বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম কর্ণধার হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাই সাহিত্যে উত্তরাধিকারের সন্ধান কবির প্রধান কর্তব্য। কারণ সাহিত্য দেশ, কাল ও সমাজের প্রেক্ষিতে রচিত হয়। প্রতি দেশের সাহিত্যে তার পুরাতন ধারার বিবর্তনে বিবর্তিত হয়ে নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কালে কালে এর রূপ বদলায়, এর মধ্যে ঐতিহাসিক কারণ যদি ঘটে, তবে সাহিত্যের উপপ্লব সূচিত হয়। মধ্য যুগে তুর্কি—বিজয়োত্তর বিপর্যয়ে সমাজে যে উত্থান পতন শুরু হয়, তাতে আর্য-অনার্য সংঘর্ষ ও সমন্বয় হয়। অনার্য ধারা সাহিত্যে দেশজ ধারা হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলা সাহিত্যে তুর্কি বিজয়ের পর থেকে অনার্য-গোষ্ঠীর পূজিত ব্রত কথা-ছাড়া-মঙ্গলকাব্য ক্রমে ক্রমে প্রবল হয়। চৈতন্য যুগে পৌরাণিক উত্থানের ফলে এই ধারার সমন্বয় হয়। পৌরাণিক ও লৌকিকের সমন্বয়ে বাংলা মঙ্গলকাব্য তার সাহিত্যিক রূপে স্থিরীকৃত হয়, বাংলা মঙ্গলকাব্য সৃষ্টি বৈশ্বব পদাবলি ও বৈশ্ববেতর আখ্যান কাব্যে বা পাঁচালি কাব্যে, রোমান্টিক ও দেশজ কাব্যের ধারা লক্ষ করা যায়। রামায়ণ মহাভারত—ভাগবতের চর্চায় পৌরাণিক সংস্কৃতির অধ্যায় যেমন প্রবল ভাবে দেখা দেয়, তেমনি লৌকিক আততির স্রোত-এ বহমান হয়। লেখক বলেছেন—’চণ্ডীকাব্যে, মঙ্গলকাব্যে এমনকি বৈষ্ণব পদাবলিতে এই স্বাস্থ্য আমাদের আশ্চর্য লাগে। এই মনোবৃত্তির ফলে দেবদেবীর প্রতি মানুষের মহিমা আরোপিত হয়, সদাগরদের নাকাল করো এই উত্তরাধিকার যে আবিষ্কার করাই সব সাহিত্য ভাবুকদের পক্ষে প্রধান কাজ, এই উৎসকে জানতে গেলে ঈশ্বর গুপ্তকে বুঝতে হবে। ব্রিটিশপূর্ব শিল্প সাহিত্যের উৎস দেশের ঐতিহ্যে সুপ্ত আছে। সেই সুপ্ত ঐতিহ্যকে আবিষ্কার করেই ঈশ্বর গুপ্ত কবির কাব্যচর্চা সার্থক হবে।
বাংলা কাব্য সাহিত্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে যখন আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল তখন দেশীয় উত্তরাধিকার বহন করে তার জয় পতাকা উড়িয়ে ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। তাঁর কাব্যে দেশজ মনোবৃত্তির মলো আভাস প্রত্যক্ষ করে বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্তকে বলেছিলেন ‘বাংলার কবি’। প্রাবন্ধিক বিষ্ণু দে এ সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে ঈশ্বর গুপ্তের কবি প্রতিভার মধ্যে ইংরেজিতে যাকে মানবিকতা বলে তাঁর সমন্বয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর গুপ্তের ঐতিহ্য সচেতনতাকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছিলেন— “গত শতাব্দীর কণ্ঠকিত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঈশ্বর গুপ্ত এই ঐতিহ্য রসাধার এক দিক পাল। সেখানে তার কাজ শুধু উপভোগ্য লেখা নয়, তাঁর সাহিত্য জীবন রূপকও বটে। পুরাতন ঐতিহ্যে বাধা তাঁর লেখনী নতুন সমাজের পটে যে আঁচর কেটেছিল সেটাই বিস্ময়কর ঘটনা।”
