ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। এই মতাদর্শ রাজনীতিক মতবাদ হিসাবে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিকে দীর্ঘকাল অব্যাহত রাখতে পারেনি। ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সমষ্টিবাদের আবির্ভাব ঘটে। ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিসত্তার ধারণা প্রচার করা হয় এবং সামাজিক কল্যাণের ধারণাকে উপেক্ষা করা হয়। এই মতাদর্শের ‘যেমন খুশি চলা’র নীতির পরিণতিতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণা তীব্রতর হয়। এই চরমপন্থী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একটি বিশেষ সুবিধা তত্ত্ব বা প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি জোরদার হতে থাকে। এই অবস্থায় সমষ্টিবাদের পথ প্রশস্ত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ৭০-এর দশকের পর থেকে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ঊনিশ শতকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসাবে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করে। ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে অতিমাত্রায় সীমিত করার কথা বলেছে। অপরপক্ষে সমষ্টিবাদের মাধ্যমে বিশেষভাবে সক্রিয় রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও এক্তিয়ার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ব্যক্তির ভূমিকা হ্রাস পায়। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই সক্রিয় রাষ্ট্রতত্ত্বের বিরুদ্ধে বা সমষ্টিবাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হয়ে উঠে। এই কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিস্তারের বিরুদ্ধে এবং ব্যক্তির ভূমিকা প্রসারের পক্ষে পুনরায় প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই প্রতিক্রিয়াই হল আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। অর্থাৎ সমষ্টিবাদে সক্রিয় রাষ্ট্রতত্ত্বের কথা বলে ব্যক্তিসত্তাকে বাস্তবে উপেক্ষা করা হয়। উপেক্ষিত ব্যক্তিসত্তার পটভূমিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার এক আধুনিক উদ্যোগ শুরু হয়। তার ফলে পরিবর্তিত আকারে প্রকারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আবার আবির্ভাব ঘটে। একেই বলে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা হিসাবে নরম্যান অ্যাঞ্জেল (Norman Angell) এবং গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallas), বেলক (Belloc) প্রমুখ চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জোড-এর কথায় : “the reaction against Individua lism has produced a reaction in its turn.”


আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উৎপত্তির কারণ

আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভবের মূল কারণ হিসাবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও বিষয়ের কথা বলা হয়।

(ক) সমষ্টিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্ভবে পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে সমষ্টিবাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়। সমষ্টিবাদের সক্রিয় রাষ্ট্রতত্ত্বে ব্যক্তিসত্তা বিচ্ছিন্ন এবং উপেক্ষিত। ব্যক্তিসত্তার সর্বোচ্চ বিকাশ সমষ্টিবাদে অবহেলিত। সমষ্টিবাদে ব্যক্তিসত্তা বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রের কার্যকলাপের বিস্তার ব্যক্তিসত্তার বিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়। তাই রাষ্ট্রের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ শুরু হয়। এই সমস্ত কারণের জন্য বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এবং এই প্রচেষ্টারই পরিণতি হল আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।

(খ) স্বেচ্ছাসেবী সংঘসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা: সমাজজীবনের সর্বস্তরে রাষ্ট্রকর্তৃত্বের বৃদ্ধি ঘটেছে। এ কথা ঠিক কিন্তু ব্যক্তিজীবন থেকে কিন্তু রাষ্ট্র ক্রমশ দূরে সরে গেছে। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ব্যক্তিবর্গের প্রাথমিক আনুগত্য দাবি করতে পারে না। মানুষের আর্থনীতিক ও নৈতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বহু ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংঘ গড়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন বৃত্তিধারী ব্যক্তিবর্গের জন্য পেশাদারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিসত্তার বহুমুখী বিকাশের ক্ষেত্রে এই সমস্ত সংগঠনের ভূমিকার গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ব্যক্তিজীবনে বর্তমানে রাষ্ট্রের ভূমিকা হ্রাস এবং উপরিউক্ত সংগঠনসমূহের ভূমিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবী সংঘগুলিকে রাষ্ট্রের বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বহুত্ববাদী ধ্যান-ধারণা আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পথকে প্রশস্ত করেছে। বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থারও বিরোধিতা করেছে। মানুষ অন্যান্য সংঘের সঙ্গে নিজ ইচ্ছানুযায়ী জড়িত হতে পারে। রাষ্ট্রের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে বলেই রাষ্ট্রের সঙ্গে তাকে সারাজীবন জড়িত থাকতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন তার প্রাথমিক কর্তব্য নয়। রাষ্ট্র অন্যান্য স্বেচ্ছামূলক সংঘের ন্যায় সমান ক্ষমতা ভোগ করে।

(গ) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধকালে বিবদমান রাষ্ট্রগুলিতে সরকারী কার্যকলাপের বিপুল বিস্তার ঘটে। তার ফলে রাষ্ট্র-বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি করে। যুদ্ধের সময়ে নাগরিকদের যাবতীয় দুর্দশা, স্বাধীনতার সংকোচন প্রভৃতির জন্য রাষ্ট্রকেই দায়ী করা হয়। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের এই ক্ষমতার অতি বৃদ্ধি ব্যক্তির দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যাপক বিস্তার, সরকারী কর্মচারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের কর্তৃত্বের প্রসার, ব্যক্তি-স্বাধীনতার হ্রাস, আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণবৃদ্ধি প্রভৃতি দেখা যায়। আর এইসব কারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

