দক্ষ আমলা দরকার:
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব হল বর্তমান বিশ্বের একটি সর্বজনস্বীকৃত রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ। এখনকার এই সমস্ত কল্যাণরাষ্ট্রে যোগ্য-বিজ্ঞ এবং দক্ষ ও উৎসাহী স্থায়ী সরকারী কর্মচারী অপরিহার্য। সরকারের স্থায়ী কর্মচারীদের গুণগত যোগ্যতা ও দক্ষতা উপযুক্ত মানমাফিক হওয়া দরকার। তা না হলে রাষ্ট্রের সমাজকল্যাণকর বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচীকে যথাযথভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে না। আমলাদের কর্মদক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। সাধারণত শিক্ষাদীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক বিচারে সমাজের প্রতিপত্তিশালী অংশ থেকেই অধিকাংশ পদস্থ আমলারা নিযুক্ত হন। এঁরা হলেন সমাজের বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী। এই বক্তব্য অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে সত্য। আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার অসম বণ্টনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী অংশের মধ্যেই প্রশাসনিক নিয়োগের সুবিধা সীমাবদ্ধ থাকে।
আমলাদের সামাজিক পটভূমি আলোচনা করা আবশ্যক:
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের কাজকর্মের পরিধি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তারফলে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাদের বিশেষত উচ্চপদস্থ আমলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এঁরাই আড়ালে থেকে সরকারের নীতি নির্ধারণে সাহায্য করেন। এবং এঁদের তত্ত্বাবধানেই সরকারের নীতি বাস্তবে রূপায়িত হয়। তাই বর্তমান সমাজকল্যাণমূলক সরকারের সাফল্য বহুলাংশে উচ্চপদস্থ আমলাদের নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আবার এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষণশীল হবে, না প্রগতিশীল হবে তা অনেকাংশে এঁদের সামাজিক পটভূমি বা সামাজিক উৎসের উপর নির্ভরশীল। উচ্চপদস্থ আমলাদের ভূমিকা আর্থ-সামাজিক কার্যকারণের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। এই কারণে আমলাদের সামাজিক পটভূমি আলোচনা করা আবশ্যক। অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The social background of higher civil servants is important for a number of reasons.” অধ্যাপক বল এ ক্ষেত্রে তিনটি কারণ দেখিয়েছেন। প্রথমত, রাজনীতিক প্রক্রিয়ার ক্ষমতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ভারসাম্যের নির্দেশক হিসাবে সমাজের সাধারণ বা বাছাই করা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বা এলিট (elites) এবং প্রশাসক এলিট (administrative elites)-দের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা আবশ্যক। বল বলেছেন: “…an examination of administrative elites in comparison with other elites in the society is a vital indicator of the balance in prestige and power in the political process.” দ্বিতীয়ত, উচ্চপদস্থ আমলাদের গঠন বিন্যাস সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শক্তিসমূহকে প্রতিফলিত করে। বল বলেছেন: “…the composition of the higher bureaucracy is a useful reflector of social forces in society: recruiting agencies are rarely in control of the type of civil servants they select, it is a process more dependent on the relationships of social class education and the prestige of the public service.” তৃতীয়ত, উচ্চপদস্থ প্রশাসকদের মূল্যবোধ ও মনোভাবের উৎস ও অস্তিত্ব সমাজের প্রশাসন ব্যবস্থার উপর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করে। বল বলেছেন: “…the existence and origin of common values and attitudes among higher administrators, given their importance in the policy-making process, has important bear ings on how society is governed.”
আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব:
সমাজের অন্য সকল ব্যক্তির মত আমলাদেরও রাজনীতিক মূল্যবোধ ও অঙ্গীকারের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই আমলাদের কার্যকর ভূমিকা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সুতরাং নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পড়বেই। আবার শিক্ষা-দীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধার অসম বণ্টনের কারণে আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। পদস্থ আমলাদের অধিকাংশই সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসেন। অ্যালান বল বলেছেন: “A career structured higher civil service and a competitive entry procedure appear to be synonymous with a preponderance of higher social class membership.” সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এই শ্রেণীগত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। এই কারণে প্রশাসন পরিচালনায় সমাজের সকল অংশের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হয় না। তাই উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় দেশের সাধারণ মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার সঙ্গে আমলাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অমিল পরিলক্ষিত হয়। ফ্রান্সে উচ্চপদস্থ আমলাদের ৭০ শতাংশ আসেন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। এবং মাত্র ১০ শতাংশ আসেন কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের থেকে। গ্রেট ব্রিটেনেও এই প্রবণতা অধিকতর প্রকট। বল বলেছেন: “The middle and up per-middle class provide the majority of the entrants to the higher public service in West Germany, Britain and France. Two-third of the higher civil servants in Britain were born into the upper or middle classes, with only 19 percent being born to working-class parents.” তবে ফ্রান্স বা গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থায় নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক পরিবারের প্রতিনিধিত্ব অধিক। বল বলেছেন: “There is less social exclusiveness in the American federal service: nearly 25 percent come from the working class and higher proportion from the lower-middle classes than in Britain or France.”
