কবি কাব্য ও কবিতা
পুনশ্চ (১৯৩২)
গ্রন্থকার : কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গ্রন্থরূপ : কবির অন্ত্যপর্বের কাব্যগ্রন্থ।
বিষয় : ‘পুনশ্চ’ থেকে আরম্ভ করে ‘শেষ লেখা পর্যন্ত গ্রন্থগুলিকে রবীন্দ্র জীবনের শেষ পর্যায়ের কাব্য বলা যেতে পারে। জগৎ ও জীবনের প্রতি কবির বিশেষ অনুরাগ, বাস্তবের মধ্যে বিচিত্র রসের সন্ধান, সম্মুখে প্রসারিত বিশ্ব ভুবনকে দু’চোখ মেলে অতৃপ্ত তৃষ্মায় চেয়ে দেখা, সাধারণ সামান্য মানুষকে অমেয় প্রীতির চোখে দেখা কীটপতঙ্গ আদি মানবেতর প্রাণী বিষয়ে অশেষ কৌতূহল পরায়ণতা ইত্যাদি এই পুনশ্চ কাব্যে উঁকি দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ নুতনত্বের ও বৈচিত্রের সন্ধানী। তিনি গদ্য কবিতা সৃষ্টি করলেন, প্রচলিত ছন্দ রীতিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে। কাব্যে গদ্যের স্বভাবোক্তির আশ্রয় নিলেন। তাঁর ভাষা গৃহস্থ, পাড়ার ভাষা, ছন্দের তেমন জাঁক জমক নেই। আগে যে সব বস্তুকে কবি অস্পৃশ্য বলে জেনেছেন এখন তারাই তাঁর কাব্যে এসে ভীড় জমিয়েছে। যেমন—ভবঘুরে কুকুর, ছেঁড়া কাঁথা, মাসিক তিনটাকা মাইনের পণ্ডিত, কোলাব্যাঙ, গোবরের পোকা ইত্যাদি, এই কাব্যে মানুষের অনুভূতিকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন, অতি সাধারণ মানুষ সংসারের তুচ্ছ সমাজে অবহেলিত এবং জীবনের ক্ষেত্রে বিড়ম্বিত এই রকম সাধারণ মানুষের প্রতি কবির দরদ যে কতখানি তা ছেলেটা, সহযাত্রী, শেষদান, বালক, সাধারণ মেয়ে, বাঁশি, একজন প্রভৃতি কবিতা পড়লেই বোঝা যাবে। এখানে শুধু যে সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের কথাই ব্যক্ত হয়েছে—তা নয়, এই কবিতাগুলির বাস্তবধর্মিতা এবং গার্হস্থরস এক অমূল্য সম্পদ। তাছাড়া এই গ্রন্থের কাহিনি কাব্যগুলির এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে শুধু কাহিনির বর্ণনাই কবিতাকে উজ্জ্বলতা দান করেনি, প্রত্যেকটি গল্পেই আশ্চর্যরকম বাস্তব রস সেই কাহিনিকে মহিমান্বিত করেছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
‘পুনশ্চ’ শেষ সপ্তক, পত্রপুট, শ্যামলী—এই চারখানি কাব্যে রবীন্দ্রনাথ গদ্যছন্দ ব্যবহার করেছেন। তাঁর পদ্য ছন্দে নির্মিত কবিতাগুলি বিষয় বৈচিত্রে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি গদ্যছন্দের কবিতাগুলিতে, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও কবি যে সৃজন ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন, তা আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। সর্বব্যাপী সামান্যের সচল স্পর্শ পাওয়ার জন্য কবির মন যে কতটা ব্যাকুল তা ‘পুনশ্চ’র কবিতাগুলি পাঠ করলেই উপলব্ধি করা যায়। এই কাব্যে কবি মানুষকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি বার বার আমাদের জানিয়েছেন—‘আমি তোমাদেরই লোক। সাধারণ মানুষের কবি বলেই তাঁর নাম ‘খ্যাত হোক’—এই কবির মনোগত বাসনা। বস্তু-নির্ভর রসের প্রাধান্য এবং উদার মানবিকতা ‘পুনশ্চ’ কাব্যের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩)
গ্রন্থকার : প্রমথ চৌধুরী।
