকে গোমস্তাগিরিতে নিযুক্ত করবে। কিন্তু কথকের বাসনা জজ আদালতে হেড ক্লার্ক হবে। আবার কখনো বা ভাবে দেশপ্রেমী হয়ে দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবে। “ম্যাটসিনী গারিবল্ডী হইবার আয়োজন করিতে লাগিলাম।” কিন্তু এই সময় বড়ো একটা বাধা পেতে হল তাকে— “এমন সময় আমার পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হইয়া সুরবালার সহিত আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হইলেন।” কিন্তু সুরবালার প্রতি কথকের অবজ্ঞা উন্নাসিকতা থাকায় বোধহয় তিনি এ বিবাহে রাজি হননি। সাগ্রহে ঘোষণা করলেন—“বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না।” বিবাহ য্যোগ্যা কন্যাকে কতদিন বা পিতৃগৃহে রাখতে পারে। তাই সুরবালার বাবা আর কালবিলম্ব না করে সদ্য পাস করা উকিল রামলোচনবাবুর সঙ্গে সুরবালার বিবাহ দিয়ে দেন। এ সংবাদ কথকের কাছে এসে পৌঁছালে অনুশোচনার পরিবর্তে—“পতিত ভারতের চাঁদা আদায় কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল।” বুদ্ধি ও আবেগের তাড়নায় হৃদয়ের সহজাত বৃত্তিকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফল যে কী বিষম কথক পরে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে।

পিতার অকাল মৃত্যুতে ‘ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা দেবার সুযোগ হল না কথকের। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হল। অবশেষে ছোটো শহর নোয়াখালিতে একটা এন্ট্রান্স স্কুলে সেকেন্ড মাস্টারী পদে চাকরী পেয়ে গেলেন। প্রথম থেকে ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানান কর্মসূচি কথক গ্রহণ করলে হেড মাস্টারমশাই বাদ সাধলেন। কারণ, স্কুলে ছাত্রদের পরীক্ষার কথা ভাবাই জরুরি, তাই হতোদ্দ্যম হয়ে কথককে থামতে হল। স্কুল সংলগ্ন একটা বাড়িতে কথকের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সমস্ত স্বপ্ন পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র ছাত্র পড়ানো নিয়ে কথক ব্যস্ত। সেই সময় ঘটে গেল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা—“এখানকার সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের বাসা, আমাদের স্কুল ঘরের অনতি দূরে। এবং তাহার সঙ্গে তাঁহার স্ত্রী আমার বাল্য সাথী সুরবালা ছিল তাহা আমার জানা ছিল।” এখান থেকেই শুরু হল গল্পে পটপরিবর্তন। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকতে হয় কথকের শেষ কথার জন্যে।

অচিরেই রামলোচনবাবুর সঙ্গে প্রথমে আলাপ সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ অতঃপর আত্মীয়তায় পর্যবসিত হল উভয়ের সম্পর্ক। উভয়ের আড্ডা বসত ছুটির দিনে রামলোচনবাবুর বাড়িতে। আলোচ্য বিষয় ছিল ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতি। কিন্তু আলোচনার মধ্যেই কথকের ভাবান্তর ঘটে। – “দু’খানি চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল—বিশ্বাস সরলতা এবং শৈশব প্রীতিতে ঢল ঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ কালো কালো তারা, ঘন কৃষ্ণ পল্লব, স্থির স্নিগ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃদপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টন্ টন্ করিয়া উঠিল। মানুষ বুঝি সবথেকে বড়ো অচেনা তার নিজের কাছেই, কথক কি কখনো ভেবেছিল একদিন যে সুরবালাকে অবহেলা ভরে ত্যাগ করেছিল সেই সুরবালার জন্য আজ তার মনটা কেমন করে উঠবে। একি মনুষ্য—

“বিদায় করেছো যারে নয়নের জলে। (মায়ার খেলা)

এখন কি বারে তারে কীসের জলে।”-হ্যাঁ

জীবনে অভিশাপ মাত্রা—“যাহাকে ইচ্ছা করিলে পাইতে পারিত, এখন মাথা মুড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না।” কথক মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছে—দীর্ঘ অদর্শনেও সুরবালা এখন তার প্রতিটি মজ্জায় রক্ত মাংসে মিশে আছে। এটাই বোধ করি মানুষের অবচেতন মনের স্বরূপ। তাইতো নিজের কৃতকর্মকে দোষারোপ করে কথক অনুশোচনার সুরে বলেছেন—“মনুষ্য সমাজ একটা জটিল ভ্রমের , ঠিক সময় ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না, তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক জাল, বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।।”

বুদ্ধি ও আবেগের তাড়নায় হৃদয়ের স্বতোৎসারিত প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করে কথক যে মহা ভুল করেছিল তা নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে বিরহের বহ্নিজ্বালা নিয়ে অভিশাপ রূপে তার বুকে আঘাত করেছে। বিশ্বের নির্মমই হয়তো তাই—অবজ্ঞা করা মানুষের জন্য প্রাণ কেঁদে মরে। এই একরাত্রি গল্পে ও কোথাও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রামলোচনবাবু মোকদ্দমার কাজে কিছু দিনের জন্য বাইরে গেলে কোনও এক সোমবার সারা আকাশ জুড়ে প্রবল বেগে ঝড় বইতে লাগল। সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। দিন গড়িয়ে রাত এল। তবুও ঝড় বৃষ্টির বিরাম নেই। এই বীভৎস দুর্যোগের রাতে সুরবালা একা ঘরে আছে ভেবে কথক কেমন বিচলিত হয়ে পড়ল না জানি সে কত কষ্টে আছে। গভীর রাতে প্রবল বান ডেকে সমুদ্র যখন উথাল পাথাল, কথক কী একটা অদৃশ্য আকর্ষণে ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন—মাথার উপরে মুহুর্মুহূ বজ্রনির্ঘোষ, অবিশ্রান্ত বারিপাত, কোনও শংকা সেই।

