প্রায় একালের দোরগােড়ায় এসে দাঁড়ানাে অন্ত্য-মধ্যযুগের ভাষার সঙ্গে একালের ভাষার পার্থক্য বড়দরের নয়। বিশেষতঃ অন্ত-মধ্যযুগে এত সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং তাতে এত অবিকৃত রচনার সন্ধান পাওয়া যায় যে, ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য কোন একটা বিশেষ গ্রন্থের উপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়ােজন হয় না। বহু গ্রন্থেই ঐ যুগের ভাষার যথাযথ রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ঐ যুগের ভাষার দু একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যঃ ভাষার আঞ্চলিকতার প্রভাব, বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্রজবুলি ভাষার ব্যবহার প্রাচুর্য এবং সাহিত্যে গদ্যরীতির আবির্ভাব। ১৮০০ খ্রী ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যে গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব ঘটলাে, তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল অবশ্যই তৎপূর্বে এই অন্ত্যমধ্যযুগে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: অন্ত্য-মধ্যযুগে ‘অ’-কারের সংবৃত উচ্চারণ (‘ও’-কার-বৎ) পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত। শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত প্রায় অনিবার্যভাবেই উপস্থিত থাকে, তার ফলে পদের অন্ত্য স্বরধ্বনির লােপপ্রবণতা (হাতহাৎ, অগ্নি>অগ্ি>আগি>আগ), পদমধ্যস্থ স্বরধ্বনির লােপপ্রবণতা (অমনি>অমনি, গামােছা>গামছা এবং দ্বিমাত্রকতা (পানিতা>পান্তা) বাঙলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণরুপে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘অ’- অকারের ‘ও’ উচ্চারণ এবং ‘অ্যা’ ধ্বনির দৃষ্টিতেও এ যুগের বিশিষ্ট লক্ষণ (পরমায়ু>পরােমাই; বড়>বড়াে, দেয়>দ্যায়)। অপিনিহিতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল আদি মধ্যযুগেই, অন্ত্য-মধ্যযুগে ঘটে এর পূর্ণ প্রতিষ্ঠা (সাধু>সাউধ, কন্যা>কইন্যা, বসিয়া>বস্যা)। এই অন্তা-মধ্যযুগেই রাঢ়ী উপভাষায় এবং তদাশ্রিত শিষ্ট ভাষায় অভিশ্রুতির আবির্ভাব এবং স্বরসঙ্গতিরও বহুল ব্যবহার ঘটে (আসিয়া>আইস্যা>এসে, লইবেলবে, কাঁচলি>কাচুলি, সমস্যা-সমিস্যা)। শ্ৰতিধ্বনির ব্যবহারও এ যুগে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল (ছাওআল/ছাওয়াল, বাএ>বাহে)। অর্ধতৎসম শব্দের ব্যবহারও এ যুগে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল (হৃদয়>রিদয়, বাদ্য>বাদ্দি)। ভাষায় আঞ্চলিকতার লক্ষণ ছিল সুস্পষ্ট (লুচি>নুচি, দংশন>ডংসন)। তৎসম শব্দ এবং বিদেশি শব্দও অন্ত্য-মধ্যযুগে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে থাকে। বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি পারশি ছাড়াও বহু পর্তুগীজ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে (বাজার, বিদায়, আনারস, তামাক)।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ অন্তা-মধ্যযুগের একেবারে গােড়ার দিকে কোন কোন গ্রন্থে প্রাচীন রীতির লিঙ্গবিধান বজায় ছিল, অর্থাৎ কৃদন্ত ক্রয়াপদ এবং বিশেষণেও স্ত্রীপ্রত্যুক্ত হতাে, পরে তা একেবারেই উঠে গেলাে। প্রাণীবাচক শব্দের বহুবচনেও ‘বা’ বিভক্তি যুক্ত হতে লাগলাে, তুচ্ছার্থবােধক শব্দে যুক্ত হতাে ‘গুলি, গুলা’। সপ্তদশ শতককে বহুবচনবােধক প্রত্যয় ‘দিক’, ‘দের’ প্রভৃতির ব্যবহার শুরু হয়।