গ্রন্থরূপ : কবিতা সঙ্কলন, সনেটগুচ্ছ বলাই শ্রেয়।
বিষয়ঃ সনেট রচনায় প্রমথ চৌধুরী বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শণ করেছিলেন। ভাবালুতা বর্জিত বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যঙ্গ বিদ্রুপে, সযত্ন শব্দচয়নে, ভাষা ও ভঙ্গির কঠিন দীপ্তিকে এবং গাঢ় রচনা বন্ধে তাঁর সনেটগুলি অনন্য। ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “বাংলায় এ জাতের কবিতা আমিতো দেখি না। এর কোন লাইনটি ব্যর্থ নয়, কোথাও ফাকি নাই—এ যেন ইষ্পাতের ছুরি, হাতির দাঁতের বাটগুলি জহুরির নিপুণ হাতের কাজ করা, ফলাগুলি ওস্তাদের হাতের তৈরি …. বাংলা সরস্বতীর বীণায় এ যেন তুমি ইষ্পাতের তার চড়িয়ে দিয়েছো।” অবশ্য স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের অভাবের জন্য প্রমথ চৌধুরীর কবিতাগুলি আমাদের হৃদয়কে গভীর ভাবে স্পর্শ করে না।
রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রমথ চৌধুরী গীতি কাব্যের মাধ্যম হিসাবে সনেট কলা কৃতিকে বিশেষ গুরুত্বদান করেছিলেন। তাঁর সাতটি কাব্য গ্রন্থে ১২৩টি চতুর্দশ পদের কবিতা সংকলিত হয়েছে। তবে সনেটের স্তবক গঠনে তিনি শেক্সপীয়ারের রীতিকে ঘনিষ্ট ভাবে অনুসরণ করেছেন। ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও তিনি খাঁটি শেক্সপীয়রীয় সনেট রচনায় যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
কেন উল্লেখযোগ্য :
বাংলা সনেটের বিষয় বৈচিত্রের ঐতিহ্য প্রমথ চৌধুরী রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের ভক্তি-রস প্লাবিত ও আনুগত্য মন্থর মনোরাজ্যে তিনি ফরাসি দেশসুলভ লঘু চপল ব্যঙ্গ প্রিয়তা ও মার্জিত রুচির পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা কাব্যে এর গোত্র আলাদা, কবিতায় গদ্য শিল্পীর মেজােজ রয়েছে।
বৃত্রসংহার (১৮৭৫-১ম খণ্ড, ১৮৭৭-২য় খণ্ড)
গ্রন্থকার : হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ্রন্থরূপ : আখ্যান কাব্য।
বিষয় : ‘বৃত্রসংহার’ পুরাণ কাহিনি অবলম্বনে রচিত। কাঠামোটি পুরাণাশ্রয়ী হলেও এর রূপাদর্শে পাশ্চাত্য এপিক রীতির প্রভাব লক্ষিত হয়। এই কাব্যটিতে কবি মধুসূদনের প্রদর্শিত পথে পদক্ষেপ করেছেন। এ কাব্যের মূল বিষয় দধীচি মুনির অস্থিতে বজ্রাস্ত্র নির্মাণ করে সেই ভয়াল অস্ত্রে বৃত্রাসুরকে বধ করা। জগৎবাসীর কল্যাণে দধীচির আত্মত্যাগ, স্বর্গের অধিকার নিয়ে দেবদানবের সংগ্রাম, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, সূর্যালোক, চন্দ্রালোক, কুমেরু সুমেরু প্রভৃতির বর্ণনা, ঘটনার প্রাচুর্য, বীর ও রৌদ্র রসের ছড়াছড়ি—মহাকাব্যের উপযোগী বিপুলতা ও গাম্ভীর্যের সমস্ত উপকরণই এখানে সংগৃহীত।
কেন উল্লেখযোগ্য :
