বর্তমান যুগে আমলাতন্ত্র প্রায় প্রতিটি রাজনীতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আমলাতন্ত্রের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি ভাবিয়ে তুলেছে। হিউয়ার্ট (Lord Hewart) তাঁর New Despotism গ্রন্থে আমলাতন্ত্রের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। দেশের সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতিক নেতা নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষকেই অল্পবিস্তর আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করতে দেখা যায়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র অপরিহার্য বিবেচিত হয়। অথচ এই উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই আমলাতন্ত্র দুর্নীতি, অপচয় প্রভৃতি বহুবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তার ফলে, বিরূপ সমালোচনারও বিরাম নেই। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আমলাতন্ত্রের কতকগুলি বিশেষ ত্রুটির কথা বলা হয়ে থাকে।

(১) জনস্বার্থের প্রতি উদাসীনতা: সরকারী প্রশাসনে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এর স্থায়িত্ব, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর বিশেষ জ্ঞানের অধিকার, একে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে সাহায্য করে। তার ফলে আমলারা প্রশাসনকে নিজেদের স্বার্থে ও ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়। সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে আমলারা নিজেদের স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে। সরকারী কাঠামোর অংশ হিসাবে এলিট-শ্রেণী-চেতনার সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে আত্মগৌরব ও অহংবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। নিজেদের বৈষয়িক উন্নতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যাপারেই আত্মনিয়োগ করে। নিজেদের কর্তৃত্ব ও গুরুত্বের ব্যাপারেই তাদের যাবতীয় আগ্রহ দেখা যায়। তার ফলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়। জনগণের মতামত ও অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আমলাতন্ত্র উদাসীন থাকে। আমলারা আত্মকেন্দ্রিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন থাকেন। জনসাধারণের সমস্যাদি ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আমলাদের অবহেলার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। দেশ ও দেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে আমলাদের হৃদয়হীন আচরণ পরিলক্ষিত হয়।

(২) গণতন্ত্রের শত্রু: সরকারী প্রশাসনে আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জন্য তারা নিজেদের নির্বাচিত রাজনীতিক অংশের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে গণ্য করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আমলাদের রাজনীতিক শাসকের প্রতিদ্বন্দ্বিতে পরিণত হতে দেখা যায়। সরকারী প্রশাসনের বিস্তৃতির ও মান উন্নয়নের দাবি যত বাড়তে থাকে প্রশাসনের গণতান্ত্রিক চরিত্র তত অন্তর্হিত হতে থাকে। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার বিস্তার গণতন্ত্রকে আমলাতন্ত্রে পরিণত করে। র‍্যামসে ম্যুর ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থার পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছেন: “Under the cloke of democracy it has thrive and grown until, like Frankenstein’s monster, it sometimes seems likely to devour its creator….” আমলাতন্ত্রের এই বিপদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন।

(৩) অভিজাততন্ত্রের আশঙ্কা: অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক সদস্য প্রতিনিধিমূলক উদারনীতিক গণতন্ত্রের দলীয় সরকারকেও ক্রমশ কিছু ব্যক্তির শাসনের ধাঁচে গড়ে তুলতে পারে। তার ফলে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক সরকার ধীরে ধীরে মুষ্টিমেয় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিজাততান্ত্রিক শাসনে পরিণত হতে পারে। বল বলেছেন: “The demands for more extensive and standardised government service may gradually transforms party government into more oligarchic patterns even in the more representative liberal democracies.”

(৪) জনকল্যাণের পরিপন্থী: উন্নতিশীল দেশসমূহের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্র একটা সমস্যা হিসাবে দেখা দিতে পারে। জনকল্যাণ ও দ্রুত আর্থনীতিক উন্নয়নের যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা এই সব দেশে প্রবলভাবে অনুভূত হয় তা অনিয়ন্ত্রিত আমলাতন্ত্রের জন্য বহুলাংশে ব্যাহত হয়। আপন ক্ষমতার বৃদ্ধি ও বিস্তারের মোহে ক্ষমতালোভী পদস্থ আমলারা জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পথে বাধার সৃষ্টি করেন। এই কারণে আমলাতন্ত্র জনকল্যাণ-বিমুখ বলে বিবেচিত হয়।

(৫) ব্যক্তি-স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক: আমলাতন্ত্র ব্যক্তি-স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে পড়তে পারে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের শাসন থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা নিরাপদ থাকে। কিন্তু গণতন্ত্র ক্ষমতালিপ্স আমলাদের শাসনে পরিণত হলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “Bureaucracy is a system of government the control of which is so completely in the hands of officials that their power jeopardises the liberties of ordinary citizens.”

