বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্রেই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন দেখা যায়। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল আমলাতন্ত্রের বহুমুখী ভূমিকা ও কার্যাবলির কথা বলেছেন। রবসন-এর মতে, আমলাতন্ত্র হল, ‘levelling and rationalizing force’। আবার কারা কারাে মতে, রাজনীতির দ্বারা আমলাদের কার্যাবলি প্রভাবিত হয়। আসল কথা আমলাতন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক কার্যকলাপে সততা ও দক্ষতার মাধ্যমে দায়িত্বশীলতা প্রসারিত করা। যাইহােক বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র যেসকল কার্যাবলি সম্পাদন করে, তা হল নিম্নরূপㅡ

(১) আইন বিভাগ প্রণীত আইন প্রয়ােগ: আমলাতন্ত্রের কার্যাবলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আইন বিভাগ প্রণীত আইন প্রয়ােগ। কোন্ আইন কীভাবে প্রয়ােগ করা হবে সেই বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজনৈতিক প্রশাসক (মন্ত্রী) কিন্তু তার প্রয়ােগ পদ্ধতিগত দিক ঠিক করে দেয় আমলাবৃন্দ। সর্বোপরি, আমলাবাহিনী সরকারের প্রতিটি প্রকল্প রূপায়ণের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

(২) শাসনকার্যে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষা: প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশ বা আমলাবাহিনী দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও সরকারের স্থায়ী অংশ আমলাবাহিনীর কোনাে পরিবর্তন হয় না। তারা বহু ঘটনার বা রাজনীতির উত্থানপতনের সাক্ষী থাকেন, তারা সদাসর্বদা প্রশাসনিক কাঠামােকে সচল রাখেন। সুশাসনের স্বার্থে শাসনকার্যের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন। আমলারা নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন বলেই প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা উভয়ই সমানভাবে বজায় থাকে।

(৩) দৈনন্দিন কার্য পরিচালনা: সরকারি কর্মচারীবৃন্দ প্রশাসনে দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাদের এই কাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা一

  • (a) শাসননীতি নির্ধারণ এবং
  • (b) শাসননীতি প্রয়ােগ।

কোনাে কোনাে দেশে আমলাতন্ত্র সরকারের দুর্বলতা ও নানা চাপের পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুরক্ষার কাজ করে। জনৈক লেখকের মতে, আমলাতন্ত্র Platonic Guardianship-এর ভূমিকা পালন করে। শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীগণ অর্থাৎ আমলারা আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন প্রয়ােগ করে দেশের দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। বলা যেতে পারে যে, আমলাদের মাধ্যমেই সকল দেশে আইনের শাসন কার্যকর হয়।

(৪) বিশেষীকৃত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সরবরাহ: অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আমলারা তাদের দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের সরবরাহ করেন, এমনকি আইনসভায় মন্ত্রীদের যেসকল প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তার উত্তর বিচক্ষণ আমলারাই প্রস্তুত করে দেন। সরকারি নীতি নির্ধারণ ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলারা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতার দ্বারা শাসনকার্যের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীদের সাহায্য করে থাকেন।

(৫) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আমলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমলারা দুধরনের আইন প্রণয়ন করে থাকে, যেমন—

  • (a) অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (delegated law),
  • (b) প্রশাসনিক দপ্তর প্রণীত আইন (departmental law)

আইন সভায় উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাব বা বিল রচনা করে থাকেন আমলারাই। বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জটিল প্রকৃতির শাসনব্যবস্থা হওয়ায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে কলাকৌশলগত জ্ঞান, বিচক্ষণতার প্রয়ােজন হয়, তা রাজনৈতিক প্রশাসকদের না থাকার জন্যই, সেই দায়িত্ব আমলাদের উপরই ন্যস্ত থাকে।

(৬) স্বার্থগােষ্ঠীর ব্যাপারে ভূমিকা: আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী এবং স্বার্থগােষ্ঠীগুলি (শ্রমিক সংঘ, কৃষক সংঘ, ব্যবসায়ী সংঘ, শিক্ষক সংগঠন ইত্যাদি) নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমলাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তােলে তাই আমলাদের ভূমিকা এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। Administrator also take part in process of bargaining consulting and negotiating with pressure group। আমলারা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে গােষ্ঠীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সরকার ও গােষ্ঠীগুলির মধ্যে আপস মীমাংসার ব্যবস্থা করেন। আমলাদের উদ্দেশ্যই হল চাপসৃষ্টিকারী গােষ্ঠী বা স্বার্থগােষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে প্রশাসনকে যতটা সম্ভব উত্তেজনামুক্ত রাখা।