এই বিষয় থেকে ঈশ্বর গুপ্তকে আমাদের সাহিত্যিক উত্তরাধিকার আবিষ্কারের তাঁর রচনা বিচার করা প্রয়োজন।
ঈশ্বর গুপ্তের বস্তুনিষ্ট মনোভাব তাঁর বাস্তবধর্মী কাব্যে ফুটে উঠেছে। ‘আনারস’, ‘তপসে মাছ’ ‘ছাগল’ প্রভৃতি বস্তুধর্মী কবিতা। ‘তপসে মাছ’ বা ‘পাঠা’ কিছুতেই এ বস্তুবাদীর আপত্তি নেই। “ছাগল’ পদ্যে কবি বলেছেন—
‘রসভরা রসময় রসের ছাগল।
তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।”
‘আনারসকে’ কবির মনে হয়—
“বন হতে এল এক টিয়ে মনোহর।
সোনার টোপর শোভে মাথার ওপর।।
এই পদ্যে আনারসের বর্ণনা বস্তুবাদী কবিতার বর্ণনা। প্রকৃত মনের বাস্তুবিকতাতেই কবির সহানুভূতিরূপ পায়—
‘কিছুদিন মা! দয়াকরি রপ্তানিটা বন্ধ রাখো,
ধনেপ্রাণে হল বাঙালি ৷
ভাত বিনে বাঁচিনে, আমরা ভেতো বাঙালি,
চাল দিয়ে মা বাঁচাও প্রাণে চালের জাহাজ চেলো নাকো।।
কবি সামাজিক সমস্যার প্রশ্ন জানেন, কিন্তু উত্তর জানেন না। তাই ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে কবির ভরসা—
‘ওগো মা ভিক্টোরিয়া
করগো মানা ; যত তোর রাঙা ছেলে আর যেন মা
চোখ রাঙে না চোখ রাঙে না।।
দেশজ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বিধবা বিবাহকে পছন্দ করেন না। স্ত্রীশিক্ষাও তাঁর কাছে আদর্শ শিক্ষা নয়। তাঁর ব্যঙ্গ তাই ক্ষুরধার হয়ে ওঠে—
‘বিবিজান চ’লেযান লবেজান ক’রে।
শাড়ি পরা এলোচুল আমাদের মেম
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্।
সিন্দুরের বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি”
‘নসী, মসী, ক্ষেমী, রামী, যামী, শামী, গুল্কি।
‘পৌষ পার্বণ’ দেশজ জীবনের বিরাট উৎসব, সেই উৎসবে কবি উৎসাহী, আজকের কবিকুলকে দেশজ জীবনের ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা বলতে হবে। এই সমস্যার পথে ঈশ্বর গুপ্ত নতুন দিশা। দেশজ উত্তরাধিকারকে জানতে পারলে কবিদের কাব্যকৃতি সার্থক হবে। এই বোধকে উত্তরাধীকারীর জন্য ব্যাপ্ত করার জন্য ঈশ্বর গুপ্তের বিশেষ মর্যাদা। বঙ্কিমচন্দ্র গুপ্ত কবির প্রতিভাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে রসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে গুপ্ত কবির যথার্থ বিচার সম্ভব হয়েছে। ঈশ্বর গুপ্তকে ‘খাঁটি বাংলার’ কবি বলে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর দেশজ উত্তরাধিকারের কথা বলেছেন। এই দেশজ উত্তরাধিকার না থাকলে ঈশ্বরগুপ্তের ঐতিহাসিক বিচার সম্ভব নয়। তাই প্রাবন্ধিকের অনুসরণে বঙ্কিম কথিত ‘রিয়ালিজম’—যা বাংলা কাব্যের আধুনিকতার ও ধারক।
Leave a comment