(ঘ) সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের বিপদ সকলের মনে প্রবল আশংকার সৃষ্টি করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কার্যক্ষেত্রে এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিকতায় পরিণত হয়। এ হল জনগণের স্বৈরতন্ত্র। জনগণের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের হাত থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য নতুন করে ব্যক্তির স্বাধিকারের দাবি উত্থাপনের চেষ্টা করা হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংগঠিত এবং প্রতিফলিত ক্রমবর্ধমান জনমতের চাপ থেকে ব্যক্তিসত্তাকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এর উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আইনগত সার্বভৌমত্বকে রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করার বিপক্ষে।


আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মূল বিষয়

আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে রাষ্ট্রকে গোষ্ঠী সমবায় বা সংঘ সমবায় হিসাবে দেখা হয়। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে গোষ্ঠী বা সংঘ স্বাতন্ত্রের কথা বলা হয় এবং পূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিরোধিতা করা হয়। এই মতবাদ আদর্শবাদ ও সমষ্টিবাদেরও বিরোধী। আদর্শবাদীরা রাষ্ট্রের চরমত্ব দাবি করেন। কিন্তু আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তা স্বীকার করে না। এই মতবাদ অনুসারে সমাজের সংগঠনসমূহের মধ্যে রাষ্ট্র অন্যতম। তাই রাষ্ট্র নীতিগতভাবে জনগণের নিরঙ্কুশ আনুগত্য আশা করতে পারে না। ব্যক্তিজীবনের কোন বিশেষ প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্র হল দ্বন্দ্ব-মীমাংসার একটি প্রশাসনিক যন্ত্র। এর কাজ হল সমাজের বিভিন্ন সংঘ ও প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এই মতবাদ অনুসারে গোষ্ঠীর প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই মতবাদ জনমতকে নিষ্পেষণমূলক বলে ব্যক্তিকে রক্ষা করতে চায়।

বস্তুত বক্তব্য ও উদ্দেশ্যগত বিচারে ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে ব্যাপক সাদৃশ্য বর্তমান। উভয় মতবাদেই ব্যক্তিসত্তার বিকাশের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নেও সাদৃশ্য আছে। কিন্তু বিন্যাসগত বিচারে ঊনবিংশ শতাব্দীর এবং আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এই দু’টি ধারা ব্যক্তিসত্তার চূড়ান্ত বিকাশের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বিষয়ে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন।


আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য

আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়। অনুধাবনের সুবিধার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক।

(ক) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী এবং রাজনীতিক প্রকৃতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একক হল গোষ্ঠী, ব্যক্তি নয়। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল গোষ্ঠীসমূহের সমষ্টিবিশেষ। তাই এখন ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্রের কথা না বলে গোষ্ঠী বনাম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। 

(খ) এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্র এককভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে ব্যক্তির অস্তিত্ব গোষ্ঠীর মধ্যেই বর্তমান। এই মতবাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হল আর্থনীতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য সংঘের সঙ্গে রাষ্ট্রকে সমমর্যাদাযুক্ত বলে প্রতিপন্ন করা।

(গ) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসা এবং পরস্পর-বিরোধী দাবি-দাওয়ার মধ্যে সমন্বয়সাধনের এক সংস্থা। জোডের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের এই দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী যদি সক্ষম হয় তা হলে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। 

(ঘ) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বই এখন গোষ্ঠীর মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। এবং গোষ্ঠীগুলি এ সব কাজ সাফল্যের সঙ্গে করছে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ব্যক্তিজীবনের সকল দিকের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। অন্যান্য সামাজিক সংঘের মত রাষ্ট্রও হল একটি সংগঠন।

(ঙ) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে সামাজিক সংঘসমূহের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব বর্তমান। ব্যক্তির আনুগত্যের উপর রাষ্ট্রের মত সামাজিক সংঘগুলিরও দাবি আছে। এই অবস্থায় ব্যক্তির বিভিন্ন দাবির মধ্যে প্রাধান্য প্রদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে ব্যক্তি। 

(চ) আদর্শবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেগেল রাষ্ট্রের সত্তাকে ব্যক্তির উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে রাষ্ট্রের গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। 

(ছ) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী। আবার এই মতবাদ আদর্শবাদ ও সমষ্টিবাদেরও বিরোধী।

(জ) আলোচ্য মতবাদটি বুদ্ধিবাদ (Intellectualism)-এরও বিরোধী। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে স্বীকার করা হয় না যে বিশুদ্ধ যুক্তির পথেই জ্ঞান অর্জন করা যায়। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল বুদ্ধিবাদ বিরোধী এক উদ্যোগ। এই উদ্যোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছে। 

