‘কাব্যং রসাত্মকং বাক্যং কাব্যম’-রসাত্মক বাক্য কাব্য। এই সূত্র অনুসারে অস্বীকার করা যায় না যে গুপ্ত কবির পদ্য রসাত্মক কাব্য। কিন্তু রোমান্টিক কাব্যে কাব্যের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে যে ভাবগভীরতা, যে কল্পনাপ্রবণতা, যে অখণ্ড রূপ ও রূপাতীতের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে তা রোমান্টিক নন্দনতত্ত্বের নিজস্ব দিক। ওয়াল্টার পেটর বলেছেন, ‘Strangers added to beauty”। রোমান্টিক কাব্যে ‘strangenesus’ ও ‘beauty’-র কথা থাকে। রোমান্টিক কাব্যে সৌন্দর্যপ্রধান ভাব বিস্ময়ান্বিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। রোমান্টিক কাব্যের আর একটি লক্ষণ স্বতোৎসারিতা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যাকে বলেছেন “Spontaneous overflow of powerful feelings”। এই আবেগোৎসার রোমান্টিক কাব্যের লক্ষণ। ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে বস্তুসচেতনতা বেশি, কবি অধিকমাত্রায়, বহির্মুখী। এই বহির্মুখীনতার জন্য ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে রোমান্টিক কাব্যের অন্যতম লক্ষণ ‘মন্ময়তা’ নেই। রোমান্টিক কবি অহংতন্ত্রী (subjective) কবির ভাষায় “আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ”। এই রোমান্টিক কল্পনার দীপ্তিতে রোমান্টিক কাব্য উজ্জ্বল এই রোমান্টিক কল্পনা সৌন্দর্যসন্ধান, বিস্ময় রসস্রষ্টা। “বিস্ময়াবহ সৌন্দর্যন্বেষই রোমান্টিক কল্পনার একতম বৈশিষ্ট্য” (বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজম-পূঃ ৩১ ড. গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়)। কীটসের সৌন্দর্যচেতনা, ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতি কবিতা, কোলরিজের অপ্রাকৃত কুহক-স্বপ্ন, রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যচেতনা ও প্রকৃতিদৃষ্টি এ-সব রোমান্টিক কাব্যের ফসল। ঈশ্বর গুপ্ত এই গোত্রের কবি নন। তিনি বস্তুনিষ্ঠ, বহির্মুখী, শ্লেষপ্রধান কবি। তাঁর কবিতায় কল্পনার অভাব যথেষ্ট। “ঈশ্বরচন্দ্র বস্তুনিষ্ঠ, সমাজসচেতন ও ইতিহাস সচেতন কবি। নবীন কবিতার যে রোমান্টিক প্রাণধর্ম রঙ্গলাল ও মধুসূদন থেকে ক্রমপর্যায়ে শুরু, তার ইসারা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি।” (বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিসিজম, পৃঃ ১৩০)।
রোমান্টিক কবিতার আবেগধর্ম ঈশ্বর গুপ্তের ছিল না বলে তিনি ‘ছাগল’, ‘আনারস’, ‘পৌষপার্বণ’ ইত্যাদি নিয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন। এই কবিতাগুলি বস্তুনিষ্ঠ কবিতা, রোমান্টিক কবিতা নয়। F. L. Lucas রোমান্টিক কবিতা বলতে যে exuberance, emotion এবং imagination-এর কথা বলেছেন, তা এইসব পদ্যে নেই। এখানে পদ্যের ভাষা আভিধানিক, গদ্যার্থসূচক ও ব্যঞ্ছনারহিত। এই গুণগুলি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় নেই। যখন কবি ভাবীসমাজের চিত্র আঁকেন তখন তাঁর কবিভাষা হয় এইরকম :
‘লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া।
ঠাটঠমকে চালাক চতুর
সভ্য হবে থোড়া থোড়া
আর কি এরা এমন ক’রে
সাজ সেঁজুতির ব্রত নেবে?
আর কি এরা আদর করে
পিড়ি পেতে অন্ন দেবে?’
