আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যেসকল আদর্শ, মূল্যবোধ, ন্যায়নীতি, সম্মান, শান্তি ও নিরাপত্তাকে রাষ্ট্র সংরক্ষিত ও প্রসারিত করতে চায় তা বাস্তবায়িত করার জন্য ক্ষমতার প্রয়ােজন। ক্ষমতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতিকে প্রয়ােগ করে। তাই বলা যায়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় রাষ্ট্র কীরূপ ভূমিকা পালন করবে তার অন্যতম নির্ধারক হল ক্ষমতা বা জাতীয় শক্তি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ক্ষমতার রাজনীতি (Power politics) বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক জোসেফ ফ্রাঙ্কেল বলেন, ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে (“International relations centre around power politics.”)।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ধারণাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়ােগ করা হয়। অনেকসময় বিভিন্ন দেশকে বৃহৎ শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি এবং মহাশক্তিধর (Super Power) হিসেবে ভাগ করা হয়। যদি বলা হয় যে, ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি আর পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৩০ কাটা তার দ্বারা বােঝা সম্ভব যে জনশক্তিতে পাকিস্তান ভারতের তুলনায় দুর্বল।

বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুপার পাওয়ার বা মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তবে একবিংশ শতকে প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতি, আণবিক বোমা, পরমাণু বোমা ও মারণাস্ত্রের উৎপাদনের ফলে কোনাে দেশ দাবি করতে পারে না যে, তার দেশ অন্য দেশের থেকে আগ্রাসনমুক্ত। এক্ষেত্রে তাহলে আমেরিকার বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র (World Trade Centre, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০৪) সন্ত্রাসবাদী আলকায়দা গােষ্ঠীর বিমান হানায় ধ্বংস হল কীভাবে? এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সমস্যা তত বেড়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জাতীয় শক্তির বাস্তব প্রয়োগ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

সর্বোপরি, একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের আচরণকে ভীতি প্রদর্শন, পুরস্কার প্রদান, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে। বস্তু ক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষে তার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্য হিসেবে প্রতিটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এই কারণে প্রতিটি রাষ্ট্রই সীমাবদ্ধ ক্ষমতা ভােগ করে। নিম্নে এই সীমাগুলি আলােচিত হলㅡ

(১) আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু: রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতা বা শক্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভিন্ন প্রকার সামাজিক ও আইনগত শক্তির দ্বারা সীমাবদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার উপর কম বাধানিষেধ আরােপিত হয় বলেই তা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়। ক্ষমতার গুরুত্ব প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে হ্যান্স জে মরগেনথাউ বলেছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিক রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ক্ষমতা অর্জন করা বা দখল করা। ক্ষমতা ছাড়া ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, দার্শনিক প্রভৃতি কোনাে প্রকার লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায় না।

(২) শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠা: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার মানদণ্ডে রাষ্ট্রগুলিকে অতি বৃহৎ শক্তি, বৃহৎ শক্তি, মাঝারি শক্তি, ক্ষুদ্র শক্তি এবং অতিক্ষুদ্র শক্তি এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়। একটি রাষ্ট্র অত্যধিক পরিমাণে শক্তিশালী হয়ে উঠলে অন্য রাষ্ট্র জোট গঠন, হস্তক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরতি, যুদ্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করে। এইভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৩) পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়: বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা ক্ষমতা বা শক্তিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করেন। হ্যান্স জে মরগেনথাউ তার ‘Politics Among Nations’ গ্রন্থে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ক্ষমতার লড়াই বলে আখ্যা দিয়েছেন। বস্তুত বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হিসেবে কতকগুলি আদর্শকে তুলে ধরলেও বাস্তবে শক্তি বা ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়। কারণ ক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষে তার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তবে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশ দূষণ, বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতিবিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাকে শুধু ক্ষমতা অর্জনের আলােকে ব্যাখ্যা করা যায় না, রাষ্ট্র কর্তৃক অনুসৃত মূল্যবােধের দ্বারা তা স্থিরীকৃত হয়।

