নজরুলের ‘সর্বহারা কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা ‘আমার কৈফিয়ৎ’। কবিতাটির এরূপ নামকরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আদালতে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। নজরুল এই কবিতায় নিজের কাব্যসাধনার স্বরূপ বর্ণনা করে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলির জবাব দিয়েছেন।
‘কৈফিয়ৎ’ শব্দের অর্থ হল অভিযুক্ত ব্যক্তির জবানবন্দী। কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে তাঁর কাব্যসাধনার শুরু থেকেই নানাদিক থেকে অভিযোগ বর্ষিত হয়েছিল। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী কবিতা রচনার পর থেকেই শনিবারের চিঠি, ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পণ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা নজরুলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকে। বিশেষ করে শনিবারের চিঠি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কাব্যমূল্যকে নস্যাৎ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ও আরও অনেক ব্যঙ্গাত্মক প্যারেডি রচনা করে কবিকে কঠোর আক্রমণ করেন। কবি মোহিতলাল মজুমদারও এতে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে নজরুল হিন্দু মহিলা প্রমীলাদেবীকে বিয়ে করলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আঘাত আসে।
১৯২৫ সালের জুন মাসে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস মারা গেলে নজরুল ‘ইন্দ্ৰপতন’ নামে বিখ্যাত কবিতা লেখেন। দেশবন্ধুকে হিন্দু-মুসমলানের নেতা বললে মোসলেম দর্পণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে গালিগালাজ করতে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ ছিল। কংগ্রেসের সদস্যপদ তিনি গ্রহণ করেন। স্বরাজপার্টির সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। আবার সন্ত্রাসবাসী বিপ্লবীদের প্রতিও তাঁর সহানুভূতি ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শে নজরুল কোপন্থী তা স্থির করতে না পেরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁকে কটু মন্তব্য করতে থাকে।
নজরুল গোঁড়া মুসমলান ছিলেন না। হিন্দুর পৌরাণিক দেবদেবীর নানা প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় এসে গেছে। ব্যক্তিগত আচার-আচরণে নজরুল কিছুটা হিন্দুপন্থী ছিলেন। সেজন্য মুসলিমরা তাঁর প্রতি ছিল খড়্গহস্ত। নজরুল নারী ও পুরুষের সমান সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় বারাঙ্গনাকেও নারীত্ব ও মাতৃত্বের মূল্যবোধে উন্নীত করতে প্রয়াসী হন। সেজন্য কেউ কেউ তাঁকে নারীঘেঁষা, নারীপিয়াসী কবি বলে মন্তব্য করেন।
‘মাধবী প্রলাপ’ ও ‘অনামিকা’ কবিতা দুটিতে প্রেমের নগ্নরূপ-কামনাতুর সুতীব্র সম্ভোগ তৃষ্মার অভিব্যক্তি ঘটায় নজরুলকে কামাতুর কবি বলে কঠোর মস্তব্য করেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহিতলাল মজুমদার। কবিতায় মাংসলোলুপতার নারী শুধু মাংসপিণ্ড হয়ে উঠেছে এবং নজরুলকে Pan-মৈথুন ist বলে নির্মম মন্তব্য করা হয়। আসলে এই দুটি কবিতায় নজরুল প্রেমকে সর্বসংস্কার মুক্ত দেহাত্মক, ভোগপিপাসার অবেগ প্রতপ্ত কাব্যরূপ দান করেছেন। এককথায় নজরুলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক মতবাদ এবং কাব্যদর্শের জন্যে নজরুলের উপর নানা দিক থেকে নানাপ্রকার অভিযোগ, বিদ্রূপ, ব্যঙ্গের প্রচণ্ড আক্রমণই আসে। নজরুল আশ্চর্য সংযমও ধী-শক্তি বলে সেই সব অভিযোগকে আত্মসাৎ করে নিজের বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন ‘আমার কৈফিয়ৎ’-শীর্ষক কবিতায়।
