হিন্দি সাহিত্যক্ষেত্রে আধুনিক যুগভাবনার ভগীরথ-পুরুষ ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র। আধুনিক হিন্দি গদ্যের নির্মাণ, দেশহিত ও সমাজহিতের উদার উন্নত আধুনিক দৃষ্টি, হিন্দি নিবন্ধসাহিত্য, নাট্যসাহিত্যে আধুনিক ধারার সূত্রপাত, হিন্দু কবিতার প্রকৃতিতে নবীন ভাবসঞ্জার, নবধারার সাহিত্যমণ্ডল সৃষ্টি ইত্যাদি ভারতেন্দু-প্রতিভাকে এক অমর ঐতিহাসিক মহিমা দান করেছে।

ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের জন্ম ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে মধ্যভাগে। জন্ম নিয়েছেন এমন এক পরিবারে, যে পরিবার অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকেই কোম্পানির বাণিজ্যস্বার্থ রক্ষা করে ধনকুবের হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে, ইতিহাসখ্যাত শেঠ উমিচাঁদের বংশে ভারতেন্দুর জন্ম। কিন্তু হিন্দি সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতিক্ষেত্রে ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল পারিবারিক ঐতিহ্যকে প্রায় অস্বীকার করে নবজাগরণের অগ্রদূত হিসাবে।

ভারতেন্দুর কবিপ্রতিভাকে যে তাঁর অন্য সাহিত্যপ্রতিভার তুলনায় পুরোনোপন্থী বলে গণ্য করা হয়, তার প্রধান কারণ, কবিতার ভাষা ব্যবহারে ভারতেন্দু যেমন পুরোনো ব্রজভাষা ব্যবহার করেছেন, তেমনি ভাবগত দিক থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভক্তিকাল বা শৃঙ্গারকালের কাব্যভাবেরই অনুবর্তন ঘটেছে তাঁর কবিতায়।

ভারতেন্দুর ক্রান্তিকারী ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার মূল্যায়নে তাঁর কাব্যের বিচার কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাহিত্যক্ষেত্রে ভারতেন্দুর প্রথম আবির্ভাব একজন কবিরূপেই। ভারতেন্দুর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ৭০টির মতো, যথা

(১) ভক্ত-সঞ্চয়ন, (২) প্রেম মালিকা, (৩) কার্তিক স্নান, (৪) বৈশাখ মাহাত্ম্য, (৫) প্রেম-সরোবর, (৬) প্রেমাত্মবর্ষণ, (৭) জৈন কুতূহল, (৮) প্রেম-মাধুরী, (৯) প্রেম-তরঙ্গ, (১০) উত্তরার্ধ ভক্তমাল, (১১), প্রেম-প্রলাপ, (১২) গীত গোবিন্দানন্দ, (১৩) সতসঈ শৃঙ্গার, (১৪) হোলী, (১৫) মধু-মুকুল, (১৬) রাগ-সংগ্রহ, (১৭) বর্ষা-বিনোদ, (১৮) বিনয়-প্রেম-পচাসা, (১৯) ফুলোঁ কা গুচ্ছা, (২০) প্রেম-ফুলবারী, (২১) কৃষ্ণ-চরিত্র, (২২) শ্রীঅলবরত-বর্ণন, (২৩) শ্রীরাজকুমার সুস্বাগতপত্র, (২৪) সুমনোগুলি, (২৫) প্রিন্স অফ ওয়েলেস কে পীড়িত হোনে পর কবিতা, (২৬) শ্রী জীবন জী মহারাজ, (২৭) চতুরঙ্গ, (২৮) দেবী ছদ্ম-লীলা, (২৯) প্রাতঃস্মরণ মঙ্গল-পাঠ, (৩০) দৈন্য-প্রলাপ, (৩১) উরেহনা, (৩২) তন্ময়লীলা, (৩৩) দান-লীলা, (৩৪) রানী ছদ্ম লীলা, (৩৫) সংস্কৃত লাবনী, (৩৬) বসন্ত হোলী, (৩৭) স্ফুট সমস্যায়ে, (৩৮) মুহ-দিখাবনী, (৩৯) উর্দু কা স্যাপা, (৪০) প্রবোধিনী, (৪১) প্রাতঃসমীরন, (৪২) বকরী-বিলাপ, (৪৩) স্বরূপচিত্তন, (88) শ্রীরাজকুমার-শুভাগমন বর্ণন, (৪৫) ভারত-ভিক্ষা, (৪৬) শ্রী পঞ্চমী, (৪৭) শ্রী সর্বোত্তম স্তোত্র, (৪৮) নিবেদন-পঞ্চক, (৪৯) মানসোপায়ন, (৫০) প্রাতঃস্মরণ স্তোত্র, (৫১) হিন্দী কে উন্নতি পর ব্যাখ্যান, (৫২) অপবর্গদাষ্টক, মনো মুকুল-মালা, (৫৪) বেণু-গীতি, (৫৫) শ্রী নাথ-স্তুতি, (৫৬) মূক প্রশ্ন, (৫৭) অপবর্গ-পঞ্চক, (৫৮) পুরুষোত্তম-পঞ্চক, (৫৯) ভারত-বীরত্ব, (৬০) শ্রী সীতা-বল্লভ স্তোত্র, (৬১) শ্রী রাম-লীলা, (৬২) ভীষ্ম স্তবরাজ, (৬৩) মান-লীলা ফুল বুঝোঅল, (৬৪) বন্দর-সভা, (৬৫) বিজয়-বল্পরী, (৬৬) বিজয়িনী-বিজয়-বৈজয়ন্তী, (৬৭) নয়ে জমানে কী মুখরী, (৬৮) জাতীয় সঙ্গীত, (৬৯) রিপনাষ্টক, (৭) স্ফুট কবিতায়ে।