এই পদ্যের মধ্যে আন্তরিকতা হয়তো আছে, কিন্তু নেই এমন গুণ যা রোমান্টিক কাব্যের সংজ্ঞায় উত্তীর্ণ। বিষ্ণু দে লিখেছেন, রোমান্টিক কাব্যে যে আবেগ দানা বাঁধে, তার প্রমাণ ইংরাজি কাব্যসাহিত্যে চসর আর ইতালি সাহিত্যে দাস্তে। এই উক্তি সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাব্যে রোমান্টিক আবেগ দানা বাঁধেনি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রাকৃত মনোভাবের কবি, তাই ‘ছাগল’, ‘তপসে মাছ’, ‘আনারস’, ‘পৌষপার্বণ’-এর মতো বস্তুগ্রাহ্য সাংসারিক বস্তু বিশেষ করে যার সেরা বাসনা রসনায়, তা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কবিতার এই বিষয়বস্তু নির্বাচন কবির বস্তুনিষ্ঠ বা প্রাকৃত মনের পরিচায়ক। কিন্তু এই প্রাকৃত মনোভাবসম্পন্ন ও বিষয়নিষ্ঠ বস্তুপ্রধান কবিতা, বা সমাজসচেতন কবিতাতেও কবির নিজস্ব মর্যাদা অক্ষুণ্ণ হয়ে আছে। হয়তো রোমান্টিক কাব্যের সংজ্ঞায় এগুলি উত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু তবু ‘Didactic poetry’ বা ‘Poetry of statement’ –হিসাবে কবিতাগুলি উল্লেখযোগ্য। রোমান্টিক কবির সুদূরপ্রসারী কল্পনা হয়তো এগুলিতে বিদ্যমান নেই। কিন্তু যা আছে তাও আস্বাদ্য। এই ধরনের আস্বাদ্য সহজ সরল সুকুমার কবিতা নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দেশবাসীর কাছে মর্যাদা লাভ করেছেন। এই বিশেষ ধারার কবিতা রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত একজন দিকপাল কবি। বাংলা সাহিত্যের দেশজ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে এই প্রাকৃত মনোবৃত্তির প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বাঞ্ছিত এই ধারা বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র পরিচয় দান করেছে। কেউ কেউ ঈশ্বর গুপ্তকে যুগসন্ধির কবি বলেন, কেউ কেউ বলেন, রঙ্গলাল বা ভারতচন্দ্র যুগসন্ধির কবি। এ নিয়ে মতান্তর আছে, তবু এ কথা অস্বীকার করা যায় না ঈশ্বর গুপ্ত নবীন-প্রবীণের সন্ধিস্থলে আবির্ভূত হয়ে। দিকেই গ্রহণশীল ছিলেন। মনের এই উদারতা ঈশ্বর গুপ্তের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু রোমান্টিক কাব্যের সৃজনশীলতা বা স্বতোৎসার ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে নেই। তাঁর কবিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সচেতন, সুচিন্তিত ও উদ্দেশ্যহীন। একটি বিশেষ আদর্শের প্রকারই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বৈশিষ্ট্য। সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি দেশী-বিদেশী দুই দিককেই বরণ করেছেন। এইজন্য কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাকে গ্রীস দেবী ‘জেনাস’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিহারীলাল রোমাণ্টিক কাব্যধারায় সূচনা করেছিলেন, এইদিক থেকে বিহারীলালকে বলা হয় “ভোরের পাখী”। ভোরের পাখী বা নব্য রোমান্টিক কাব্যের যুগপুরুষ ছিলেন বিহারীলাল। বিহারীলালের কাব্যের সৌন্দর্যপ্রিয়তা, প্রকৃতিদৃষ্টি ও আত্মভাব প্রাধান্য তাঁকে শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক ব্রিটিশ ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সুর ও আস্বাদ সম্পূর্ণ পৃথক। ঈশ্বর গুপ্ত এবং অংশত রঙ্গলালের কাব্যেও Poetry of Statement-ই মুখ্যস্থান অধিকার করেছে। তাই তাঁদের মধ্যে রোমান্টিক কাব্যের গুণ থাকলেও, রোমান্টিক কাব্যের সংজ্ঞাভুক্ত কাব্য নয়। এই দিক থেকে ঈশ্বর গুপ্ত স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এক আত্মরক্ষার কবি। সমকালীন সমাজসমস্যা তাঁকে বিচলিত করেছে, কিন্তু সেই সমস্যার সমাধানের কোন দিশা দেখাননি। ঈশ্বর গুপ্তের মর্যাদা তাঁকে একক করে তুলেছে ও প্রাক-রোমান্টিক গীতিকবিতাকার হিসেবে তাঁর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
Leave a comment