ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগের মতােই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিচার বিভাগকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। অধ্যাপক গার্নারের ভাষায়, বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান এবং উপায়সমূহ ছাড়া একটি সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা ও অসম্ভব (“…a civilized state without Judicial organs and machinery is hardly conceivable.”)। বিচার বিভাগ যে কাজটা করে সেটিকে বাদ দিলে সভ্যতার আলাে নিভে যাবে। অধ্যাপক লর্ড ব্রাইস মনে করেন, কোনাে রাষ্ট্রের উৎকর্ষতার পরীক্ষা তার বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা ভিন্ন অন্য কিছুর দ্বারা প্রমাণিত হয় না (“There is no better test of the excellence of Government than efficiency of its Judicial system.”)। তিনি আরও বলেন যে, ন্যায়বিচারের দীপশিখাটি অন্ধকারের মধ্যে নিভে গেলে কী ভীষণ সেই অন্ধকার (“If the Lamp of justice goes out in darkness, how great is the darkness”) অধ্যাপক অ্যালান বল বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সাধারণভাবে বলা যায়, শাসন বিভাগ যেমন আইন বিভাগ প্রণীত আইনকে বাস্তবে রূপায়িত করে, বিচার বিভাগের কাজ তেমনি আইনকে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা এবং আইনকে রক্ষার ব্যবস্থা করা। বাস্তবে বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা করে এবং সরকারের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বা ব্যক্তির সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরােধ দেখা দিলে প্রচলিত আইন অনুসারে তার মীমাংসা করে। এই দায়িত্ব যাদের উপর থাকে তাদের বিচারক বলা হয়। বিচারকদের নিয়েই সমগ্র বিচার বিভাগ গঠিত হয়।
[1] অধ্যাপক অ্যালান বলের ব্যাখ্যা : অধ্যাপক অ্যালান বল বিচার বিভাগের কার্যাবলিকে আদালতের কার্যাবলির পরিপ্রেক্ষিতে ভাগ করেছেন, যেমন― (a) প্রশাসনিক আদালতের কাজ, (b) সাংবিধানিক আদালতের কাজ, (c) দেওয়ানি আদালতের কাজ এবং (d) ফৌজদারি আদালতের কাজ।
- (a) প্রশাসনিক আদালতের কাজ: প্রশাসনিক আদালতের কাজ হল প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের বিচার করা।
- (b) সাংবিধানিক আদালতের কাজ: সাংবিধানিক আদালতের কাজ হল সংবিধান ব্যাখ্যা এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরােধের মীমাংসা, প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করা এবং ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা।
- (c) দেওয়ানি আদালতের কাজ: দেওয়ানি আদালতের কাজ হল ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বিরােধ দেখা, তার মীমাংসা করা এবং ব্যক্তিগত সমস্যা দেখা দিলে তার আইনগত সমাধান করা।
- (d) ফৌজদারি আদালতের কাজ: ফৌজদারি আদালতের কাজ হল কোনাে ব্যক্তি আইন ভঙ্গ করলে তার শাস্তির বিধান অর্থাৎ আইন ও শৃঙ্খলারক্ষায় শাসন বিভাগকে সাহায্য করা।
[2] আইনের সৃষ্টি: বিচার বিভাগ কেবলমাত্র আইনের ব্যাখ্যা ও আইন প্রয়োগ করে না, তারা অনেকসময় নতুন আইন ও সৃষ্টি করে থাকে। পরবর্তীকালে অনুরূপ ক্ষেত্রে বিচারকদের স্ববিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত নজির হিসেবে প্রকাশলাভ করেছে।
[3] আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়ােগ: বিচার বিভাগ আইন বিভাগ প্রণীত বিভিন্ন (দেওয়ানি এবং ফৌজদারি) আইনের ব্যাখ্যা করে, আইন ভঙ্গ হলে বিরুদ্ধে শাস্তি প্রয়ােগের ব্যবস্থা করে। শাসনবিভাগীয় নির্দেশ পর্যালােচনার দায়িত্ব মূলত বিচার বিভাগের উপরই ন্যস্ত থাকে।
[4] সংবিধানের ব্যাখ্যা ও আইনের বৈধতা পর্যালােচনা: আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সংবিধানের ব্যাখ্যা করা এবং আইনসভা-প্রণীত আইন এবং শাসন বিভাগ প্রদত্ত নির্দেশ যথাযথ সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসারে রচিত হয়েছে কি না তার বৈধতা বিচার করা। এর দ্বারা সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা পায়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতকে সংবিধানের অভিভাবক ও ব্যাখ্যাকর্তা বলে অভিহিত করা হয়।
[5] নাগরিক অধিকার রক্ষা: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণ আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করে বিচার বিভাগ। সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালত লেখ, নির্দেশ বা আদেশ জারি করতে পারে। বিচার বিভাগের এই ধরনের বিশেষ ক্ষমতা দেখা যায় ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
[6] মৌলিক অধিকারসমূহের রক্ষাকর্তা: যেসব দেশের সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সমূহ লিপিবদ্ধ আছে সেসব দেশে বিচার বিভাগ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে। বিচার বিভাগ বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ প্রতিষেধ, উৎপ্রেষণ এবং অধিকার পৃচ্ছা প্রভৃতি আদেশ, নির্দেশ বা লেখ (Writ) জারি করতে পারে।
[7] বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরােধ নিষ্পত্তি: বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরােধ দেখা দিলে তার মীমাংসা করে বিচার বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে বা কেন্দ্রের মধ্যে অঙ্গরাজ্যের বিরােধ উপস্থিত হলে তার মীমাংসা করে বিচার বিভাগ। মূলত সাংবিধানিক উপায়ে বা সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সব বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটায়।
[8] শাসন বিভাগকে পরামর্শদান: কোন কোনাে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে প্রয়ােজনে পরামর্শ দান করে থাকে। যেমন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যদি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চান তাহলে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান সংক্রান্ত কোনাে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারে। তবে তা মেনে চলা রাষ্ট্রপতির পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়।
[9] রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ: আধুনিক রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের অন্যতম কাজ হল প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থন ও সংরক্ষণ। বিচার বিভাগ বহুক্ষেত্রেই সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্তকে বৈধ ঘােষণা করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। সংবিধান ব্যাখ্যার দ্বারা বিচার বিভাগকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছে যে দেশগুলি সেই দেশগুলি হল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি প্রভৃতি।
[10] অন্যান্য কাজ: উপরোক্ত কার্যাবলি ছাড়াও বিচার বিভাগ আরও অনেক শাসন বিভাগীয় কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। যেমন – নাবালকের অভিভাবক নিয়ােগ ও সম্পত্তি রক্ষা, মৃত ব্যক্তির উইল অনুমােদন, লাইসেন্স প্রদান, দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আদায়কারীর ভূমিকা পালন ইত্যাদি।
মূল্যায়ন: বিচার বিভাগ কী কাজ করে, তার সঙ্গে বিচার বিভাগের ভূমিকার প্রশ্নটি জড়িত। সকল আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় আইনসভা ও শাসন বিভাগ যেসকল আইন বা নিয়মকানুন রচনা করে, তা আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। তাই সেইসকল আইন সঠিকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তা ছাড়া উক্ত আইন বা নিয়ম অন্যান্য আইন বা নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, বিচার বিভাগের কাজ এগুলি সমীক্ষা করে দেখা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যালমন্ড এবং পাওয়েল একে বলেছেন, ‘Rule adjudication’বিচার বিভাগের এই মূল কাজটি লক্ষ করলে আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের গুরুত্ব ও ভূমিকা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
Leave a comment