ভাবগত দিক থেকে ভারতেন্দুর কবিতাকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। যথা-ভক্তি-ভাবনা, শৃঙ্গার ও সৌন্দর্য ভাবনা, দেশভক্তি-ভাবনা এবং ব্যঙ্গাত্মক কবিতা। ভারতেন্দুর ভক্তিভাবের কবিতায় রীতিযুগের কবিদের মতোই আত্মনিবেদনের ভক্তিপ্রণত সুর শোনা যাবে। তবে ভারতেন্দুর বৈষুব-ভক্তিতে একই সঙ্গে মিলেছে শাস্ত-দাস্য-মাধুর্য্যের বৈচিত্র।

ভারতেন্দু রীতিকালীন কবিদের মতোই ব্রজধামের লতাপাতা হয়ে জন্ম নিয়ে ব্রজগোপীদের মতো রাধা-কৃয়লীলার রসগ্রহণ করতে চান –

“ব্রজ কা লতাপতা মোহি কীজে।

গোপী পদ-পঙ্কজ পাবন কী রজ জামে সির ভীজে।।

আওত জাত কু কী গলিয়ন রূপ-সুধা নিত পীজে।

শ্রীরাধে রাধে মুখ য়হ বর হরীচন্দ্র কী দী জৈ।।”

রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের বর্ণনা এক্ষেত্রে যেন মানবিক প্রেম-ভাবনারই দ্যোতক হয়ে উঠেছে। তাই এই ধরনের প্রেমময় ভক্তিভাবের পদগুলিকে আমরা বলতে পারি ভক্তি ও প্রেমসাধনার সেতৃস্বরূপ। যেমন নিম্নোদ্ধৃত পদটি –

“আজু কুণ্ন মন্দির আনন্দ ভরি বৈঠে শ্যাম, 

শ্যামা সঙ্গ রঙ্গত উমঙ্গ অনুরাগে হৈ।

ঘন চহরাত বরসাত হোত জাত জ্যোঁ জ্যোঁ,

তৌহী তৌ অধিক দোঊ প্রেম পুঞ্জ পাগে হৈ।

ভারতেন্দু যখন প্রেম বা শৃঙ্গার বিষয়ক কবিতা রচনা করেন, তখন সেখানেও রীতিযুগের ভাবেরই প্রতিফলন ঘটে। নায়িকার মিলন প্রত্যাশা, তার যৌবন জ্বালা, তীব্র বিরহের আর্তি, স্বকীয়া পরকীয়া নায়িকাভেদ ইত্যাদি বিষয় রীতিকালীন শৃঙ্গার কবিতাকেই স্মরণ করায়। একটি কবিতায় বিরহিণী নায়িকার আসঙ্গ-পিপাসার আর্ত বিলাপ অসাধারণ মানবিক আবেদন সৃষ্টি করেছে –

