ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের অন্যতম বিভাগ বা অঙ্গ হল আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, অ্যারিস্টটলের সময় থেকে সাধারণত মনে করা হয় যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত যথা আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা, কার্যনির্বাহী ক্ষমতা এবং বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা (“Since the time of Aristotle it has been generally agreed that political power is divided into three broad categories … there is, first the Legislative power, there is secondly, the Executive power, there is thirdly the Judicial power.”) রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকারের আইনসভার ভূমিকা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম হয়। তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকারের কার্যাবলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一

  • (১) আইন বিভাগ (আইন প্রণয়ন করে),
  • (২) শাসন বিভাগ (আইন প্রয়ােগ করে),
  • (৩) বিচার বিভাগ (বিচারকার্য সম্পাদন করে)।

সরকারের এই তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকালে রাজা স্বয়ং আইন প্রণয়ন করতেন। লিখিত আইন তৈরি হয় অনেক পরে। ‘Modern politics and government’ শীর্ষক গ্রন্থে অধ্যাপক অ্যালান বল লিখেছেন, ঐতিহাসিক বিচারে আইনসভার উদ্ভব হয়েছে শাসন বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে (“..historically assemblies have emerged from the executives need for advisory bodies.”) অধ্যাপক গার্নার মনে  করেন যে, যেসকল বিভাগের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রের ইচ্ছা ব্যক্ত ও প্রযুক্ত হয় তার মধ্যে আইন বিভাগের স্থান সবার উপরে। যাইহােক আইন বিভাগ শাসন বিভাগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তা নিম্নে বিশ্লেষণ করা হল।

আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার কার্যাবলি শুধুমাত্র আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আইনসভাকে বর্তমানে বহুমুখী কার্য সম্পাদন করতে হয়। আইন বিভাগ কীভাবে শাসন বিভাগের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, তা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের প্রথমেই মনে রাখা প্রয়ােজন যে সাংবিধানিক কাঠামাে, দল ব্যবস্থার প্রকৃতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক, অর্থনৈতিক গতিশীলতা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি, সাংস্কৃতিক বিকাশের স্তরভেদ ইত্যাদি আইনসভার প্রকৃতি নির্ধারণে এবং শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

(১) সরকার গঠনের মাধ্যমে আইনসভার নিয়ন্ত্রণ: শাসন বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আইনসভার অন্যতম কাজ হল সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করা।

  • সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার গঠন: সংসদীয় ব্যবস্থায় দু-ধরনের শাসকপ্রধান দেখা যায়। যথা সরকারের প্রধান (Head of the Government), রাষ্ট্রপ্রধান (Head of the State)। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচন ও নিয়ােগের ক্ষেত্রে আইনসভার তেমন কোনাে ভূমিকা থাকে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ভিতর থেকেই শাসকপ্রধান নির্বাচিত হন। তবে কোয়ালিশন সরকার হলে ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারের সাংবিধানিক প্রধান হল আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতে পার্লামেন্ট বা আইনসভা রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন ও অপসারণের ক্ষমতা ভােগ করে। আবার রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করতে বা লােকসভা ভেঙে দিতে পারেন।
  • রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসন ব্যবস্থায় শাসক প্রধান নিয়ােগে আইনসভার ভূমিকা: এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও আইনসভার কিছু ভূমিকা থাকে। কোনাে কোনাে দেশে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ ফিলিপিন্স রাষ্ট্রের কথা বলা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি উচ্চপদস্থ সকল আধিকারিক নিয়ােগের জন্য আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমােদন প্রয়ােজন।

(২) সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ: মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আইনসভা (লোকসভা) অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে পারে। আবার রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা (কংগ্রেস) রাষ্ট্রপতির কার্যকাল ৪ বছর শেষ হওয়ার আগেই তাকে ইমপিচমেন্ট পদ্ধতির সাহায্যে অপসারণ করতে পারে। দেশের শাসন বিভাগের প্রধানকে নিয়ােগ ও পদচ্যুত করার ব্যাপারে আইনসভার ক্ষমতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক অ্যালান বলের ভাষায়, আইনসভার এই ক্ষমতা হল নেতিবাচক ক্ষমতা।

(৩) শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তিনটি উপায়: শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনসভার তিনটি সংসদীয় পদ্ধতি প্রকরণ বা উপায় পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল一 (a) প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, (b) বিতর্ক, (c) সমালােচনা। আইনসভার সরকারি কার্যাবলি সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিতর্ক ও সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

(৪) অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনসভার অনুসন্ধানমূলক ক্ষমতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক অ্যালান বল এই নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে ‘break on the Government motor’ বলে অভিহিত করেছেন। সংসদীয় এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত উভয় ধরনের শাসন বিভাগের বিরুদ্ধে আইনসভা এই নিয়ন্ত্রণূলক ক্ষমতা ভোগ করে।

(৫) সরকারের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: সরকারের আয়-ব্যয়, বাজেট, কর ধার্য, কর সংগ্রহ ইত্যাদি ব্যাপারে আইনসভার নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা সকল প্রকার বিরােধ-বিতর্কের উর্ধ্বে। প্রসঙ্গে অধ্যাপক অ্যালান বলের ‘Modern Politics and Government’ শীর্ষক গ্রন্থের বক্তব্য স্মরণীয়। তিনি বলেছেন যে, সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থের জোগান বহুদিন ধরেই একটি সভার পারস্পরিক হাতিয়ার রূপে চলে আসছে, যা সরকারের নীতিসমূহ উপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার চেষ্টা করে (“Supply of money for government spending has been a traditional weapon in an assembly’s arsenal in seeking to exercise some control over government policies.”)I পরিশেষে বলা যায় যে, আইন বিভাগের উপরােক্ত ভূমিকার মাধ্যমে আইনসভা শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে থাকে।

আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা | আধুনিক রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের কার্যাবলি

বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা | বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা সংরক্ষিত |  বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা রক্ষা

আধুনিক রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের গুরুত্ব আলােচনা করাে।