কর্তৃকারকে শূন্য বিভক্তি, ‘এ’ বিভক্তি, কর্মকারকে ‘-কে, -রে, -এ’ বিভক্তি, করণ কারকে ‘এ, -তে’ বিভক্তি, অপাদান কারকে ‘ত, -তে’ (রাজাতে বিদায় মাঙ্গে) এবং নবোেদ্ভুত ‘কারে-রে’ বিভক্তি (বাঙালীরে কত ভাল পশ্চিমার ঘরে), সম্বন্ধ পদে ‘র’ ছাড়াও ‘ক,কার, -কের’ প্রভৃতি এবং অধিকরণ কারকে -রে, -কে, কা, -ই কারে প্রভৃতি বিভক্তির প্রয়ােগ অন্ত্য-মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য।
অন্ত্য-মধ্যযুগে অতীতকালে ‘ইল’ এবং ভবিষ্যৎ কালে ‘ইব’ বিভক্তি সম্পূর্ণরূপে কর্তৃবাচ্যেই ব্যবহৃত হতে থাকে। নিত্যবৃত্ত অতীতকালের ব্যাপক ব্যবহার এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘-ইতে’ এবং ‘ইয়’ যুক্ত যৌগিক কালের (ঘটমান, পুরাবৃত্ত) ব্যবহার এই যুগে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। যৌগিক ক্রিয়ার ব্যবহারও অনেক বেড়ে যাওয়াতে অনেক মৌলিক তদ্ভব ধাতুর ব্যবহার লােপ পেয়ে যায় (জিনে>জয় করে; পিয়েপােন করে)।
অন্ত্য-মধ্যযুগে নামধাতুর ব্যবহার অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, এমন কি বহু তৎসম শব্দও নামধাতুরূপে ব্যবহৃত হতে থাকে (লাফাইয়া, বাখানিছে, অনুব্রজি, সাতস্বাইব)।
আদি-মধ্যযুগে বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় বৈষব পদ রচনা করেছিলেন, অন্ত্য-মধ্যযুগে অসংখ্য বাঙালী কবিও বৈষ্ণব পদ রচনায় ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার করেছেন।
আধুনিক যুগের বাঙলা ভাষার বৈশিষ্ট্য লক্ষণসমূহ
১৮০০ খ্রীঃ কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই তথায় গদ্য-ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। বস্তুতঃ এর সঙ্গে আধুনিক যুগের বাঙলা ভাষা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। মধ্যযুগে যে সাধু ভাষার আধারে কাব্যভাষার দেহ নির্মিত হয়েছিল, সেই সাধুভাষাই হালাে আধুনিক সাহিত্যের প্রথম পর্বের বাহন। তৎকালে কলকাতাই দেশের রাজধানী এবং শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল বলেই এই অঞ্চলে প্রচলিত রাঢ়ী উপভাষাই শিষ্ট সমাজের কথ্যভাষায় পরিণত হয় এবং কালক্রমে এই ভাষাই মার্জিত আকারে সাহিত্যের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। সাধুভাষা এবং শিষ্ট কথ্যভাষা ছাড়াও বঙ্গালী, ঝাড়খণ্ডী, বরেন্দ্রী ও কামরূপী এই কয়টি উপভাষাও আধুনিক বাঙলার অন্তর্ভুক্ত। এই সমস্ত ভাষা লােকসাহিত্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, কিন্তু সাহিত্যের বাহনরূপে এখন এদের স্বীকৃতি মেলেনি বলে আধুনিক বাঙলা ভাষার সাধারণ আলােচনায় এই আঞ্চলিক উপভাষাগুলি গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয় না।
ধবনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: অস্ত্য-মধ্যযুগে বাঙলা ভাষার যে সকল ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছিল, তাদের প্রায় সব লক্ষণই আধুনিক বাঙলায় বর্তমান রইলাে। ‘অ’-কারের ‘ও’- উচ্চারণ (অগ্নি>ওগ্নি, পাগল>পাগােল, বুড়বড়াে), ‘অ্যা’-কারের বহুল ব্যবহার, স্বরান্ত শব্দের হসন্ত উচ্চারণ (আকাশ>আকাশ), পদের আদি স্বরে শ্বাসাঘাত এবং দ্বি-মাত্রক প্রবণতা (যাইতেছি যাচ্ছি) আধুনিক বাঙলার বিশিষ্ট লক্ষণ। সাধুভাষা এবং শিষ্ট কথ্যরীতিতে অপিনিহিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে অভিশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে (হাঁটিয়া>হাইট্যা>হেঁটে, কালি>কাইল>কাল)। স্বরসঙ্গতির দুর্নিবার প্রভাবে বহু শব্দের উচ্চারণে পরিবর্তন ঘটেছে, ফলে বহু তৎসম শব্দও অর্ধ-তৎসম শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে (পূজা>পুজো, নিরামিষ>নিরিমিষ্যি)। বিদেশি ভাষার প্রভাবে কিছু কিছু নতুন ধ্বনির আগমন ঘটেছে (জ=z, ফ=f)।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ মধ্যযুগােচিত বহু শব্দ সাধু ভাষায় লােপ পেয়েছে। ‘মাের, মােকে’ প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষায় বর্তমান থাকলেও সাধু ভাষা এবং শিষ্ট ভাষা থেকে বর্জিত হয়েছে। তিহ, তিহ স্থলে ‘যিনি’, ‘তিনি’, ‘আছিল’ স্থলে ‘ছিল’ প্রভৃতিই আধুনিক ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
কর্তা সাধারণতঃ বিভক্তিহীন, সকর্মক ক্রিয়ার কর্তার -‘এ’ বিভক্তি, গৌণকর্মসম্প্রদানে ‘কে’ বিভক্তি এবং করণকারকে -‘এ’ বিভক্তি বা অনুসর্গ যুক্ত হয়। অপাদান কারকেও অনুসর্গ যুক্ত হয়। গমনার্থক বা অস্ত্যর্থক ক্রিয়া থাকলে অধিকরণ কারকে কোন বিভক্তি যুক্ত হয় না, অন্যত্র ‘-এ,-তে’ বিভক্তি হয়।
ক্রিয়ার ভাব দু’টি—নির্দেশক ও অনুজ্ঞা। কাল চারটি বর্তমান, অতীত, নিত্যবৃত্ত ও ভবিষ্যৎ। এদের প্রত্যেকটিরই পুরাঘটিত (সম্পন্ন) ও ঘটমান (অসম্পন্ন রূপও বর্তমান)। ক্রিয়ারূপে একবচন ও বহুবচনে কোন পার্থক্য নেই।
বাঙলা ভাষা ও অভিধানে স্ত্রীলিঙ্গ আছে কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক উপায়ে নির্ধারিত হয়। বাস্তবে বাঙলা ব্যাকরণে স্ত্রীলিঙ্গ নেই বললেই চলে (মেয়েটি সুন্দর, লক্ষ্মী ছেলে)।
বাঙলা ক্ৰমশঃ সরল হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট থেকে বিশ্লিষ্ট রূপে পরিণতি লাভ করেছে। তাই বাক্যে পদের অবস্থান প্রায় সুনির্দিষ্ট। প্রথমে কর্তা, পরে কর্ম এবং সর্বশেষ সমাপিকা ক্রিয়াপদ এইটিই সাধারণ নিয়ম। ইয়া যুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া যােগে অনেকগুলি বাক্যকে একটি মাত্র সরল বাক্যে নিয়ে আসা আধুনিক বাঙলার একটি বিশিষ্টতা।- ‘তুমি বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে তৈরী হয়ে তারপর ফিরে এসাে।’
Leave a comment