অথবা, ত্রাণকর্তা হিসেবে খলিফা আবু বকর (রা)-এর অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, ইসলামের প্রতি হযরত আবু বকর (রা)-এর অবদানসমূহ সংক্ষেপে আলােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা)-এর খেলাফতকাল ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার যােগ্য পরিচালনা ও যুগােপযােগী সিদ্ধান্তের ফলে সকল প্রতিকূল অবস্থার মােকাবিলা করে মদিনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ কারণে তাকে Saviour of Islam তথা ইসলামের ত্রাণকর্তা বলা হয়। ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন- The death of the prophet foreboded a dangerous and doubtful carrier of Islam.
ত্রাণকর্তা হিসেবে আবু বকর (রা)-এর অবদানঃ
১. সিদ্দিক উপাধিঃ রাসূল (স)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির সংবাদ শুনে বিনা দ্বিধায় নেতৃস্থানীয় ও বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি নিঃসংকোচে মিরাজ শরীফে বিশ্বাস স্থাপন করেন। এজন্য রাসূল (স) তাকে সিদ্দিক উপাধিতে ভূষিত করেন।
২. ইসলামের সেবকঃ ইসলামের সেবায় হযরত আবু বকর (রা) সর্বস্ব বিলিয়ে দেন। তিনি বিভিন্ন সময় ও প্রয়ােজনে বিশেষ করে ঋণমুক্তকরণ, মদিনার মসজিদ নির্মাণ ও তাবুকসহ প্রভৃতি যুদ্ধে অকৃপণ হস্তে প্রচুর অর্থ দান করেন। হযরত ওমর (রা) বলেন, আবু বকর (রা)-কে ইসলামের খেদমতের ব্যাপারে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না।
৩. ইসলাম প্রচারঃ হযরত আবু বকর (রা) ব্যক্তিগত টার্গেট নিয়ে নিজ প্রভাব খাটিয়ে হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস, ওসমান, যুবায়ের, তালহা, আবদুর রহমান ইবনে আউফ প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে ইসলামে আনয়ন করেন।
৪. মহানবী (স)-এর বিশ্বস্ত বন্ধুঃ হযরত আবু বকর (রা) ছিলেন মহানবী (স)-এর জীবন সহচর, বিশ্বস্ত বন্ধু ও উপদেষ্টা। মহানবী (স)-এর কঠিনতম মুহর্তে তিনি তাকে ছায়ার মতাে অনুসরণ করতেন। তিনি রাসূল (স)-এর একমাত্র সঙ্গী ও দেহরক্ষী হিসেবে মদিনায় হিজরত করেন। বদর, উহুদ, খন্দক, খায়বার, তাবুক প্রভৃতি যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার ত্যাগ তিতিক্ষা, বিশ্বস্ততা ও সেবার জন্যই রাসূল (স) বলেন, যদি আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে বন্ধু বলতাম তাহলে আবু বকরকেই বলতাম।
৫. মহানবী (স)-এর দাফন সম্পন্নকরণঃ মহানবী (স)-এর ওফাতকালীন চিত্তবিহ্বলতা ও হতাশা বিদূরিত করে তিনি মহানবী (স)-এর দাফন কার্য সুন্দর ও সুচারুরূপে সমাধা করেন।
৬. সংকটময় সন্ধিক্ষণে খেলাফত লাভঃ মহানবী (স)-এর তিরােধানের পর ইসলামের মহাসংকটময় মুহূর্তে আবু বকর (রা) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব লাভ করে তিনি নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খল জনগণকে সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধ্য করে ইসলামকে অনিশ্চয়তার কবল থেকেও মুক্ত করেন। তার সুদৃঢ় নেতৃত্বে সমগ্র আরবে ইসলাম পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জাতীয় ঐক্য সংহতি আরাে মজবুত হয়।
৭. যাকাত অস্বীকারকারীদের দমনঃ হযরত আবু বকর (রা) খলিফা পদে সমাসীন হলে আরবের অনেক গােত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। হযরত আবু বকর (রা) কঠোর হস্তে তাদের তৎপরতা রােধ করে যাকাত দিতে বাধ্য করেন এবং দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন, “যারা মহানবী (স)-এর যুগে যাকাত হিসেবে একটি বকরির বাচ্চাও দিত, আজ তারা তা দিতে অস্বীকার করলে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করব।”
৮. ভণ্ডনবীদের দমনঃ আসওয়াদ আনাসি, তােলায়হা, মুসায়লামাতুল কাযযাব ও সাজাহ নামক কুখ্যাত মুরতাদরা নিজেদেরকে নবী বলে দাবি করে। হযরত আবু বকর (রা) প্রবল আক্রমণ চালিয়ে এ সকল ভণ্ডনবীকে পরাভূত করেন।
৯. বেদুইনদের দমনঃ বেদুইনগণ কর্তৃক ইসলাম ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার সকল দুরভিসন্ধি ও আক্রমণ কঠোর হস্তে দমন করে আবু বকর (রা) ইসলামকে বিপদ মুক্ত ও সঞ্জীবিত করে তােলেন। এ প্রসঙ্গে ডব্লিউ মুইর বলেন- But for him (Abu Baker) Islam would have melted away in compromise with the Bedueen tribes of likelier still have perished in the throng of its birth. অর্থাৎ আবু বকরের জন্যই ইসলাম বেদুইন ধর্মের সাথে মিশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি অথবা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়নি।
১০. দাসদাসী মুক্তকরণঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, হযরত বেলাল (রা)-সহ অসংখ্য দাসদাসীকে আবু বকর (রাঃ) নিজ অর্থে ক্রয় করে আল্লাহর উদ্দেশে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
১১. রােমানদের সাথে যুদ্ধঃ হযরত আবু বকর (রা) খেলাফতে আরােহণ করেই সিরিয়ায় রােমানদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি উসামার নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরণ করে সিরিয়া জয় করেন।
১২. হীরা অভিযানঃ হযরত আবু বকর (রা) হীরার শাসনকর্তা হরমুজের চক্রান্তের কথা জানতে পেরে সেনাপতি খালেদ ও মুসান্নাকে সেনাবাহিনীসহ হীরায় প্রেরণ করেন। তারা বীরত্বের সাথে পারস্যের হীরা অঞ্চল জয় করেন।
১৩. কুরআন সংকলনঃ ঐতিহাসিক খােদা বক্স বলেন, আবু বকর (রা) কুরআনের হেফাযতকল্পে কুরআনের আয়াতসমূহ একত্রে সংগ্রহ ও গ্রন্থাকারে সংকলনের উদ্যোগ নেন এবং যায়েদ ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের কাজ সমাপ্ত করেন।
১৪. হাদীস সংরক্ষণের উদ্যোগঃ হাদীসে রাসূল (স)-এর বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করণার্থে হযরত আবু বকর (রা) হাদীস সংরক্ষণেরও উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৫. রাষ্ট্র সংগঠকঃ হযরত আবু বকর (রা) সংকটাপন্ন শিশু ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এক মহান রাষ্ট্র সংগঠক ও পরিচালক হিসেবে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
১৬. বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠাতাঃ খলিফা আবু বকর (রা) দ্বীন-দুঃখীর দুর্দশা দূর করার জন্য সর্বপ্রথম বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, নতুন রাষ্ট্রের শাসনকার্যে এবং জনসাধারণের কল্যাণ সাধনে আর বকর (রা) সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছিলেন।
১৭. মদিনার প্রাধান্য রক্ষাঃ নবপ্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত আরব বেদুইনরা রাসূল (স)-এর ওফাতকালকে মদিনা আক্রমণের সুবর্ণ সুযােগ বলে বিবেচনা করে। আবু বকর (রা) প্রবীণ সাহাবীদের পরামর্শে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে জুলকাশ নামক যুদ্ধে হঠাৎ আক্রমণ করে বেদুইনদের ছত্রভঙ্গ করে দেন এবং মদিনার প্রাধান্য রক্ষা করেন।
১৮. গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষকঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, আবু বকর (রা) ছিলেন গণতন্ত্রে পূর্ণ বিশ্বাসী। তিনি জনগণের সুচিন্তিত মতানুসারে খেলাফতের যাবতীয় কাজকর্ম সমাধা করতেন।
১৯. রিদ্দার যুদ্ধঃ রাসূল (স)-এর ওফাতের পর নও-মুসলিমগণ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে দলে দলে পূর্ব ধর্মে ফিরে যেতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা) দৃঢ়তার সাথে তাদের দমন করেন। এসব স্বধর্মত্যাগীর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানই ইসলামের ইতিহাসে রিদ্দার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
২০. ধৈর্যশীলতাঃ মহানবী (স)-এর মৃত্যু সংবাদে ওমরের মতাে সিংহচেতা মানুষ পর্যন্ত শােকে বিমূঢ় হয়ে পড়েন। এ সময় অসীম ধৈর্য ধারণ করে হযরত আবু বকর (রা) এ পরিস্থিতিতে সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান প্রদান করেন।
২১. চরিত্রঃ হযরত আবু বকর (রা) মক্কার শ্রেষ্ঠ বিদ্বানদের অন্যতম ছিলেন। তার ঈমানের দৃঢ়তা, ন্যায়পরায়ণতা, অসীম ধৈর্য, অনুপম চরিত্র, কঠিন সংযম, বিপদে স্থিরচিত্ততা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন।
২২. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুসংহতকরণঃ মহানবী (স)-এর ওফাতের পর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। হযরত আবু বকর (রা) দৃঢ় মনােবল সহকারে যাকাত, ভূমিকর ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় পাওনা আদায় করে মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা সুসংহত করেন।
২৩. বহির্বিশ্বে ইসলামের প্রসারঃ খলিফা আবু বকর (রা)-এর ঐকান্তিক ও নিরলস প্রচেষ্টায় ইসলাম ও ইসলামের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয়। তখন শুধু আরবের ভেতরই ইসলাম নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন হয়নি, বহির্বিশ্বেও ইসলাম বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মােকাবেলা করে দ্রুত গতিতে সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়। হিট্টি বলেন- Arabic had to conquer itself before it could conquer the world.
উপসংহারঃ হযরত আবু বকর (রা) ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক সংকটজনক সময়ে খেলাফতে সমাসীন হন এবং সকল প্রকার বিদ্রোহ দমন করে বাইরে অভিযান পরিচালনার সূত্রপাত করেন। ফলে মুসলমানগণ পরবর্তীকালে অর্ধ পৃথিবী জয় করতে সক্ষম হয়।
Leave a comment