নজরুল ইসলামের জীবনাদর্শের সমালোচনা করে শনিবারের চিঠি, ইসলাম দর্শন ও মোসলে দর্পণ প্রভৃতি পত্রিকায় যে সমস্ত নজরুল বিরোধী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় তার প্রত্যুত্তর হিসাবে ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ১৩৩২ বঙ্গাব্দে আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে আলোচ্য কবিতাটি নজরুলের সর্বহারা কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়। মূলত সর্বহারা কাব্যগ্রন্থের সর্বাপেক্ষা উদ্দীপনা মূলক কবিতা ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি যে কৈফিয়ৎ দিয়েছেন তা কেবল তাঁর সমালোচনার জবাব নয়। আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় কবির যে কৈফিয়ৎ তা দেশ কাল সমাজের কাছে স্পষ্ট ও নির্ভীক ভাষায় বিবৃত। আত্মসমীক্ষামূলক এ কবিতায় কবি নিজের জীবন দর্শন প্রকাশ করেছেন—তাই এ কবিতা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কবিতার শুরুতেই নজরুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন যে তিনি অমরত্ব চান না তিনি যুগপ্রয়োজন মেটাতেই লেখনীকে তরবারির মতো ব্যবহার করেছেন—
“বর্তমানের কবি ভাই আমি ভবিষ্যতের নই নবী।
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুঝে তাই সই সবি।”
এর পরে কবি একের পর এক তাঁর বিরুদ্ধে জমে ওঠা অভিযোগগুলি উত্থাপন করেছেন।
সমাজের একদল মানুষ কবির কবিতায় শাশ্বত চিরন্তন বাণী খুঁজে পায়নি, তাই তারা কবির কাব্য করিবার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করেছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নজরুলের কবিতা ঠাঁই পাবে না। কেননা রবীন্দ্রনাথের মতো শাশ্বতকালের বাণী নজরুলের কবিতার মধ্যে তাঁরা খুঁজে পাননি, সেইজন্য হয়তো তারা নজরুলের কাব্য কবিতার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন—
কেহ বলে তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে।
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকালের বাণী কই কবি ?
কবির কাব্যকবিতা পড়ে বন্ধুরাও হতাশ হয়ে পড়েছে, তারাও কবির কাব্য কবিতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। কবির প্রতি তারাও আস্থা হারিয়েছে। হয়তো রবীন্দ্রনাথে মতো তারাও কবির কাছে শাশ্বতকালের বাণীময় কাব্য কবিতা পাওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু কবি তাদের সেই আশা পূরণ করতে পারেননি। এই জন্য কবির বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ। কেউ কেউ বলে উঠলেন কবিতার মাধ্যমে সমসাময়িক রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। যার জন্য তিনি মহৎ কাব্য রচনা করতে পারেননি। আর একদল বলে উঠেছেন পড়াশোনা সব ছেড়ে দিয়ে এখন রাজনীতি আখড়ায় তিনি ঘুরে বেড়ান।
“বলে কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশঠেলে
পড়েনাক বই বয়ে গেছে ওটা।”
নজরুল নার্গিস বেগমকে ভালোবাসতেন। হঠাৎ তাদের ভালোবাসার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। এরপরে তিনি গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন। তখন হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। নজরুল জাতিতে মুসলমান ছিলেন। তাই হিন্দুরাও তাকে ভালো চোখে দেখেনি। মুসলিমরা তাকে জাতিচ্যুত করতে চেয়েছিলেন। কবি বন্ধুরাও রীতিমত ব্যক্তি আক্রমণে নেমে পড়লেন। কবির কাছে তাদের অভিযোগ যে, তিনি বিবাহ করার পর ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা না লিখে ‘প্রেমের গৌঁজো সুর’ ধরেছেন। তারা ভেবেছেন বিবাহের পরেই নজরুলের কবিত্ব শক্তি নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে। তাই বলতে দ্বিধা বোধ করেনি—“বৌ এ গিলিয়াছে গোটা।”
