প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রকৃতি, ক্ষমতা ও এখতিয়ারের তুলনামূলক আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ যুদ্ধ এমনি এক বিষয় যা কেউ কামনা করে না। তবে যুদ্ধ বললে শুধু ধ্বংস বা ক্ষতির বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু যুদ্ধ কোন পক্ষের জন্য মঙ্গলও বয়ে আনে। অর্থাৎ যুদ্ধ কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের বিকল্প আর কোন পথ থাকে না।
নুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনী বিভিন্ন দেশে ঝটিকা আক্রমণ করতে থাকে। এই আক্রমণে বিভিন্ন দেশের পতন হতে থাকে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে ৯টি দেশ হিটলারের অধীনে চলে আসে। নাৎসী বাহিনীর মানবতা বিরোধী অপরাধে আক্রান্ত হয় ইউরোপের বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।
১৯৪২ সালে জার্মান কর্তৃক দখলকৃত ৯টি দেশের প্রতিনিধিগণ লন্ডনে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এখানে তারা জার্মানির যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে একটি প্রস্তাব সুপারিশ করেন।
১৯৪৩ সালে তেহরানে এবং ১৯৪৫ সালে ইয়ালটায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
একই বছর অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বৃটেনের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে সকলে একমত পোষণ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং বৃটেন বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসার পর তারা নাৎসী বাহিনীর নেতাদের বিচার করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এজন্য নুরেমবার্গে একটি আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
প্রসকিউটর নিয়োগ : এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি রবার্ট এইস জ্যাকসন। প্রেসিডেন্ট হ্যারি টুম্যান তাকে নিয়োগ দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালের ৮ মে। একই বছর জুন মাসে প্রধান প্রসিকিউটর রবার্ট এইস জ্যাকসন লন্ডনে আসেন।
চার্টার প্রণয়ন : ১৯৪৫ সালের ৮ অগাস্ট লন্ডন চার্টার জারি করা হয়। এর অপর নাম নুরেমবার্গ চার্টার। এটিই মূলত: নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মূল ভিত্তি। এই চার্টারে শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত অপরাধকে এই চার্টারের এখতিয়ার বহির্ভূত রাখা হয়।
বিচারপতি নিয়োগ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী ৪টি দেশে থেকে অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং বৃটেন থেকে ২ জন করে বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। মোট ৮ জন বিচারপতি নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও ৪ জন বিচারপতিকে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয় বাকী ৪ জনকে আদালতের বিকল্প বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আদালতের ভাষা : ইংরেজি, জার্মান, ফ্রান্স এবং রাশিয়ান এই ৪টি ভাষাকে আদালতের ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
আদালতের স্থান : নুরেমবার্গের ‘প্যালেস অব জাস্টিস’ প্রসাদ।
আসামীর সংখ্যা : মোট ২৪ জন নাৎসী নেতাকে আসামী করা হয়।
অভিযোগ : নাসী নেতাদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ছিলো শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা ও চক্রান্তে অংশগ্রহণ। দ্বিতীয়ত : শান্তির বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের পরিকল্পনা। তৃতীয়ত : যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করা। চতুর্থত : মানবতাবিরোধী অপরাধ করা।
তদন্ত কমিটি : নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের জন্য ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
(১) আমেরিকান টিম : যুদ্ধের চক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করার জন্য এই কমিটিকে দায়িত্ব প্ৰদান ৬০ করা হয়।
(২) বৃটিশ টিম : আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার তদন্ত করার জন্য এই কমিটিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
(৩) ফরাসী টিম : তৃতীয় দফায় তদন্তের জন্য এই কমিটিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
(৪) রাশিয়ান টিম : চতুর্থ দফায় তদন্তের জন্য এই কমিটিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় । দালিলিক সাক্ষ্য : দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে হিটলার এবং অন্যান্যদের লেখা চিঠিপত্র, আদেশ, হিসাবপত্র, ফিল্ম, ছবি ইত্যাদি হাজীর করা হয়। ৪৭টি বাক্স ভর্তি এই সকল রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়৷
আসামী কর্তৃক আইনজীবী নিয়োগ : আসামীদেরকে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। উক্ত আইনজীবীগণকে রেকর্ডপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়। উভয়পক্ষকে জেরা করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং সাফাই সাক্ষীদের জবানবন্দী নেয়া হয়।
আসামীদের বক্তব্য : সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে আসামীদেরকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া হয় । ট্রাইব্যুনাল কর্তক রায় প্রদান : রায় প্রদান করা হয় ১৯৪৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সর্বমোট ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলেও ২ জনের বিচার করা সম্ভব হয়নি। মোট ২২ জনের বিচার করা সম্ভব হয়। তাদের মধ্যে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়, ৩ জনকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড, ২ জনকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড, ১ জনকে ১০ বছর কারাদণ্ড, বাকীদের খালাস দেয়া হয়৷
আপীল অধিকার : এখানে দণ্ডপ্রাপ্তদের আপীলের কোন বিধান রাখা হয় নি। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের রায় বা সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