এই প্রসঙ্গে আমলাদের নিয়োগ পদ্ধতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখন অধিকাংশ দেশেই বেশীর ভাগ উচ্চপদস্থ আমলাদের প্রতিযোগিতমূলক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মনোনীত ও নিযুক্ত করা হয়। বল বলেছেন: “Recruitment to the bureaucracy is now chiefly based on merit with selection being made through competitive exams.”
নিয়োগের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ব্যবস্থা:
ফ্রান্সে উচ্চপদস্থ আমলাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব একটি সংস্থার উপর ন্যস্ত আছে। এই সংস্থাটির নাম হল “The French National School of Administration’। এই সংস্থাটি ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মোট পদের দুই-তৃতীয়াংশ পূরণের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রকৃত্যকে বিচক্ষণ ও দক্ষ কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার জন্য প্রার্থীর অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ডিগ্রী (Second university degree)-র মানের পর্যায়ভুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা দরকার। নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রশিক্ষণের মেয়াদ হল ১৮ মাস। ছাত্ররা সরকারের কোন বিশেষ দপ্তরের জন্য বিশেষজ্ঞ হয় না। তবে মেধাবী ছাত্ররা বিশেষ মর্যাদাযুক্ত মন্ত্রকের অধীনে পদ বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। অ্যালান বল বলেছেন: “The system produce highly professionalised elites, and it is difficult to enter the civil service except at the start of one’s career.” বস্তুত আমলাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ব্যবস্থা যথেষ্ট সুষ্ঠু ও সুসংবদ্ধ।
গ্রেট ব্রিটেনের ব্যবস্থা:
গ্রেট ব্রিটেনেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অ-রাজনীতিক প্রশাসকদের নিযুক্ত করা হয়। বল বলেছেন: “Recruitment for the higher civil service in Britain is similarly based on a competitive examination and a good university degree.” এই নিয়োগ ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত আছে একটি সংস্থার হাতে। এই সংস্থাটির নাম হল “Civil Service Commission’। এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৫ সালে। বল বলেছেন: “…the specialist classes of the British civil service, lawyers, scientists and doctors, who are recruited on the basis of existing specialist qualifications, are increasing at a faster rate than the other classes in the civil service.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও মূলত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে অ-রাজনীতিক সরকারী কর্মচারীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পরিচালনা করে ‘Civil Service Commission’। বল বলেছেন: “the federal public service is basically job oriented, and is not a career service in the sense that the United Kingdom Service is.” বল আরও বলেছেন: “There is less of a rigid demarcation of the political and administrative areas than there is in Britain.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসনিক কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার উপর জোর দেওয়া হয়। এবং বর্তমানে ৯০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করা হয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রশাসনিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সের কোন বাধা আরোপ করা হয়নি।
ভারতের ব্যবস্থা:
ভারত সরকারের অ-রাজনীতিক কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে পৃথক ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রীয় স্তরে আছে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন (Union Public Service Commi ssion) এবং রাজ্যস্তরে আছে রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন (State Public Service Commission)। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বাছাই ও নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। লিখিত পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকারমূলক মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। সফল প্রার্থীদের সুষ্ঠু ও বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা:
সরকারের অ-রাজনীতিক কর্মচারীদের নিয়োগ পদ্ধতির মত তাঁদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও অবহেলার নয়। বাছাই করা প্রার্থীদের সরকারের নির্দিষ্ট পদে নিযুক্ত করার আগে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের পেশাগত যোগ্যতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট পদের দায়-দায়িত্ব ও কার্যাবলী সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। সকল দেশেই এক্ষেত্রে অল্পবিস্তর প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আছে।
Leave a comment