“আজু লৌ জো ন মিলে তো কহা

হয়তো তুমরে সব ভাঁতি কহা ওই।

মেরো উরাহনো হায় কচু নাহি

সবৈ ফল অপুনে ভাগ কো পাওই।।

প্রেমের বা শৃঙ্গারের কবিতায় ভারতেন্দু পরিশীলিত রুচির পরিচয় রাখলেও রীতিকালের আদিরসাত্মক অশ্লীতার দোষ সর্বদাই যে পরিহার করতে পেরেছেন, তা নয়। কোনো কোনো কবিতায় দেহবাসনার উগ্রতা রীতিকালের অনুসরণের কারণেই আধুনিক যুগরুচির পক্ষে পীড়াদায়ক হয়েছে সন্দেহ নেই।

তবে সৌভাগ্যের কথা, কাব্যক্ষেত্রে ভারতেন্দুর প্রতিভা শুধুমাত্র এই ভক্তিরস ও শৃঙ্গাররস বিতরণেই পরিসমাপ্ত হয়নি। তার মধ্যে সমকালীন যুগচেতনার প্রভাবও পড়েছিল গভীরভাবে। ভারতেন্দুর ভক্তি ও প্রেমচেতনা কখনো কখনো হৃদয়ের একই আবেগ-বিন্দুতে এসে মিলেছে। তেমনি তাঁর ভগবৎ-ভক্তি সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক সীমাকে অতিক্রম করে কখনো কখনো উদার ব্যাপ্ত মনোভাব প্রকাশ করে ভারতীয় সম্প্রীতির সেতুও রচনা করতে চেয়েছে। তাঁর এই অসাম্প্রদায়িক ধর্মচেতনা আসলে তাঁর রাষ্ট্রীয় চেতনারই অন্তর্গত। তিনি ধর্মকলহে জর্জরিত ভারতাত্মাকে উদার সহনশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত করতে চেয়েছেন বারবার।

ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করতে গিয়ে ভারতেন্দু বারবার তাই স্বদেশের অধোগতি ও স্বদেশবাসীর হীনদশার কথাই স্মরণ করেন

“কহাঁ করুণা নিধি কেশব সোএ।

জাগত নেক ন জদপি বহুত বিধি ভারতবাসী রোএ।….

হায় সুনত নহি নিঠুর ভএ ক্যো পরম দয়াল কহাঈ।

সব বিধি বুড়ত লখি নিজ দেসহি লেহু ন অবহু বচাঈ।।”

ভারতেন্দুর প্রখর জাতীয় চেতনা ভারতবাসীকে ধর্মভেদ, জাতিভেদ ও মতাদর্শগত যাবতীয় বিরোধ অতিক্রম করে আত্মবলে বলীয়ান হয়ে উঠতে আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের তৎকালীন অধোগতির জন্য তীব্র বেদনাবোধ করেছেন ভারতেন্দু। পরানুকরণবৃত্তি ও পরমুখাপেক্ষিতার প্রখর নিন্দা করে ভারতেন্দু ভারতবাসীর হীনমন্যতাবোধকে আঘাত করতে চেয়েছেন। “ভারত-দুর্দশা’ নাটকের গানগুলিতে ভারতেন্দুর এই জাতীয় চেতনার স্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাবে।

সিপাহি বিদ্রোহ দমিত হবার পর যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করে ইংরেজ ভারতবর্ষে শান্তিপূর্ণ জীবন ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের আশ্বাস রচনা করেছিল, তা যে কতখানি গ্রহসন, তা ভারতেন্দুর কাছে অজ্ঞাত থাকেনি। বরং মহারানির রাজত্বেও যে সন্ত্রাস জনমনে কালো ছায়া বিস্তার করে আছে, তা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়—

“কঠিন সিপাহী দ্রোহ অনল জা জলবল নাসী। 

জিন ভয় সির ন হিলাই সকত কহুঁ ভারতবাসী।।”

