বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বা জাতির মধ্যে নিজস্ব স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অন্য রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ঐকমত্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি অবস্থা সৃষ্টির জন্য একটি আইনের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে মিটিয়ে দিয়েছে এই আন্তর্জাতিক আইন। একটি রাষ্ট্রের সাথে অন্য একটি রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, পারস্পরিক আচরণ কেমন হবে আন্তর্জাতিক কোনো জটিলতার ক্ষেত্রে এর সমাধান কি হবে এমনকি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচার,মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক অভিবাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। বিশ্বে একে অপরের সাথে জাতিগুলির সম্পর্ক, লেনদেন, সেইসাথে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক এবং বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এমন নিয়ম ও নীতি নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন ।

আন্তর্জাতিক আইন কি

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি দেশের সাথে অন্য একটি দেশের সম্পর্ক নির্ধারণ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে যে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয় তাকে আমরা আন্তর্জাতিক আইন বা ইন্টারন্যাশনাল ল বলতে পারি। “আন্তর্জাতিক আইন” বা পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল বা জাতির আইন হলো নিয়ম-নীতির একটি সংস্থা যা পরস্পরের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির নিয়মরীতি/আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে মেনে চলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

একটি রাষ্ট্র অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে কিভাবে বা কিরূপ আচরণ করবে,তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কিভাবে নির্ণীত হবে এবং কিভাবে একে অপরের সাথে শান্তিকালে কিংবা যুদ্ধকালে বসবাস করবে- এসব নির্ধারণ করায় আন্তর্জাতিক আইনের উদ্দেশ্য।

আন্তর্জাতিক আইনের টার্মটি ১৭৮০ সালে ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২)উদ্ভাবন করেন। তাছাড়া এ বিষয়ে থমাস অ্যাকুইনাস(Saint Thomas Aquinas) হুগো গ্রোটিয়াস(Hugo Grotius), ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant),স্যামুয়েল ভন পুফেনডর্ফ(Samuel von Pufendorf) প্রমূখ দার্শনিক কাজ করেছিলেন। তারা সবাই আন্তর্জাতিক অধিক্ষেত্রের theoretical ভিত্তিস্থাপনের প্রয়াসী হন। এদের মধ্যে হুগো গ্রোটিয়াস স্বাভাবিক আইন ও বাস্তব আইন আইনের মিশ্রন চাইতেন এবং স্যামুয়েল ভন পুফেনডর্ফ ন্যাচারাল ল বা স্বাভাবিক আইনের কথা বলতেন, এবং ভ্যাটেল এক্ষেত্রে পজিটিভ এর পক্ষপাতী ছিলেন। তবে আমরা দেখতে পাই প্রথা ও বিভিন্ন যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইনের সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে আন্তর্জাতিক আইন দুই ধরনের হয়ে থাকে যথা পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল(বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পালনীয়) এবং প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল (ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে পালনীয়) ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিক আইনের আধুনিক শাখার জনক ‘লাসা ফ্রান্সিস লরেন্স ওপেনহাইম’ (L. F. L. Oppenheim) ১৯০৫ সালে বলেছেন যে,আন্তর্জাতিক আইন হলো সে সকল প্রথাসিদ্ধ বিধানের সমষ্টি এবং সন্ধির শর্ত যা সভ্য রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক আদান প্রদানে আইনগত মেনে চলতে বাধ্য থাকে।(International_Law_orLaw_of_Nations_is_the_name_for_the_body_of_customary_and_Treaty_rules_which_are_cons-idered_legally_binding_by-civilized-state-in-their-intercourse-with-each-other).

ব্রিটিশ আইনবিদ প্রফেসর লরেন্স বলেন যে আন্তর্জাতিক আইন হল সে সকল নিয়ম কানুন এর সমষ্টি যার দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলো তাদের পারস্পরিক আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে(International_law_is-the-rules-which-determine-the-conduct-of-General_Body_of_civilized_states_in-their-mutual-dealings.)

অধ্যাপক হল’এর ভাষায় আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রসমূহের আচরণ সম্পর্কিত কতিপয় বিধান যা আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের পরস্পরের ব্যাপারে অবশ্যই পালনীয় বিধি বলে শ্রদ্ধা করে থাকে.(International-Law-consists_In-certain-rules-of_conduct_who-is-modern_Civilization_state regarded_as_being_Binding-on-them-in-their-relations-with-one-another.)

উপরের প্রামাণ্য সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, আন্তর্জাতিক আইন হল সাধারণ আইনে সেই অংশ যা শুধু রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক নির্ধারণ করে না বরং আন্তর্জাতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলী এবং এসকল প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে রাষ্ট্রসমূহ এবং ব্যক্তির সম্পর্ক ও দায়িত্ব কর্তব্য অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।

আন্তর্জাতিক আইনের ঐতিহাসিক দিক

আন্তর্জাতিক আইন মূলত ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিদ্যমান। বিংশ শতাব্দীতে, দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং লীগ অব নেশনস গঠন এই প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করতে অবদান রেখেছিল। কিন্তু ভার্সাই_চুক্তি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যর্থতার পর, লীগ_অব_নেশনস জাতিসংঘ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। একইভাবে ১৯২০ সালে লিগ অব নেশনস -এর তত্ত্বাবধানে The_Permanent_Court of_Justice দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের_সময় বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৪৬সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় এবং The_Permanent_Court of_Justice ১৯৪৫ সালে কার্যকর হয়। বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নর্মস ও আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধরনের কনভেনশনওচুক্তির উন্নয়ন এবং সংহতকরণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে।