‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ কবিতাটির নামকরণ
অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ কবিতাটির নামকরণে উঠে এসেছে কবিতারই মধ্যে ধ্রুবপদের মতো উচ্চারিত একটি পক্তির ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ। কবির প্রার্থিত বার্তা যদি শিরোনামের মধ্যে আভাসিত হয়ে উঠবে প্রত্যাশা করা হয় এবং সেই প্রত্যাশা পূরণকেই যদি নামকরণের সার্থকতার নিরিখ ধরা হয়, তবে বলতে হবে, অমিতাভ দাশগুপ্তের এই কবিতাটির নামকরণ সর্বাংশে সার্থক হয়েছে।
‘আমি তোমাদেরই লোক’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’ কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের বিশিষ্ট দেশচেতনার পরিচয়। তাঁর এই ভারত পরিচয় কোনো কবিসুলভ ভাববিলাস নয়। একদিকে মার্কসবাদ ও কমিউনিমজমে দীক্ষা, অন্যদিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা তাঁর মনে বুনে দিয়েছে মানুষকে ভালোবাসার বীজ। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে, সমস্ত ভারতবর্ষের শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের কাছাকাছি থাকার সুবাদে তিনি প্রতিনিয়ত দেখেছেন তাদের জীবনসংগ্রাম। তাদের কান্না-ঘাম-রক্তের মূল্যে প্রগতি ও উন্নয়নের প্রবাহ। আর সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই জন্ম দিয়েছে তাঁর স্বদেশবোধ এবং ভারত-পরিচয়।
লক্ষণীয়, অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিতাটিতে কিছুটা রূপান্তরিত চেহারায় বারংবার ধ্রুবপদের মতো উচ্চারিত হয়ে শিরোনামে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিটি। শিরোনামে আছে ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’। কিন্তু কবিতাটিতে তিনবার উচ্চারিত—’তার নাম ভারতবর্ষ। অর্থাৎ কবিতার অভ্যন্তরে ভারতবর্ষ বিবেচিত হয়েছে প্রথম পুরুষ হিসাবে, কিন্তু কবিতার শিরোনামে ‘ভারতবর্ষ’ হয়ে উঠেছে উত্তমপুরুষ আমি। এই রূপান্তর ও বিবর্তনের স্বরূপটির মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার নামকরণের প্রকৃত তাৎপর্য ও সার্থকতা।
মনে রাখতে হবে, অমিতাভ দাশগুপ্তের ভারতবর্ষ উনিশ শতকের ভারতমাতার কোনো দেবীসুলভ মূর্তি নয় কিংবা রাজনৈতিক রেখাচিহ্নিত কোনো ভূখণ্ডও নয়। রবীন্দ্রনাথ যে কথা অনুভব করেছিলেন একদা, বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, অমিতাভ দাশগুপ্তও তেমনিভাবেই অনুভব করেন তাঁর স্বদেশ বা তাঁর ভারতবর্ষ মানে দেশেরই মানুষ। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে মার্কসীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কমিউনিজমে দীক্ষিত কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের কাছে ভারতবর্ষ আসলে শ্রমজীবী মানুষের ঘামরক্তে গড়া মাটি, যুগযুগান্তরের শ্রমের মূল্যে গড়ে তোলা তার ক্রম ইতিহাস, প্রতিবাদী শ্রমিকের গুলি খাওয়া বুকের রক্তে অঙ্কিত তার মানচিত্র।
ঊনিশ শতকের স্বদেশ ভাবনার ভাববাদী ধারার সঙ্গে অমিতাভ দাশগুপ্তের স্বদেশচেতনা তাই স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন মেরুবর্তী। তবে এহেন দেশচেতনা একেবারেই ঐতিহ্যবিচ্যুত নয়। কেননা উনিশ শতকেই রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করেছিলেন এই ধরনের স্বদেশ চিন্তা, যেখানে মানুষই স্বদেশের যথার্থ পরিচয় বহন করে। রবীন্দ্রনাথই জানিয়েছিলেন রাজন্যবর্গের উত্থানপতনের ইতিহাস কোনো দেশের ইতিহাস নয়। যারা চিরকাল দাঁড় টানে, হাল ধরে, মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকাধান কাটে, যারা রাস্তা গড়ে প্রাসাদ মিনার নির্মাণ করে সেই মেহনতী মানুষই দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ করে (‘ওরা কাজ করে’ কবিতা)। পরবর্তীকালে বিশ শতকেই কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ভারতবর্ষকে চিনেছেন লক্ষ কোটি নিরন্ন মানুষের ঘাম ও ক্ষুধার চিহ্নে (‘আমার ভারতবর্ষ’ কবিতা)। কিন্তু ঐতিহ্যসূত্র একটা থাকলেও অমিতাভ দাশগুপ্তের স্বদেশভাবনায় একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক মাত্রা আছে। তিনি ভারতের লক্ষকোটি শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রাম ও শোষক মুনাফালোভী মালিক-মহাজন এবং তাদের নিরাপত্তা প্রদানকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী শ্রমজীবীর রক্ত-ঘামের মধ্যেই দেখতে পান তাঁর ভারতবর্ষকে।
তবে এদিক থেকে দেখতে গেলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতোই এ কবিতার নামও হতে পারত ‘আমার ভারতবর্ষ’। কিন্তু তা হয়নি। সচেতনভাবেই কবি নিজ ব্যক্তিঅহংকে নিঃশেষে বিসর্জন দিয়েছেন। কবির দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের পরিচয় জ্ঞাপন অমিতাভ দাশগুপ্তের অভিপ্রেত ছিল না।
কবি অগ্রসর হয়েছেন একান্তভাবেই শ্রমজীবী সংগ্রামীর নিরিখ থেকে ভারতবর্ষের পরিচয় দিতে। যে সংগ্রামী প্রতিবাদী শ্রমিকের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্টেনগান, সেই রক্তচিহ্নই ভারতবর্ষের মানচিত্র বলে প্রতিভাত হয় কবির কাছে। কিন্তু সেটি কবি নিজ ব্যক্তিগত অনুভব হিসাবে ঘোষণা করেন না, ‘আমার’ শব্দে ধ্বনিত হয়। আত্মদানকারী শ্রমিকটিরই কণ্ঠস্বর—
“স্টেনগানের বুলেটে বুলেটে
আমার ঝাঁঝরা বুকের ওপর ফুটে উঠেছে যে মানচিত্র
তার নাম ভারতবর্ষ।”
এমনকি চা বাগিচা, কফি খেত, কয়লা খাদান, পাহাড়-অরণ্য, কিংবা ভাকরা-নাঙালের বাঁধ অথবা ডিগবয়ের তৈলখনি এলাকার সমস্ত মেহনতী শ্রমিক-কৃষকের ঘাম-রক্তে যে সভ্যতার ভিত্তি গড়ে হয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসের যে বিন্যাস রচিত হয় পরম শ্রমের মমতায়, শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়— ‘তার নাম ভারতবর্ষ।
যে ভারতবর্ষের ইতিহাস কৃষকের হাড়ের ফসফেটে বা শ্রমিকের রক্তে উর্বরা হয়, তাদের সম্মিলিত ঘামের সিঞ্জনে যে বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং ক্রমে পরিণত হয় ধান ও গানের স্বপ্নে, সেই সম্মিলিত শ্রম ও শ্রমচোরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে গিয়ে আত্মদানকারী শ্রমিক কৃষকের রক্তেই রচিত হয় ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভারতবর্ষের মানচিত্র। তাই এই শ্রমদানকারী ও আত্মদানকারী মেহনতী মানুষ আর ভারতবর্ষ সমার্থক হয়ে যায়। তাই কবিতার প্রথমাংশ থেকে শহীদ বীর শ্রমিকের আত্মা ‘তার নাম ভারতবর্ষ’ বলে স্বদেশকে চিহ্নিত করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিজেই ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে। কবিতার অস্তিমে এসে আমরা শুনতে পাই এই উপলব্ধির পরিণাম—
“যার ছেঁড়া হাত, ফাঁসা জঠর, উপড়ে আসা কলজে,
ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, রক্ত, ঘাম,
মাইল মাইল অভিমান আর ভালোবাসার নাম
স্বদেশ
স্বাধীনতা
ভারতবর্ষ।”
এই শ্রমজীবী মানুষের অশ্রু রক্ত ঘাম আর ভালোবাসা তাই পরিশেষে এসে মেলে ভারতবর্ষের সঙ্গে। শ্রমজীবীর অস্তিত্ব ও স্বদেশবোধ সেখানে একাকার হয়ে যায়। ফলে কবিতাটির নামকরণ ‘আমার নাম ভারতবর্ষ সর্বাংশে সার্থক।
Leave a comment