(৭) সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ: প্রশাসনে আমলারা সংবাদ ও তথ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। সরকারি নীতি ও যাবতীয় তথ্যের উৎস হল আমলাতন্ত্র। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ প্রয়ােজনীয় নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের মতাে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির খবর সংগ্রহের জন্য আমলাদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

(৮) বিচার বিভাগীয় কার্যসম্পাদন: শাসন বিভাগের স্থায়ী অংশ অর্থাৎ আমলাবাহিনীকে বিভাগীয় ন্যায়বিচার বা প্রশাসনিক বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল-এর সঙ্গে যেমন – Administrative tribunal, Industrial tribunal, Tax tribunal ইত্যাদির সঙ্গে আমলারা যুক্ত থাকেন।

(৯) রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ: আত্মগৌরব ও আত্মমর্যাদার বােধ থেকে দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও আমলাবাহিনী সরকারের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বলা যেতে পারে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নত উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণের কারণে আমলাতন্ত্রের রক্ষণশীল ভূমিকার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

(১০) নীতি প্রণয়ন: সরকারের স্থায়ী অংশ বা আমলাতন্ত্র সরকারি নীতি প্রণয়নের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নীতি নির্ধারণের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে আমলাবাহিনী বিশেষভাবে জড়িত থাকে। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাদের এই ভূমিকা সরকারের কাজের পরিধি, আমলাদের নৈপুণ্য ও স্থায়িত্বের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।

(১১) রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা: কোন কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক সুযােগসুবিধা দানের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অধ্যাপক অ্যালান বল মনে করেন, জনগণের ইচ্ছাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে তেমনি প্রশাসনিক দক্ষতাকেও সুরক্ষিত করতে হবে। রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তিতে অনেকসময় আমলাতন্ত্রের উচ্চপদ লাভের সুযােগ পাওয়া সম্ভব হয়।

(১২) পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ সংক্রান্ত কার্যভার গ্রহণে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সান্নিধ্য ও নির্ভরশীলতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সুতরাং পররাষ্ট্রনীতি সকল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই একান্তভাবে কাম্য। কিন্তু এই পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রেও আমলাদেরই দায়িত্ব ও ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র বা সরকারের স্থায়ী বিভাগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, আধুনিক রাষ্ট্র প্রকৃত শাসন পরিচালনার উৎস দক্ষ, কুশলী বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদার বিশাল আমলাবাহিনীর মধ্যেই নিহিত আছে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অনুধাবনের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের গুরুত্ব বােঝা সম্ভব যেমন一

(১) জনকল্যাণকর কার্যাবলির বিস্তারে সাহায্য করে: বর্তমান বিশ্বের প্রায় বেশিরভাগ রাষ্ট্রই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আদর্শে গঠিত। আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রের এই আদর্শকে বাস্তবায়নে সর্বতােভাবে সক্রিয় থাকে।

(২) রাজনীতিক কর্তৃপক্ষকে বিশেষীকৃত জ্ঞান সরবরাহ করে: রাজনৈতিক নেতাদের প্রশাসনিক তত্ত্বগত জ্ঞান থাকলেও ব্যাবহারিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু আধুনিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে বিশেষীকৃত জ্ঞানের প্রয়ােজন তা মন্ত্রী, আইনসভার সদস্য বা নেতাদের থাকে না, আমলারাই শাসনকার্যে এই বিশেষীকৃত জ্ঞান সরবরাহ করেন।

(৩) শাসনব্যবস্থার কাজের গতি বজায় রাখে আমরা বাহিনী: সরকারের স্থায়ী কর্মচারীবর্গ প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা, ব্যক্তিগত যােগ্যতা ও গুণগত উৎকর্ষের প্রমাণ দিয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন, গণতন্ত্রে সরকার নির্দিষ্ট দিন অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়। এই অবস্থায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তখন আমলাবাহিনীই শাসনকার্যের গতিশীলতা বজায় রাখেন।

(৪) সরকারি আইন, নীতি ও সিদ্ধান্ত কার্যকর করে: সরকারের আইন, শাসন বিভাগীয় আদেশ, নির্দেশ ও সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপায়িত করে সরকারি আমলাবাহিনী। এদের আন্তরিক সহযােগিতা ছাড়া সরকার অচল হয়ে পড়তে পারে।

(৫) নীতি নির্ধারণ ও রূপায়ণ: সরকার বা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যে নীতি নির্ধারণ করে সরকারের অরাজনৈতিক অংশ বা স্থায়ী অংশ অর্থাৎ আমলাবাহিনী সেই নীতির বাস্তব রূপায়ণ করেন। কার্যত নীতি নির্ধারণ ও রূপায়ণের দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।