(৬) রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট: আমলাতন্ত্র রক্ষণশীলতার ধারক ও বাহক হিসাবে অভিযুক্ত হয়ে থাকে। আমলাদের মধ্যে প্রথা ও ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। আমলাদের মধ্যে পূর্ববর্তী নজিরের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ও অন্ধ আনুগত্য পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত রীতি-নীতি ও পন্থা-পদ্ধতির প্রতি আমলাদের অবিচল নিষ্ঠা বর্তমান থাকে। এই পরিবর্তন-বিমুখ মানসিকতা আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর একটা বড় বৈশিষ্ট্য। আমলারা গতানুগতিক ধারায় রুটিন মাফিক কাজ করে চলেন। তাঁরা রুটিনবাঁধা কাজের বাইরে কিছু করতে চান না। তার ফলে আমলাতান্ত্রিক কাজকর্ম নিষ্প্রাণ ও যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। প্রখ্যাত দার্শনিক রাসেল (Bertrand Russell ) -এর মতানুসারে এক নেতিবাচক মানসিকতা আমলাদের মধ্যে কাজ করে। তাই আমলারা প্রগতিমূলক কোন সংস্কার বা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনকে সহজে মেনে নিতে পারেন না। আমলাদের কাছ থেকে সৃজনশীল ও প্রগতিমূলক কোন পদক্ষেপ আশা করা যায় না। উদ্যোগহীনতা প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়।

(৭) দীর্ঘসূত্রতা: দীর্ঘসূত্রতা আমলাতন্ত্রের আর একটি বড় ত্রুটি। আমলারা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির বাইরে যেতে চান না। তার ফলে আমলাতান্ত্রিক কাজকর্মের মধ্যে যান্ত্রিকতা ও দীর্ঘসূত্রতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমলারা প্রতিটি বিষয়ে খুঁটিনাটি বিভিন্ন দিক বিচার-বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আবার নিয়ম মাফিক আনুষ্ঠানিকতার স্বার্থে এক বিভাগকে অন্য বিভাগের মতামত জানতে হয়। তারফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমগ্র ধারাটি অযথা বিলম্বিত হয়। ‘লাল ফিতার বাঁধন’ (redtapism) কাটিয়ে সরকারী কাজকর্মে গতি আসতে চায় না। সরকারী প্রশাসন গতিহীনতায় ভোগে। দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। এবং সরকারের দায় দায়িত্বের বোঝা বাড়তে থাকে।

(৮) বিভাগীয় সংকীর্ণতা: বিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গি আমলাতন্ত্রের একটি ত্রুটি বিশেষ। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে সরকারের কাজকর্মকে বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরের মধ্যে বণ্টন করা হয়। নিজস্ব সংকীর্ণ বিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যেক দপ্তর কাজ করে চলে। আন্তঃবিভাগীয় সামঞ্জস্যের ব্যাপারে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে উদ্যোগ বা আগ্রহ দেখা যায় না। সরকারের সাধারণ নীতি ও কর্মধারার পরিবর্তে সংকীর্ণ বিভাগীয় মনোভাব (departmentalism) প্রাধান্য পায়। তারফলে আন্তঃবিভাগীয় বিরোধ ও প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় সরকারী কাজকর্মের পরিচালনার ক্ষেত্রে অকারণে সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং সামগ্রিক বিচারে প্রশাসনিক শক্তি-সামর্থ্যের অবক্ষয় ঘটে।

(৯) বিচ্ছিন্নতা: আমলারা সাধারণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত অবস্থায় অবস্থান করেন। সরকারী কাঠামোর মধ্যেই নির্দিষ্ট পন্থা-পদ্ধতি, আচার-আচরণ, বিধি-ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের ব্যস্ত থাকতে হয়। এই বিচ্ছিন্নতা আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের সীমাবদ্ধতা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

(১০) ক্রমস্তরবিন্যস্ত কাঠামো: আমলাতন্ত্রের সাংগঠনিক কাঠামো বহুলাংশে পিরামিডের আকৃতি বিশিষ্ট এবং ক্রমস্তরবিন্যস্ত। নিম্নস্তরে অবস্থিত আমলাদের সঙ্গে জনসংযোগ বর্তমান থাকে। আবার উচ্চপদস্থ আমলাদের সঙ্গে সরকারের রাজনীতিক কর্তাব্যক্তিদের সংযোগ বর্তমান থাকে। জনজীবনের সঙ্গে এঁদের কোন যোগাযোগ থাকে না। এই ক্রমস্তরবিন্যাস আমলাতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ সংহতির পরিপন্থী।

(১১) দায়িত্বহীনতা: আমলাদের মধ্যে দায়িত্বহীনতার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয়। সরকারী কাজকর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখার জন্য কোন আমলা কোন বিষয়ে সহজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চান না। সরকারী কোন কাজের ব্যর্থতার দায় এক বিভাগের আমলা অন্য বিভাগের আমলার উপর চাপিয়ে নিষ্কৃতি লাভের চেষ্টা করেন। এই প্রবণতার ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নৈপুণ্যের অবক্ষয় ঘটে।

(১২) আমলাদের মধ্যে মানসিক অনুভূতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা প্রশাসনের পন্থা-পদ্ধতি, আনুষ্ঠানিক রীতি-নীতি ও বিধি-ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মানুষের অভাব-অভিযোগ ও অনুভূতি সম্পর্কে তাঁরা উদাসীন থাকেন। তার ফলে শাসনব্যবস্থা মানবিকতাবোধ রহিত হয়ে পড়ে।

(১৩) পারকিনসনের মত: পারকিনসন আমলাতন্ত্রের কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে চূড়ান্ত কেন্দ্রিকতা আমলাতন্ত্রের প্রকৃতি। এর ফলে গণতন্ত্রের বিপদ দেখা দেয়। অকারণ জটিলতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হল আমলাতন্ত্রের স্বভাবধর্ম। আমলাতন্ত্র অনেক সময় অনড় এবং গতি ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে।

(১৪) মার্কসের মতামত: আমলাতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের অভিমতও উল্লেখ করা আবশ্যক। Towards a Critique of Hegel’s Philosophy of Right (1843) শীর্ষক রচনাটিতে এ বিষয়ে মার্কসের মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়। 

  • (ক) আমলাতন্ত্র সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সংশ্লিষ্ট স্বার্থকে আমলাতান্ত্রিক স্বার্থ হিসাবে পরিপোষণ করে। তারফলে সমাজ ও সমাজবাসীদের স্বার্থ ও প্রয়োজন অবহেলিত হয়। 

  • (খ) আমলাতান্ত্রিক কাঠামো বা সংগঠন হল স্তরবিন্যস্ত। এ হল জ্ঞান ও মর্যাদার স্তরবিন্যাস। উচ্চস্তরে অবস্থিত আমলারা নিম্নস্তরে অবস্থিত আমলাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান দেন। এবং বিপরীতক্রমে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরকে সর্বসাধারণের বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এইভাবে পরস্পর পরস্পরকে প্রতারিত করে থাকে মাত্র। প্রতারণার এই বৃত্ত থেকে কেউই রেহাই পায় না। 

  • (গ) আমলাতন্ত্র হল রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক শক্তি। এই শক্তি রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিকতায় পর্যবসিত হয়। এবং এই আমলাতন্ত্র কার্যত এক কাল্পনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলে। তারফলে বাস্তবে রাষ্ট্র অবহেলিত হয়। 

  • (ঘ) আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের উপর জোর দেয়। এবং আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্যকে নিজেদের লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করে। এইভাবে রাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য অবহেলিত হয় এবং প্রকৃত লক্ষ্যের সঙ্গে বিরোধ বাধে।

আমলাতন্ত্রের অস্তিত্ব বিশেষত উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় অপরিহার্য অথচ আমলাতন্ত্রের উপরিউক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না। এই কারণে এই সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি অপসারণের জন্য আমলাতন্ত্রের উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলা হয়।