কাজী নজরুল ইসলাম জন্মসূত্রে ছিলেন মুসলমান কিন্তু ধর্মের গোঁড়ামি কবিকে কখনই আশ্রয় করেনি। কৈশোরে তাঁর কবি জীবনের হাতেখড়ি পর্বে যখন লেটোর দলে বা কবির দলে গান বাঁধতেন তখন একই সঙ্গে ইসলামী শাস্ত্রকথা এবং রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি হিন্দু পুরাণকথা তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। পরবর্তীকালেও যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত কবি তখনও কবির ভাবনাকে হিন্দু ও ইসলামী নানা প্রসঙ্গ বারেবারে স্বচ্ছ করেছে। তিনি নির্বিচারে কবিতার ভাষায় তৎসম, তদ্ভব শব্দের সঙ্গে আরবী ও ফার্সী শব্দকে ব্যবহার করেছেন। ধর্মান্ধ, গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতা যে কবির মানসিকতায় ছিল না, তার প্রমাণ কবির বহু রচনায় ছড়িয়ে আছে। এই অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও মিথ্যা জাতবিচারকে তিনি ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ বলেই মনে করতেন।

‘আমার কৈফিয়ৎ’ মূলতঃ কবি সম্পর্কে সেকালে আলোচিত বিভিন্ন অভিযোগেরই কৈফিয়ৎ। এখানে শুধু সাম্প্রদায়িকতার কথা এককভাবে আসেনি। এসেছে অন্যান্য আলোচনার প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়ি প্রসঙ্গও। কবি নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান, এককভাবে কোনো সম্প্রদায়ের লোক বলেই মনে করেন না। হিন্দু বা মুসলমানরাও কবিকে নিজেদের লোক বলে মনে করেন না। কবি বলছেন, মুসলমান হয়ে তিনি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছেন এইজন্য হিন্দুগণ তাঁর ওপরে ক্ষুব্ধ। উপরন্তু কবিতায় অত্যধিক আরবী ফার্সী শব্দের প্রয়োগ দেখে হিন্দুরা নজরুলকে ‘পাতি নেড়ে’ বলেই মনে করেন। অপরদিকে মুসলমান মৌলবী মোল্লার দলও কবির প্রতি তুষ্ট নন। কারণ নজরুলের কবিতায় হিন্দু দেব-দেবীর উল্লেখ ও হিন্দু পুরাণ প্রসঙ্গ এসেছে সুপ্রচুরভাবেই। তাই নজরুলকে এরা বিধর্মী কাফের বলেই চিহ্নিত করতে চান। করতে চান নজরুলকে জাতিচ্যুত। কবি নিজেও বুঝতে পারেন না, তিনি হিন্দু না মুসলমান। নিজের শরীরে হিন্দুর টিকি বা মুসমানের দাড়ির চিহ্ন খুঁজে বেড়ান। নিজের বেশভূষার দিকে ফিরে তাকান।

মানসিকতার দিক দিয়ে কবি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। তাঁর জাতি মানবজাতি এবং ধর্মে তিনি মানবতাবাদী। তাই হিন্দুর আচার-আচরণেও যেমন তাঁর অরুচি নেই, তেমনি মুসলমানের জীবনাচরণেও তাঁর অনীহা নেই। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই তাঁর ভাই। তিনি বাঙালী এবং সর্বোপরি তিনি মানুষ। অবশ্য কবির এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের কথা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ প্রভৃতি কবিতায় যত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে এখানে তত স্পষ্ট নয়। কারণ এই কবিতার পরিপ্রেক্ষিত আলাদা। তবু লঘু ব্যঙ্গের সুরে দেওয়া কবির কৈফিয়তের মধ্যে কবি মনোভাব, তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানসিকতাও জাতপাতের ঊর্ধ্বে উদার মনোভাব চাপা থাকে না।