বর্তমান বিশ্বের সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিকতার উপযোগিতা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা ও আন্তর্জাতিক সেবা ছাড়া মানবসভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দিক থেকে আন্তর্জাতিকতার উপযোগিতা আলোচনা করা যেতে পারে।
(১) উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ: উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা দরকার। তার উপযুক্ত উপায় হল আন্তর্জাতি-কতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা। সামন্ততান্ত্রিক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জাতীয়তাবাদ বিকৃত বা উগ্র রূপ ধারণ করে। আর্থনীতিক স্বার্থ সাধনের জন্য ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি হয়। সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানবসভ্যতা বিপর্যস্ত হয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের এই সর্বনাশা প্রতিক্রিয়া থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে। তারজন্য আন্তর্জাতিকতার প্রসার প্রয়োজন।
(২) রাষ্ট্রসমূহের উন্নতি ও অগ্রগতি: আন্তর্জাতিকতার পথেই পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উন্নতি ও সমৃদ্ধি সম্ভব। শান্তি ও সমৃদ্ধি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিকতার আদর্শ প্রসারিত হলে মারণাস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। প্রতিটি রাষ্ট্র তখন সমরাস্ত্র নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদসামগ্রীর অনর্থক অপচয় বন্ধ ঘটাবে না। তার পরিবর্তে উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করবে।
(৩) রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা: বর্তমান বিশ্বে কোন জাতি বা রাষ্ট্রের পক্ষে একক প্রচেষ্টার দ্বারা নিজ নিজ উন্নতি বা সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সকল রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা। আন্তর্জাতিকতার পথেই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এখন যে-কোন রাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীন ইচ্ছা বিশ্বশান্তির পক্ষে বিপজ্জনক। ল্যাস্কি বলেছেন: “The interdepen dence of state makes it necessary to postulate a world-community, a society of states, with its own legal imperatives is the ultimate rules before which all rules must give way.”
(৪) বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতা সংরক্ষণ: বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকতার প্রয়োজন সব থেকে বেশী। বর্তমানকালের আণবিক যুদ্ধ হবে সামগ্রিক যুদ্ধ। যার পরিণাম হল সামগ্রিক ধ্বংস। পারমাণবিক যুদ্ধের এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। ল্যাস্কির মতানুসারে আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে বাঁচতে হবে, অন্যথায় আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। রাসেল (Bertrand Russel) – এর বক্তব্য হল, ‘হয় মানুষ যুদ্ধ শেষ করবে, না হয় যুদ্ধই মানুষকে শেষ করবে।’ তিনি বলেছেন: “Either Man will abolish war, or war will abolish Man.” পণ্ডিত নেহেরু (Nehru) বলেছেন: ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প হল সম্মিলিত ধ্বংস’। তাঁর কথায়: “The alternative to peaceful co-existence is co-destruction.” আন্তর্জাতিকতার আদর্শ ও পথ মানবসভ্যতাকে এই চরম সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে। জাতীয় আনুগত্যকে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আনুগত্যে পরিণত করতে হবে। তাহলে পৃথিবীতে সৌভ্রাতৃত্বমূলক এক আন্তর্জাতিক সমাজের সৃষ্টি হবে।
(৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অতিমাত্রায় জটিল ও ভয়াবহ। এর কতকগুলি কারণ আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের গুরুত্ব বৃদ্ধি, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির নেতৃত্বের ব্যাপারে সংঘাত, নক্ষত্র যুদ্ধের (State War) পরিকল্পনা প্রভৃতি। বর্তমান জটিল পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আদর্শের ভিত্তিতে সকল রাষ্ট্রকে পরস্পরের সার্বভৌমিকতা ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তা না হলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিকতার সাফল্যের সুত্রসমূহ:
আন্তর্জাতিকতার সাফল্যের কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। এই বিষয়গুলির বাস্তবায়নের উপর আন্তর্জাতিকতার সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল।
-
(ক) আন্তর্জাতিক শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে প্রতিটি রাষ্ট্র তার বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার প্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
-
(খ) আন্তর্জাতিক সমস্যাদির যথাযথ সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
-
(গ) সংশ্লিষ্ট বিশ্বসংস্থাটি সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে উঠবে।
-
(ঘ) উল্ফ (Leonard Woolf)-এর মতানুসারে সকল রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য কতকগুলি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করতে হবে।
-
(ঙ) অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে আন্তর্জাতিক বিষয়ে কোন দেশ এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না।
Leave a comment