বৃত্রসংহারের আখ্যান বস্তু মহাকাব্যের উপযোগী; এতে কাহিনি পরিকল্পনার বিশালতা আছে, সুউচ্চ নৈতিক ভাবাদর্শের রূপায়ণ আছে, বর্ণনার গাম্ভীর্য আছে, বর্ণনীয় বিষয়ের চিত্ত সমুন্নতিজনক মহিমা আছে। তবু আমরা বলবো, শিল্পকৃতি হিসাবে একাব্যের মূল্য খুব বেশি নয়। এ যেন মহাকাব্যের একখানি কঙ্কাল। এতে প্রাণের উত্তাপ নেই, গূঢ়সঞ্চারী রসাত্মার স্পন্দন এখানে অতিশয় ক্ষীণ। হেমচন্দ্র মধুসূদনের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন, তাঁর সে প্রয়াস সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তিনি মনে করেছিলেন, একটি বড়ো ঘটনাকে ছন্দে গাঁথতে পারলে তা মহাকাব্য হয়ে যায়। তা সম্পূর্ণ রূপে ভুল। মহাকাব্যের ক্ষেত্রে কাহিনির বিশালতা আর বিষয় বস্তুর মহিমা বড় কথা নয়, এর রস রূপ নির্মাণের জন্য যথোচিত ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার ইত্যাদি সামগ্রীর দিকে তাকাতে হয়। এই গ্রন্থে প্রকাশ ভঙ্গীর চারুতা নেই, কারুকলার কোনও পরিচয় নেই।
পলাশির যুদ্ধ (১৭৭৫)
গ্রন্থকার : নবীনচন্দ্র সেন।
গ্রন্থরূপ : আখ্যান কাব্য।
বিষয় : ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশির আম্রকাননে নবাব সিরাজদৌল্লার সঙ্গে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সৈন্য বাহিনীদের সংঘর্ষের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় এই স্বদেশিক আখ্যান কাব্য। সিরাজের নবাবী মসনদ থেকে অপসারণের জন্য জগৎ শেঠ, মীরজাফর প্রভৃতির ষড়যন্ত্র, রবার্ট ক্লাইভের সেই ষড়যন্ত্রের সুযোগ গ্রহণ, মীরজাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় পলাশির মাঠে সিরাজের পরাজয় ও পলায়ন, তার পরে ধরা পড়া এবং মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা, শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা—এই হল ‘পলাশির যুদ্ধ’ কাব্যটির মূল কাহিনি।
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। এই কাব্যের ঘটনা রূপায়ণে, কবির স্বদেশ ভাবনার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্য প্রকাশিত হওয়ার পর নবীনচন্দ্র সেন কবি রূপে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তরুণ বয়সে রচিত কাব্যটির মধ্যে আবেগের আতিশয্য আছে। ইতিহাসের বস্তু সত্য ও কল্পনার কাব্য-সত্যের মিলনেও হয়তো বাধা ঘটেছে। তবু এর উচ্ছ্বসিত স্বদেশ প্রেম এক সময় বাঙালি পাঠককে উদ্বুদ্ধ করেছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের প্রেরণা দিয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে স্কুল পাঠ্যক্রমরূপে মর্যাদা পেয়েছিল। এমনকি ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনির মত এই কাব্য আবৃত্তি করার অপরাধে স্বদেশী আন্দোলনের সময় বৃটিশ শাসকের কাছ থেকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।
২। বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং এই কাব্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন ঃ “পলাশির যুদ্ধে উপাখ্যান ও নাটকের ভাগ অতি অল্প, গীতি অতি প্রবল। নবীনবাবু বর্ণনায় এবং গীতিতে একপ্রকার সিদ্ধহস্ত। সেই জন্য ‘পলাশির যুদ্ধ’ এত মনোহর হইয়াছে।”
৩। ছন্দ ও ধ্বনি ঝংকারের চমকে রণক্ষেত্রে অসির ঝনৎকার এবং বীরত্ব গৌরব মূর্ত হয়ে উঠেছে :
“বৃটিশের রণবাদ্য বাজিল অমনি—
কাঁপাইয়া রণস্থল
কাঁপাইয়া গঙ্গাজল,
কাঁপাইয়া আম্রবন উঠিল সে ধ্বনি।।”
অগ্নিবীণা (১৯২২)
গ্রন্থকার : কাজী নজরুল ইসলাম।
গ্রন্থরূপঃ কাব্যগ্রন্থ, কবির প্রথম কাব্য।