“আজি ঝরের রাতে তোমার অভিসার। 

পরান সখা বন্ধু হে আমার।”

হাঁটতে হাঁটতে প্লাবিত স্থান দিয়ে যখন পুকুর পাড়ে উঠে দাঁড়ালেন তখন দৃষ্ট হল আর একজন অপরদিক থেকে সেই পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।—“আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে কেবল হাত পাঁচ-ছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম।” এ যেন সেই দুজনে মুখোমুখী.. ……..অনুভব, কত বিস্মৃত, বিমূঢ়, চোখের সামনে অবিশ্বাস্য জিনিস প্রত্যক্ষ করল—“সুরবালা একাকিনী আমার পার্শ্বে আসিয়া উপনীত হইয়াছে।” বিধাতার কী রহস্যময় লীলা, যে সুরবালা শৈশব হতেই কথকের সান্নিধ্যে উপনীত হয়েছিল তাকে অবজ্ঞাবশত না গ্রহণ করে দূরে চলে গিয়েছিল। মাঝে দীর্ঘ বিচ্ছেদ, তারপর কী একটা অমোঘ আকর্ষণে সেই সুরবালা কথকের সম্মুখে বিরাজমান, এ ‘আগমন তো আসন্ন মৃত্যু স্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক মিলনের আস্বাদ অনুভব। এরই সুরে সুর মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—

“পাড়ি দিতে যদি হাল ভাঙে যদি ছিন্নপাশে কাছি।

মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব—তুমি আছ আমি আছি।”

বিচ্ছেদের বেদনাকাতর অনুবভকে দূরে সরিয়ে দিয়ে মুহূর্তের আনন্দে একাত্ম হয়ে যাবার প্রবল বাসনায় কথক আকুল ও আচ্ছন্ন, পৃথিবীর সমাজ বন্ধনকে অস্বীকার করা তার কাছে অসাধ্য কিছু নয়। তাই এই একরাত্রির অভিজ্ঞতা অনুপম আনন্দময় অনুভূতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে আপন অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে কথক বলেছেন—“না বহিলে যারে পাওয়া যায় বেশ গিলে আসে হাতে।

দিবসে সেধন হাবাভেছি/পেয়েছি আঁধারে রাতে ।।” “আমি এই একরাত্রি মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।” গল্পে তিলতিল করে গড়ে তোলা হয়েছিল যে বিষাদময় জগৎ সমাপ্তি অংশে এক উজ্জ্বল আন্নদময় অনুভূতিতে পর্যবসিত হয়ে কথক তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। যদিও রাত্রি শেষে সুরবালা কোনও কথা না বলে বিদায় নিয়েছে এবং কথকও নিজের গৃহে ফিরে এসেছ তথাপি উভয়ের মধ্যেকার আত্মীক আকর্ষণ যে কৌশলে বর্ণিত হয়েছে তাতে সুরবালা কিংবা কথকের মহত্বই প্রমাণিত হয়েছে। কোনও কাঙ্ক্ষিতকে পাওয়ার চেয়ে খুঁজে বেড়ানোই যে বড়ো আকর্ষণীয় এবং মধুময় তারও প্রমাণ মেলে। তাইতো কথক স্বীকারও করেছেন—“ভাবিলাম আমি নাজির ও হই নাই, সেরেস্তাদার হই নাই, গারিবল্ডীও হই নাই, আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্ত রাত্রির উদয় হইয়াছিল— আমার পরমাণুর সমস্ত দিন-রাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই—আমার তুচ্ছ জীবনের চরম সার্থকতা।”

পরিশেষে বলতে হয়, বাল্যকালের সম্পর্ক সূত্র ছিন্ন করে লেখক যাকে অবজ্ঞা করেছিল, বাবার আদেশ অমান্য করে যাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করেছিল সেই-ই উত্তরকালে বিধাতার অশঙ্কু বিধানে এক ঝড় বৃষ্টির রাত্রে সুপ্ত বাসনার তাগিদে তারই-ই কাছে ছুটে গিয়েছিল। কেবল মাত্র এটা সম্ভব হয়েছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য। বোধহয় প্রকৃতির এই প্রবল দুর্যোগই সামাজিক সমস্ত শর্ত, বিধিনিষেধ এক পলকেই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, তার ফলে বক্তার মনে যে আনন্দ আর খুশির ফোয়ারা ছুটে ছিল এক বাদ্যে তা বলা যায় সেটাই গল্পের মূল বিশেষত্ব। তবে একথা ভুললে চলবে না আনন্দ অনুভূতির নেপথ্যে রয়েছে কিন্তু বিষাদের এক সুষম বেড়াজাল। বৈপরীত্যময় অনুভূতির আকর্ষণ বিকর্ষণের মধ্যে দিয়ে অপূর্ব সুষমায় গল্পটি ব্যঞ্জিত হয়েছে।