যুগোশ্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ৪ দশক পর ১৯৯১ সালে বিশ্ববাসী যুগোশ্লাভিয়ায় ভয়াবহ নৃশংসতা দেখতে পায়। এটি যেন হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানায়। বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়।
সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার বর্তমান নাম বলকান। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় পার্থক্য রয়েছে। এই জাতিগত ও ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে তাদের যে তিক্ত সম্পর্ক তা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপলাভ করে ১৯৯১ সালে।
এই যুদ্ধের এক পক্ষ ছিল সার্বিয়া। আর অন্য পক্ষ ছিল বসনিয়ানস, আলবেনিয়ানস ক্রোটসরা। এছাড়া বসনিয়ানস ও ক্রোটসদের মধ্যে এবং মেসিডোনিয়ানস ও আলবেনিয়ানসদের মধ্যে ও উক্ত নৃশংসতা বিস্তার লাভ করে।
যুগোশ্লোভিয়ার যুদ্ধে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এখানে এতো পরিমাণ প্রাণহানি ঘটে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনটি আর হয় নি। এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতিকে নির্মূল করা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটে। সারা বিশ্ব এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। জাতিসংঘও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ট্রাইব্যুনাল গঠন : জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালের ২৫ মে যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে এর কার্যক্রম শুরু হয়।
বিচারক নিয়োগ : যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনালে মোট ১১ জন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের মধ্যে-
এশিয়া মহাদেশ থেকে ৩ জন, স্ত্রী মিক্সিতে ইউরোপ থেকে ২ জন, আফ্রিকা থেকে ২ জন, উত্তর আমেরিকা থেকে ২ জন, তত BD NID : The matterer ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ১ জন এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ জন।
উত্তর আমেরিকার ২ জনের মধ্যে একজনকে প্রধান বিচারক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। যার নাম বিচারপতি জ্যাব্রিয়েল ক্লার্ক ম্যাকডোনান্ড। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টের বিচারক ছিলেন।
প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি : যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত হয় ডাসকো টাডিক নামের এক ব্যক্তি। জাতিতে সে ছিল সার্ব এবং নৃশংস প্রকৃতির। সে কারাগারে প্রহরির চাকরী করতো। তার বিরুদ্ধে ডজন খানিক মানুষ হত্যা, অসংখ্য মানুষকে অমানবিক অত্যাচার ও কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে ৩৪ দফা অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১১টি দফায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু ৩০১ পৃষ্ঠার রায়ে তাকে খালাস প্রদান করা হয়।
যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনালে আপীলের বিধান থাকায় উক্ত মামলায় আপীল করা হয়। আপীল আদালত পূর্বের রায় বাতিল করে তার বিরুদ্ধে ৯টি দফায় মোট ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করেন।
স্লোভোডান মাইলোসেভিস : স্লোভোডান মাইলোসেভিস ছিলো যুগোশ্লাভ যুদ্ধের প্রধান মানবতা বিরোধী অপরাধী। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা হয় নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল যে, ক্রোয়েশিয়া এবং বসনিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনায় তাকে কাজে লাগাবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল ডেটন শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। পরবর্তীতে আলবেনিয়ানরা সার্বিয়া থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন হতে চায়। তাদেরকে নির্মুল করার জন্য এই স্লোভোডান মাইলোসেভিস দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
স্লোভোডান মাইলোসেভিস এর নির্দেশ মতো তার সেনাবাহিনী কসোভোর স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কসোভোর ১৪ লক্ষ জনগণের মধ্যে ৭ লক্ষ লোক প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়৷
কসোভোর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সোচ্চার হয়। অন্যদিকে আমেরিকাও স্লোভোডান মাইলোসেভিস এর উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ২০০০ সালের যুগোশ্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে স্লোভোডান মাইলোসেভিস পরাজিত হয়।
২০০১ সালের ১ এপ্রিল স্লোভোডান মাইলোসেভিসকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। গ্রেফতারের ২ মাস পরে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে বিচারের জন্য হেগ পাঠানো হয়।
২০০২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনালে স্লোভোডান মাইলোসেভিস এর মামলা শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়া যুদ্ধ এবং বসনিয়ার গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনাল ২ বছর যাবত স্লোভোডান মাইলোসেভিস এর অপরাধের বিবরণী তৈরি করেন। অন্যদিকে স্লোভোডান মাইলোসেভিস যুগোশ্লাভ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার ও ক্ষমতা অস্বীকার করেন।
২০০৬ সালের ১১ মার্চ কারাগারে স্লোভোডান মাইলোসেভিস মারা যায়।
আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রকৃতি, ক্ষমতা ও এখতিয়ারের তুলনামূলক আলোচনাঃ নিম্নে আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রকৃতি, ক্ষমতা ও এখতিয়ারের তুলনামূলক আলোচনা ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো :
উপসংহারঃ যুদ্ধ কারো কাম্য নয়। তবুও কোন কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হলে যুদ্ধের নিয়ম মেনে যুদ্ধ করতে হয়। এসময় নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। এই সকল বিষয় না মানা হলে পরবর্তীতে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।
Leave a comment