বিষয় : অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতা ‘বিজলী’ ‘মোসলেম ভারত’ ‘উপাসনা’ ধূমকেতু’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অগ্নিবীণা নামটি খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ৫৫ সংখ্যক কবিতা থেকে নেওয়া। এই কাব্যের ভাব ভাষা ও ছন্দের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। প্রভাব থাকলেও কবি মনের দূরন্ত প্রাণ প্রাচুর্য, অদম্য তারুণ্য, প্রবল তেজস্বিতা, সমাজ জীবনের অবিচার অনাচারের প্রত্যক্ষ অনুভূতিজনিত তীব্র যন্ত্রণা প্রভৃতি যোগে কাব্য আবেদন সন্দেহাতীত ভাবে একটা নিজস্ব রূপে পেয়েছে। বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়াও এই কাব্যে প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বর ‘ধাবিনী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি আরও ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই কাব্যের কবিতাগুলিকে মোটামুটি চারটি ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত করা চলে। যেমন—
(১) আত্মোপলব্ধি মূলক কবিতা।
(২) ভারতবাসীর চিত্তে দেশাত্মবোধ জাগরণের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতা।
(৩) নতুন জীবন ও নতুন সম্ভাবনার মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উল্লসিত কবিতা,
(৪) ধর্মমূলক চেতনার অভিব্যক্তির কবিতা।
বিদ্রোহী, কামাল পাশা, প্রলয়োল্লাস, খেয়া পারের তরণী—কবিতাগুলিকে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত কবিতা হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
আধুনিক কবিদের কাব্য সাধনায় যে দেশপ্রেম, সমাজ সচেতনতা ও মানবিকতার প্রকাশ দেখা যায় তা কবি নজরুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই অর্থে নজরুল তাঁর যুগের কবি হয়েও তিনি হয়ে উঠেছেন যুগোত্তর কবি। যুগাতিশয়ী হয়েও তিনি যুগাতিক্রমী। সেদিক দিয়ে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মূল্য অপরিসীম।
ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)
গ্রন্থকার : জীবনানন্দ দাশ।
গ্রন্থরূপ : কাব্যগ্রন্থ (কবিতা সংকলন)
বিষয় : জীবনানন্দ প্রকৃতির কবি। তাঁর কাব্য কবিতার অঙ্গীরস হল প্রেম। চোখে প্রেমের মায়াঞ্জন পরেই সৌন্দর্য্য মুগ্ধ কবি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতিকে। তিনি মানুষকে ভালোবেসেই পেয়েছিলেন প্রকৃতিকে। প্রকৃতির মধ্যেই তাঁর বেদনার মুক্তি। তাই নিঃসীম আকাশের নীলিমায় জীবনের সব ধূসরতা লীন হয়ে যায়। এ কাব্যের ‘অবসরের ‘গান’ কবিতায় কবি বলেছেনঃ “শহর—বন্দর—বস্তি—কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে শরীরের অবসাদ—হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে।”
প্রকৃতি কবির ক্লান্ত ব্যথিত চিত্তকে শুশ্রুষার গান শুনিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে কবির এক নিবিড় একাত্মতা গড়ে উঠেছিল। চাঁদ তাঁর দিকে তাকিয়ে যে ভাষায় কথা বলে তা অন্তরঙ্গ আত্মীয়েরই ভাষা, বরং মানুষকে ভালোবেসে কবি যা পাননি, প্রকৃতির মধ্যে তা পেয়েছেন। তাই তাঁর দৃষ্টিতে—“ভোরের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল।”