যে ‘বিজয় বল্লরী’-কে আফগান-বিজয়ের স্মৃতিতে ভারতেন্দুর রাজভক্তির দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন কেউ কেউ, তার ভিতরেও দেখতে পাওয়া যাবে বিদ্রোহী মনের আগুন। আফগান বিজয় উপলক্ষ্যে সমস্ত দেশে যখন উৎসব হচ্ছে, তখন ভারতেন্দু প্রশ্ন তুলছেন যে, ইংরেজ আফগান যুদ্ধে জয়ী হওয়ায় ভারত কী পেল যে তাকে উৎফুল্ল হতে হবে –

“আর্য গগন কো কা মিলৌ, জো অতি প্রফুলিত গান। 

সবৈ কহত জৈ আজু ক্যো, য়হ নহি জান্যৌ জাত।।”

একইভাবে ইংরেজ-অধীন ভারতীয় সেনা মিশরে বিজয়লাভ করলে ভারতেন্দু সেই বিজয় উপলক্ষ্যে যে কবিতা লেখেন, সেখানে ইংরেজের স্তবগান অপেক্ষা বড়ো হয়ে ওঠে ভারতের অতীত গৌরবকে স্মরণ করে বর্তমান অবস্থার জন্য বেদনাবোধ –

“হায় ওয়হৈ ভারত ভুব ভারী।

সব হো বিধি তেঁ ভঈ দুখারী।।

রোম গ্রীস পুনি নিজ বল পায়ী।

সব বিধি ভারত দুখিত বনায়ী।।

ভারতেন্দু গদ্যে খড়িবোলি হিন্দির পথনির্মাতা হলেও কবিতার ক্ষেত্রে তিনি খড়িবোলিতে স্বচ্ছন্দ হতে পারেন নি। তবে যেহেতু তিনি লোকভাষার লোকপ্রচলিত কবিতার প্রয়োজনীয়তাকে জাতীয় প্রয়োজনেই স্বীকার করে নিচ্ছেন, সেহেতু লোকমান্য হিন্দি বা খড়িবোলি ভাষার কবিতার ভবিষ্যৎকেও কার্যত গড়ে দিচ্ছেন ভারতেন্দুই।

ভারতেন্দুর কাছে সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, স্বদেশচিন্তা কোনো পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না। রামবিলাস শর্মার মতে— “সাহিত্য, পত্রকার কলা ঔর দেশসেবা—য়ে ভারতেন্দু কে লিয়ে অলক-অলগ চীজেঁ নহী থী। ইনকা আপস মেঁ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থা। ভারতেন্দু শুদ্ধ কলা কে উপাসক ন থে: ওয়হ সোদ্দেশ্য সাহিত্য কে হামী থে। ইসীলিএ উনকা ব্যক্তিত্ব ভী শুদ্ধ সাহিত্যকার কা ন হোকর এক সমাজসেবী কার্যকৰ্ত্তা কা থা।”

অতএব ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের কবিপ্রতিভা বিচার করতে গেলে তাঁর সামগ্রিক প্রাগ্রসর মানসিকতার পরিচয়টিই বিচার করতে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারতেন্দু এবং তাঁকে ঘিরে যে কবি-মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল, তাঁদের রচনায়, অস্তবিষয়ের পরিবর্তে বাহ্য-বর্ণনারই প্রাধান্য। কবিতায় হৃদয়ানুভূতির ব্যঞ্ছনা বা অন্তর্ভাবেরহ প্রকাশকের জন্য হিন্দি কাব্য-পাঠককে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। হিন্দি কবিতায় ছায়াবাদের অস্পষ্ট ছায়া প্রকাশিত হতে শুরু করেছে মৈথিলীশরণ গুপ্তের কবিতায় এবং অতঃপর জয়শংকর প্রসাদও নিরালার কাব্যে অন্তঃপ্রকৃতির ব্যখনাময় অভিব্যক্তির পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। তবে অন্তত হিন্দি সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবযুগের নকিব হিসাবে আধুনিক মানসের যে শুভ সূচনা ঘটেছিল ভারতেন্দুর জীবন, কর্ম ও সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে, তা আসলে আধুনিক হিন্দি কবিতারও বদ্ধ গুহামুখকে উন্মুক্ত করেছে।