(৪) সংযত রাষ্ট্রীয় আচরণবিধি: উপরােক্ত আলােচনা থেকে এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্রগুলি জাতীয় শক্তিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুবই উদগ্রীব। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তার সমর্থনের ইঙ্গিত দেয় না। প্রতিটি রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্য এবং সেই সুবাদে তাকে কতকগুলি আচরণবিধি ও আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এই সমাজের সভ্য হিসেবে প্রতিটি রাষ্ট্রকে শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া আরও অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা রাষ্ট্রগুলি উপেক্ষা করতে পারে না।

(৫) জাতীয় শক্তির অনিশ্চিত পরিমাপ পদ্ধতি: যুদ্ধজাহাজ, সেনাবাহিনী, বােমারু বিমান, সমরাস্ত্র ইত্যাদিকে জাতীয় শক্তি পরিমাপের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এগুলি সঠিক প্রতিশ্রুতি বহনকারী উপাদান নয়। একটি দেশের সামরিক সজ্জার পরিমাপ অনুমাননির্ভর। শিল্পোন্নত দেশগুলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিমুহূর্তে আধুনিকীকরণ করে চলেছে। অতএব আজ একটি দেশের জাতীয় শক্তি যে অবস্থায় আছে, আগামীকাল সেই অবস্থায় থাকবে এমন কোনাে নিশ্চয়তা নেই।

(৬) জোট গড়ার প্রবণতা: শক্তি বৃদ্ধির সকল উপাদানসমূহ সকল রাষ্ট্রের থাকে না। তাই একাধিক রাষ্ট্র জোটের সাহায্যে নিজেদের শক্তিকে আক্রমণ মােকাবিলার উপযােগী করে তুলতে চাইছে।

(৭) জাতীয় শক্তি বৃদ্ধিতে গণতান্ত্রিক কাঠামাের বাধা:  আজকের দিনে যে-কোনাে রাষ্ট্রকে পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে জনমতের দিকটি ভাবতে হয়। জনগণ জাতীয় শক্তি বৃদ্ধির চেয়েও ভােগ্যপণ্যের উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পরিসেবার উপর গুরুত্ব আরােপ করতে চায়। সরকার এগুলি উপেক্ষা করতে পারে না।

(৮) জাতীয় শক্তি বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ: আর্থসামাজিক উপাদান, প্রশাসনিক উপাদান, রাজনৈতিক কাঠামাে, সমাজতাত্ত্বিক দিক প্রভৃতির সক্রিয় সহযােগিতা না থাকলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এককভাবে জাতীয় শক্তিকে সম্প্রসারিত করতে পারে না।

(৯) ক্ষমতার পরিণতি ধ্বংস: বেপরােয়াভাবে ক্ষমতার ব্যবহার শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রকে ক্ষমতাহীন করে তােলে। ক্ষমতার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এর পুনরুজ্জীবন বা পুনর্গঠন করা অবশ্যই দরকার।

(১০) ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযােগিতা বিপজ্জনক: কয়েকটি রাষ্ট্র জাতীয় শক্তি সম্প্রসারণকে অন্যতম লক্ষ্য মনে করায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দিনের পর দিন উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ককে তিক্ত করে তােলে।

উপসংহার: জাতীয় শক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী সম্প্রসারণ বিশ্বপরিস্থিতির পক্ষে বিপজ্জনক, তাই কাম্য নয়। একাধিক রাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা শিখণ্ডী রূপে সামনে রেখে জাতীয় শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে, যার পরিণতিস্বরূপ যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা যায়। তাই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতটুকু শক্তির দরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির জন্য সেই মাত্রা নির্ধারণ বিশ্বপরিস্থিতির স্বার্থেই অত্যন্ত প্রয়ােজন হয়।