নজরুল ‘আগমনীর আগমনে’ কবিতা রচনা করে রাজদ্রোহী অভিযুক্ত হন। রচনা শেষ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হল। শুধু রচনাটি বাজেয়াপ্ত হয়নি, তার সঙ্গে কবির বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হলেন, কিন্তু জেলেও বিদ্রোহ থেমে যায়নি, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ রচনার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের সুর ছড়িয়ে ছিলেন। রাজরোষ তার উপর আরও বেড়ে গেল। ১৯২০ সালে ১৫ জানুয়ারি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন-হোর বিচারে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবি বন্ধুরা জেলে যাওয়ার ঘটনা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা ভাবতে শুরু করেছেন, কেউ কেউ অনুমান করেছেন হয়তো রাজনীতি করতে গিয়ে কবিকে জেল হাজতে যেতে হয়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন জেল হাজতে বসে বসে তাস খেলে দিন কাটাচ্ছেন, কেউ বা কবিকে ফের জেলে যাওয়ার জন্য বলেছেন—
“কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো
ফের যেন তুই যাস জেলে।
শুধু বন্ধুদের কাছে নয় স্বয়ং গুরুদেবের কাছ থেকেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এসেছে। গুরুদেব নজরুলের কাব্য কবিতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট নয়—তাই বলেছেন—
“গুরু’কর্ম তুই করেছিস শুরু
তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা।”
কবিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে জর্জরিত করেছিল সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদক হলেন সজনীকান্ত দাস। তিনি কবিকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে কবিতা প্রকাশ করতে লাগলেন, তিনি ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় নজরুলের কবিতার সমালোচনা করতেন। কবির কবিতা নিয়ে নানা অভিযোগও তুলেছিলেন। নজরুল জাতিতে ছিলেন মুসলমান কিন্তু মুসলিম হয়ে বিয়ে করেছিলেন এক হিন্দুর মেয়েকে। যার জন্য হিন্দুরাও তাঁর বিরুদ্ধে এনেছে অভিযোগ। কবি সে কথা বলতে দ্বিধা করেননি—
“হিন্দুরা ভাবে, ফার্সি শব্দে
কবিতা লেখে ও পাত নেড়ে।”
কবি জাতিতে মুসলমান, তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও কবির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। তাদের প্রধান অভিযোগ তিনি নাকি হামেশায় কাব্য কবিতায় হিন্দুর দেবদেবীর নাম উচ্চারণ করে থাকেন।
“দেব দেবীর নাম মুখে আনে
সবে দাও পাজিটার জাতি মেরে।”
তারা সমাজ থেকে কবিকে জাতিচ্যুত করতে চেয়েছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের কাছেও কবি অভিযোগ শুনেছেন সশস্ত্রবাদী বিপ্লবীরা কবিকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ কবি চরকার প্রশান্তি গান করে কবিতা লিখেছেন—
‘এটা অহিংস, বিপ্লবী ভাবে,
নয় চরকার গান কেন গাবে।
আবার অহিংসাবাদী বিপ্লবীরাও কবিকে তাদের দলের লোক বলে মেনে নিতে পারেননি। কেননা তার মনে করেছেন তিনিই বিপ্লবের ইন্ধন জুগিয়েছেন। সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষপাতী বলে তারা কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। স্বরাজবাদীরাও কবির বিরুদ্ধে অভিযোগের বাণ হেনেছেন, তেমনি নৈরাজ্যবাদীরাও কবিকে বিশ্বাস করতে পারেননি, উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে কেউই কবিকে আপন বলে মেনে নিতে পারেননি। তাদের অভিযোগ সম্পর্কে কবিও ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই বলে উঠেছেন—
“স্ববাজীরা ভাবে নারাজী,
নারাজীরা ভাবে তাদের অংকুশি।”
সর্বোপরি আলোচ্য কবিতায় তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কোনো সম্প্রদায় বা জাতির কবি নন। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের কবি। হিন্দু-মুসলমান সকলেই তার ভাই। হিন্দু-মুসলিম কোনো ধর্মের আচার-আচরণের প্রতি তাঁর অনীহা নেই। তিনি মানবতাবাদী, উদার মানব ধর্মে ছিল তার বিশ্বাস। আর সেই জন্যেই দীপ্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন—হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগন তলের সীমাহারা মুক্তির মাঠে দাঁড়াইয়া—মানব তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি। বল দেখি, আমার মানুষ ধর্ম। দেখিবে দশদিকে সার্ব্বভৌমিক খাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে।” এই হল নজরুলের মানস ধর্ম।
Leave a comment