প্রশ্নঃ আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রের আইনসভা কী কী কার্যাবলি সম্পাদন করে?

অথবা, আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার প্রভাব ও কার্যাবলি উল্লেখ কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক সরকারের কার্যকাল তিনটি বিভাগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এগুলো হলো আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগ বা আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শাসন বিভাগ আইন বিভাগে প্রণীত আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং বিচার বিভাগ আইন বিভাগ প্রণীত আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে। আইনসভার গুরুত্ব সম্পর্কে Prof. Laski বলেন, “The function of legislation is not only function of parliament. Its real function is to watch the process of administration to safeguard the liberties of private citizens.”

আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিঃ নিম্নে আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা করা হলো-

১. আইন প্রণয়নঃ আইনসভা সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এর প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা। সংবিধান ও আইনের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে আইনসভাকে আইন প্রণয়ন কার্যসম্পাদন করতে হয়। জনগণের ইচ্ছা ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সংগতি রেখে আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইন বাতিল বা সংশোধন করে।

২. শাসন সংক্রান্ত কাজঃ শাসন বিভাগীয় অনেক কার্যাবলি আইনসভার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। শাসন বিভাগ তাদের যাবতীয় কার্যাবলির জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়ী থাকে।

৩. বিচার সংক্রান্ত কাজঃ আইনসভা অনেক সময় বিচার সংক্রান্ত কাজ করে থাকে। যেমন- কোন কোন দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের অভিযুক্ত করা ও বিচার করার ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকে। আবার কোন কোন দেশের রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিচারের ক্ষমতা আইনসভার উপর ন্যস্ত।

৪. সংবিধান রচনা ও সংশোধনঃ আইনসভা যে কোন দেশের সংবিধান রচনা করে। প্রয়োজনে সংবিধানের যে কোন অংশ পরিবর্তন, সংশোধন ও বাতিল করতে পারে।

৫. জনগণের মতামত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্বঃ আইনসভা একটি জাতীয় ফোরাম। এখানে জনপ্রতিনিধিগণের বিতর্ক, সরকার কি করছে এবং ভবিষ্যতে কি করবে তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়। জনগণের মতামত আইনসভাতে তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়।

৬. অর্থসংক্রান্ত কাজঃ সকল প্রকার অর্থ বিল আইনসভায় উত্থাপিত হয়। বাৎসরিক বাজেট আইনসভায় উত্থাপিত হয়ে সরকারি এবং বিরোধী দলের সদস্যদের আলাপ আলোচনার পর তা পাস হয়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার কর, রাজস্ব কিভাবে ধার্য এবং আদায় হবে তা আইনসভাই ঠিক করে। আইনসভার বিভিন্ন রকম কমিটির মাধ্যমে সরকারি অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে।

৭. সংযোগ সাধনের কার্যঃ আইনসভা সরকার এবং জনগণের মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করে। জনগণের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আইনসভার সদস্যরা সরকারকে অবহিত করেন এবং সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কার্যাবলি সম্পর্কে জনগণ অবগত হতে পারে আইনসভার মাধ্যমে।

৮. শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণঃ শাসন বিভাগ তাদের কাজের জন্য আইন বিভাগের নিকট দায়ী থাকে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় আইনসভা শাসন বিভাগের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, অনাস্থা প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব ও মুলতুবি প্রস্তাবের মাধ্যমে আইনসভা শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৯. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজঃ বিভিন্ন উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আইনসভা নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল অ্যাসেম্বলি কর্তৃক ফেডারেল কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইনসভায়ই করে থাকে। ভারতেও রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইনসভার বিশেষ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।

১০. সরকার গঠনঃ আইনসভার সদস্য নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সে দলই সরকার গঠন করে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ মূলত আইনসভা থেকেই নির্বাচিত হন।

১১. সমালোচনামূলক কাজঃ আইনসভার মাধ্যমে সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা হয়। বিরোধী দল আইনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের কাজকর্মের সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে চালিত করে।

১২. আলোচনামূলক কাজঃ আইনসভায় ব্যাপকভাবে আলাপ আলোচনা ছাড়া কোন আইন পাস হতে পারে কোন ধরনের খসড়া বিল আইনসভায় উত্থাপিত হয় এবং জনপ্রতিনিধিরা দেশের অবস্থা এবং চাহিদার উপর ভিত্তি করে উত্থাপিত বিলের উপর আলোচনা এবং মতামত ব্যক্ত করেন।

১৩. সরকারি নীতি প্রণয়নঃ আইনসভা সরকারি নীতি প্রণয়ন করে থাকে। সহজকথায় বলা যায়, সরকার কি করবে, সরকারি নীতি কি হবে, এসব বিষয়ের সাথেই আইনসভার কাজ সংশ্লিষ্ট থাকে। এ নীতিসমূহ প্রণয়নে আইনসভা কতকগুলো উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন- রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি, জাতীয় ঐতিহ্য, বিভিন্ন স্বার্থবাদী বক্তব্য এবং সাধারণ জনমত।

১৪. অনুসন্ধানমূলক কাজঃ আইনসভার কিছু কিছু অনুসন্ধানমূলক কাজও রয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং মন্ত্রিপরিষদ শাসিত উভয় সরকার ব্যবস্থাতে আইনসভা বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এ কার্যসম্পাদন করে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, এসব কারণের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগ অধিক ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগতভাবে একথা ঠিক বাস্তবে কিন্তু নানা কারণে আইনসভার গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। আগেকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমূলক রাষ্ট্রের পরিবর্তে বর্তমানে জনকল্যাণমূলক সক্রিয় ও কর্মমুখর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার ফলশ্রুতি হিসেবে সরকারের দায়দায়িত্ব এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সাথে সাথে আইনসভার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।