নজরুল স্থির অবিচলিত চিত্তে বিরাট বটবৃক্ষের মতো সমস্ত অভিযোগকে আত্মস্থ করে একের পর এক তার জবাব দিয়েছেন এবং নিজের কাব্যসাধনার অন্তনির্হিত অভিপ্রায়কে বলিষ্ঠভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি হুগলিতে রচিত হয়। প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকার ১৩৯২-এর ‘আশ্বিন’ সংখ্যায়। পর এটি ‘সর্বহারা’ গ্রন্থে সংকলিত হয়।
নজরুল সমসাময়িক বাস্তব জীবনের দোষগুণকে অকপটে প্রকাশ করেন। তিনি মুক্তমনের কবি—বাস্তব জীবনের উপর কল্পনার রঙ চড়ান না। দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষের দুর্দশা, পরাধীনতার জ্বালা তাঁকে অস্থির অসাস্ত করে তোলে। ভদ্রমুখোশধারী সভ্য ও উন্নত মানুষের বর্বরতা এবং ভণ্ডামির আবরণ উন্মোচন করে প্রকৃত নির্মম সত্যকে উদ্ঘাটন করতে তিনি প্রয়াসী। অন্যায় অবিচার অত্যাচার ও অসাম্যবৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর বীণায় বেজে উঠে রৌদ্ররাগিণী। তিনি সর্ব ধর্ম সম্প্রদায় ও জাতিভেদের ঊর্ধ্বে মানবতার পূজারী—মানুষের মুক্তিদাতা। শোষণ, লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্যের দুর্দশা দূর করে এক সুন্দর সাম্যের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে তাঁর কবিধর্মের প্রবণতা। নজরুল বিদ্রোহের কবি, বীর রসের কবি। ‘আমার কৈফিয়ৎ’-কবিতার কাব্য সাধনার সেই মূলগত প্রেরণার দিকে লক্ষ্য রেখেই কবি বিরুদ্ধ পক্ষের সমস্ত অভিযোগের জবাব দিয়েছেন।
লক্ষিতব্য বিষয় এই যে নজরুল আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে সমস্ত অভিযোগগুলিকে সরল মধুর হাস্যরসে জবাব দিয়েছেন। এই কবিতাটিতে নজরুলের আত্মদর্শনের চমৎকার অভিব্যক্তি ঘটেছে। বিরুদ্ধ পক্ষের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি স্বধর্মে গভীরভাবে আস্তাবান ও অটল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও দুর্দশায় কবি বেদনাহত। লাঞ্ছিত অপমানিত অত্যাচারিত মানুষ তাঁক প্রতিবাদী বিপ্লবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করিয়েছেন। আক্রমণের তিনি জবাব দিয়েছেন উপহাসছলে। সেই সমস্ত উপহাসে ব্যঙ্গ থাকলেও তা তিক্ত নয়, মধুর। পাঠক প্রাণভরে সে উপহাস উপভোগ করে। এই কবিতাটি হাল্কাচালে ও সরসভঙ্গিতে রচিত। কিন্তু তার মধ্যে নজরুলের বলিষ্ঠ কবি-আত্মা দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে অলঙ্কার প্রয়োগে, চিত্রকল্পসৃষ্টিতে, দেশজ শব্দ প্রয়োগে, ধ্বনিরোলের স্বচ্ছন্দ প্রবাহে ও হাস্যরসের অনাবিল উৎসাহে কবিতাটি হীরকদ্যুতি বিকীর্ণ করেছে। এখানে নজরুল ভাবভাবনায় সুপরিমিত-আবেগ উচ্ছ্বাসে সুনিয়ন্ত্রিত। সর্বোপরি আর্টের নৈর্ব্যক্তিকতার দিক থেকেই কবিতাটি অনন্য। এখানে কবির ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সার্বজনীন ভাবভূমিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
Leave a comment