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি-প্রীতির কাব্য।
২। প্রকৃতিকে তিনি প্রিয়া রূপে কল্পনা করেছেন।
৩। প্রকৃতি কবির চোখে অপরূপা সুন্দরী রূপে প্রতিভাত।
৪। এমন চিত্রকল্প অন্য কোনও কবির কাব্যে দৃষ্ট হয় না।
৫। এ কাব্যের কবিতাগুলিতে কবি রূপের জগতে প্রাণের ঝরনা ধারায় যে জীবনের মাধুর্য আহরণ করেছিলেন তা তুলনা রহিত।
চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৫)
গ্রন্থকার : মধুসূদন দত্ত।
গ্রন্থরূপ : সনেট।
বিষয় : মধুসূদনের শেষ সম্পূর্ণ ও সার্থক কাব্যগ্রন্থ। সমগ্র কবিতার সংখ্যা ১০২। বিষয়-বিন্যাসের দিক থেকে লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন পুরাণের কোনও কাহিনি (যেমন—কমলে কামিনী, ‘ঈশ্বর পাটনী’) কোনও সাধারণ বস্তু বর্ণনা (যেমন—গদাযুদ্ধ, মধুকর) নীতি ও ধর্মশিক্ষামূলক কবিতা (দ্বেষ, সাংসারিক জ্ঞান) কোন ভাব বা তত্ত্বরূপক (যশের মাতন্দর, বীররস) দেশীয় কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন (বাল্মিকী, জয়দেব, কৃত্তিবাস) ধর্ম বিশ্বাস (সৃষ্টিকৰ্ত্তা, পরলোক) নিসর্গ বড়ুর বর্ণনা (বউ কথা কও; কপোতাক্ষনদ) বঙ্গদেশের পালা পার্বণ ও উৎসব অনুষ্ঠান (বিজয়া দশমী, শ্রীপণামী) অন্তর্বেদনা (নুতন বৎসর, সমাপ্তি) প্রভৃতি। মাতৃভাষা কবিতাটির মাধ্যমে এই কাব্যের সূচনা হয় স্বদেশ ভূমিতে, যদিও অন্যান্য কবিতাগুলির রচনা ইউরোপে, ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে। কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করে কবি স্বয়ং ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ফ্রান্স থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেনঃ
I dare say, the Sonnet, চতুর্দশপদী will
do wonderfully well in our language.”
কেন উল্লেখযোগ্য :
১। আট ছয় পংক্তিতে বিন্যস্ত ‘সনেট’ নামক এক নতুন ধরনের কবিতা-নির্মাণ রীতি বাংলা কাব্যে প্রচলিত হল। মধুসূদন এই, রীতির প্রথম প্রবর্তন করলেন : “I want to introduce the Sonnet into our language”. ইতালির কবি পেত্রাক সনেটের ধ্যে অষ্টক (Octave) ষটক (Sestet) ভাগ করে কখখক কখখক, গঘগ, ঘগঘ বা গঘঙ গঘঙ ছন্দোমিলে কবিতা লিখে ছিলেন। মধুসূদন সেই রীতিতে লেখেন ‘কমলে কামিনী’ কবিতা।
আবার ইংরেজ কবি শেক্সপীয়ার যেমন তিনটি চতুষ্পদী এবং শেষে সমিল রীতিতে সনেট লিখেছেন, সেই রকম মধু-কবিও লিখেছেন ‘বঙ্গভাষা’ সনেট।
অনুরূপভাবে মিলটনের মতো অষ্টক ষটক রীতির শ্রেণিবিন্যাস না মেনেও লিখেছেন, যেমন—‘বিজয়াদশমী। সুতরাং পেত্রার্কা, শেক্সপীয়ার, মিলটন এই তিন সনেটকারের তিন রকম রীতির প্রকাশ ঘটেছে এই কাব্যে।
২। বিদেশে দুঃখের দিনে সাগরদাঁড়ি গ্রাম, কপোতাক্ষ নদ, নদীতীরে দেবদেউল, মহাভারত কালিদাস—কবিকঙ্কন প্রভৃতি অনুষঙ্গ ও স্বদেশী প্রসঙ্গ স্মরণে এক নস্টালজিক আবেগ যেমন মূর্ত হয়েছে, তেমনি দেখা গেছে দেশহিতৈষা। যেমন— ‘বঙ্গভূমির প্রতি অকপট কাতর স্বীকারোক্তি :
.“নারিনু মা, চিনিতে তোমারে
শৈশবে অবোধ আমি! ডাকিলা যৌবনে :….
৩। সনেট সম্পর্কে মধু কবির ভবিষ্যৎবাণী—“In my humble opinion, if cultivated by men of genius, our Sonnet in time would rival the Italian.” এবং এই কাব্যগ্রন্থের আদর্শ পরবর্ত্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, প্রমথ চৌধুরী, সুশীল কুমার দে প্রমুখ বহু কবিকে সনেট রচনায় অনুপ্রাণিত করে।
বনলতা সেন (১৯৪২)
গ্রন্থকার : জীবনানন্দ দাশ।
গ্রন্থরূপ : কাব্যগ্রন্থ।
বিষয় : বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের কবিতা স্থান পেয়েছে, যেমন দুজন, অঘ্রান প্রান্তরে, হায়চিল, বনলতা সেন, কুড়ি বছর পরে, সবিতা, হাওয়ার রাত, ঘাস, শিকার, আমি যদি হতাম, সুরঞ্জনা প্রভৃতি। এদের মধ্যে কোথাও প্রকৃতি, কোথাও ইতিহাস, কোথাও বা প্রেম এর প্রাধান্য রয়েছে। তবে এই কাব্যের কবিতা বনলতা সেন, রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠতম প্রেম কবিতা। কোনও একটি কবিতা দিয়ে জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কবি সত্তাটিকে যদি চিনতে হয় তাহলে সে কবিতা এই ‘বনলতা সেন’,। তিনটি স্তবক দিয়ে গড়া এই কবিতার মধ্যে কবির স্বপ্ন বৃত্তটি পূর্ণ হয়েছে। কবিতাটিতে কবি নাম, পদবী অবস্থিতি দিয়ে নায়িকাকে ঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন, আবার সেই সঙ্গে তাকে হাজার হাজার বছরের পটভূমিকায় বিস্তৃত করে দিয়ে একান্ত রহস্যময়ী করে তুলেছেন। বনলতা সেনের পাখির নীড়ের মতো চোখে পরম আশ্বাসভরা যে প্রেমের সাক্ষাৎ কবি পেয়েছেন, তার মধ্যেই রয়েছে কবি জীবনের পরম প্রাপ্তি। তারই স্বীকৃতি দিয়ে কবিতাটি শেষ হয়েছে—
সব পাখি ঘরে আসে,
সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার,
মুখোমুখি বসিবার
বনলতা সেন।
কেন উল্লেখযোগ্য :
জীবনানন্দের কাব্য প্রেরণার উৎস নিরবধিকাল ও ধূসর প্রকৃতি চেতনা, তবে সেই প্রকৃতি সব সময় ধূসর নয়। মহাবিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময় চেতনা, তাই তাঁর কাব্য কবিতা আমাদের ভাবায়। ‘বনলতা সেন’ এ প্রমাণিত হল যে, জীবনানন্দ রূপসী বাংলার কবি হয়েও মহাপৃথিবীর কবি। তাই ‘বনলতা সেন’ ও মহাপৃথিবীতে তিনি তাঁর কবি কল্পনার তুঙ্গ শিখরে আরোহণ করেছেন।
বীরাঙ্গনা (১৮৬২)
গ্রন্থকার : মধুসূদন দত্ত
গ্রন্থরূপ : বীরাঙ্গনা হল একটি পত্রকাব্য
বিষয় : এ গ্রন্থে গ্রথিত হয়েছে এগারোজন বীর নায়িকার বিরহ ভাবনা মূলক পত্র, অবশ্য দু একটি পত্রে ভিন্ন সুরের পরিচয় বিধৃত। রোমক কবি ওভিদের (Ovid) হিরোইডস (Heroides) বা ‘এপিষ্টলস অফ হিরোইনস’ এর আদর্শে রচিত। বীরাঙ্গনায় এ কবির কাব্য রীতি কতকটা অনুসৃত হয়েছে। ওভিদ পুরাণ কথিত নায়িকাকে নতুন মূর্তিতে গড়েছেন, মধুসূদন ভারতীয় পুরাণ বর্ণিত কয়েকজন নারীর হৃদয়ের আর্তি ব্যক্ত করেছেন। এই সব নারী পৌরাণিক যুগের, কিন্তু বীরাঙ্গনার ভাবনা আধুনিককালের। কবির কল্পিত চরিত্রগুলি প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্যে দীপ্যমান তাঁদের ব্যক্তিত্ব সুপরিস্ফুট। এই কাব্যে পতি-প্রেমের যেমন উজ্জ্বল আলেখ্য আছে, তেমনি সমাজ অস্বীকৃত প্রেমের শিল্প সমৃদ্ধ রূপায়ণও স্থান পেয়েছে। দুঃশলা, ভানুমতী, শকুন্তলা, রুক্মিনী, সূর্পণখা, তারা, কৈকেয়ী জনা, জাহ্নবী প্রমূখ নারীর বিচিত্র মনোভাবকে কবি কত নিপুণতা সহকারে ছন্দোবদ্ধ করেছেন। এই কাব্যে এগোরোটি পত্র আছে, পত্রগুলি স্বতন্ত্র ক্ষুদ্রাকার কাব্য। সব মিলে এক ভাবগত, ঐক্য আছে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
বীরঙ্গনা কাব্যে নারী চরিত্রের এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বাংলা সাহিত্যে একটি অভিনব সামগ্রী। পত্রাকারে রচিত হলেও একাব্যের গঠন রীতিতে গীতি ধর্ম নাট্যরস, পৌরাণিক কাহিনি পটভূমি এবং চরিত্র চিত্রণ অন্বয় সম্বন্ধে বন্ধ হয়েছে। অনেকেই একে Dramatic monologue বলেছেন।
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
গ্রন্থকার : কবি জীবনানন্দ দাশ।
গ্রন্থরূপ : কাব্য গ্রন্থ।
বিষয় : এই কাব্যে কবি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ মৃত্যু প্রভৃতি অকল্যাণকর বিষয়গুলি কঠিন জীবন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর ভাষায় “সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কেও আমার কবিতা চেতনা হয়তো দেখিয়েছে, আরও বড়ো চেতনার উত্তর চেয়েছে।” এই কাব্যের ‘নাবিক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন “হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য করে শুধু?” এই শ্রান্তিহীন পথের সন্ধানই কবির মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর সমাজের মানবতার গতি কোন দিকে—মুক্তি কীসে এ প্রশ্ন তিনি বারংবার তুলেছেন এবং উত্তর দেবার চেষ্টাও করেছেন। তিনি যেমন দেখেছেন বর্তমান জীবনের ক্ষহিষ্ণু অসুস্থরূপ ও অসঙ্গতি তেমনি খুঁজেছেন এক সুসংগতিময় দিব্য জীবনের পথ। কখনো তা প্রত্যয়ের আলোতে সমুজ্জ্বল, কখনো বা সংশয়ের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। ফলে আঙ্গিকেও দেখা যায় ঋজুভাষণ, কখনো বক্রোক্তি, কখনো শুধু ইশারাই দিয়েছেন চিত্রকল্পের মাধ্যমে, কখনো অর্ধোচ্চারিত প্রতীকে। যেমন—‘নিরঙ্কুশ’ কবিতায় দেখা যায়—মালয় সমুদ্রের নীলাভ জল বণিক সভ্যতার শোষণে মালয়ালীর কাছে মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। নারিকেল মর্মরিত, দারুচিনি সুবাসিত দ্বীপময় ভারতের আদিম প্রাণতপ্ত ধ্যান ধারণা ভেঙে গেছে। সেখানে আজ— “চারিদিকে পামগাছ-ঘোলামদ-বেশ্যালয়-সেঁকো কেরোসিন।” এই কবিতায় তিনি দেখেছেন—সাম্রাজ্যবাদী ও মিশনারীর প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে “রক্তিম গীর্জার মুণ্ড।” সাম্রাজ্যবাদের বীভৎস রূপ হংঙ্ক-এর পণ্যানারীর মধ্যে তিনি দেখেছেন, আবার আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে তিনি লক্ষ্য করেছেন ঃ “কত কৃষক জননীর মৃত্যু হল রক্তে—উপেক্ষায়।” দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কত অসহায় নিরীহ মানুষকে বাধ্যতামূলক সৈনিক বৃত্তি করতে হচ্ছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে, এ সবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পাই ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে।
কেন উল্লেখযোগ্য :
যুগের অন্ধকার দিকটাই কবির চোখকে কেবল আচ্ছন্ন করে রাখেনি। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন : “এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।” একথা এ কাব্যে তিনি প্রথমে আভাসে এবং পরে দৃঢ় প্রতীতির সঙ্গে বলেছেন। “সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে ;” তবে সহজে সে মুক্তি আসবে না। কবির নির্দেশিত পথ হল—“সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ”। এক কথায়—একাব্যে সমাজের বিশৃঙ্খল, রক্তক্ষয়ী অন্ধকার দিকটির প্রতি কবি যেমন অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি তা থেকে মুক্তি ও উত্তরণের জন্যে তিনি বিশেষ পথের দিক নির্দেশও দিয়েছিলেন।
Leave a comment