(ঝ) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বা জনমতকে নিষ্পেষণমূলক বলে মনে করা হয়।

(ঞ) এই মতবাদে ব্যক্তিসত্তার সংরক্ষণের স্বার্থে ক্ষমতাবিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়।


ধ্রুপদী ও আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যে পার্থক্যসমূহ

ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সঙ্গে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কতকগুলি ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এই দু’টি ধারার মধ্যে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

(১) আলোচনার এককের ক্ষেত্রে পার্থক্য: আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আলোচনায় ব্যক্তির বদলে গোষ্ঠী ও সংঘের উপর জোর দেওয়া হয়। ঊনিশ শতকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আলোচনা ব্যক্তির স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্বের উপরই কেন্দ্রীভূত ছিল। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতানুসারে আধুনিক জীবন হল অত্যন্ত জটিল ও সমস্যা-সংকটে আচ্ছন্ন। এই অবস্থায় এককভাবে স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। এই কারণে ব্যক্তিকে কোন-না-কোন গোষ্ঠী বা সংঘের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। তাই এই তত্ত্বে ব্যক্তির পরিবর্তে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আলোচনার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অধ্যাপক বার্কারের অভিমত অনুসারে আধুনিক সমাজে ব্যক্তি একা থাকতে বা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। এখন ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্রের বদলে গোষ্ঠী বনাম রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। একটি মূল বিষয়ে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে সরে এসেছে। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে আলোচনার একক হল গোষ্ঠী, ব্যক্তি নয়।

(২) ব্যক্তি-স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে পার্থক্য: ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক আর্থনীতিক কর্তৃত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মাধ্যমে ব্যক্ত জনমতের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যর্থ হয়েছে। ঊনিশ শতকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এই ত্রুটি গোষ্ঠী দূর করতে পারে। ক্ষুদ্রায়তনের গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে ব্যক্তির ইচ্ছার অভিব্যক্তি ভালভাবে ঘটে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য্য সঠিকভাবে সম্পাদিত হয়। সমষ্টিবাদের দ্বারা ব্যক্তিসত্তা বিপর্যস্ত হয়। এই বিপর্যস্ত ব্যক্তিসত্তাকে পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়।

(৩) গোষ্ঠী ও সংঘের স্বাধিকারের ধারণা তাৎপর্যপূর্ণ: ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্যের বিরোধী। কিন্তু আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনুসারে ব্যক্তি এককভাবে তার স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। তাই তাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। গোষ্ঠী ও সংঘের স্বাধিকারের ধারণা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তাৎপর্যপূর্ণ। বহুত্ববাদ এবং পরবর্তীকালে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক রাজনীতিক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

(৪) ঊনিশ শতকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিসত্তার সর্বোচ্চ বিকাশ। কিন্তু এই বিকাশের পদ্ধতি প্রসঙ্গে এই দুই মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

(৫) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের এই দু’টি ধারার মধ্যে মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে এবং উদ্দেশ্যগত ক্ষেত্রে সাদৃশ্য অনস্বীকার্য। কিন্তু ধ্রুপদী ও আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিন্যাসের ক্ষেত্রে পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট।


আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিভিন্ন প্রবক্তা

নরম্যান অ্যাঞ্জেল-এর অভিমত: আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা হিসাবে নরম্যান আঞ্জেল (Norman Angell), গ্রাহাম ওয়ালাস ( Graham Wallas), বেলক (Belloc) প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে নরম্যান আঞ্জেল-এর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল The Great Illusion এই গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, মানুষ আর্থনীতিক সমস্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংঘ গঠন করে। এই সব সংঘ সংগঠন অনেক ক্ষেত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে। মানুষ এই রকম আন্তর্জাতিক সংঘের সদস্য হিসাবে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে উঠলে রাষ্ট্রের কার্যকলাপ হ্রাস পাবে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি ও আর্থনীতিক সহযোগিতার সৃষ্টি হবে। তাঁর মতে রাষ্ট্র একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া কিছু নয়। তার উদ্দেশ্য হল একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক সমাজব্যবস্থা গঠন করা। এই আন্তর্জাতিক সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক শ্রেণীর ভিত্তিতে জাতীয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সমাজের অঙ্গীভূত হবে। এ প্রসঙ্গে জোড় বলেছেন যে, নরম্যান অ্যাঞ্জেল এক বিশেষ পরিস্থিতির কথা বলেছেন। এই পরিস্থিতিতে আর্থনীতিক শ্রেণীর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি আন্তর্জাতিক সমাজব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে জাতীয় রাষ্ট্র। অ্যাঞ্জেলের অভিমত অনুসারে মানুষ দেশপ্রেমের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয়। এবং এই প্রভাবের বশে ব্যক্তি অনেক অযৌক্তিক ও দায়িত্বহীন কাজকর্মের সামিল হয়। অথচ ব্যক্তিগত বিষয়ে ব্যক্তির মধ্যে যুক্তিহীনতা বা দায়িত্বহীনতা থাকে না। অ্যাঞ্জেলের মতানুসারে জাতীয় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ব্যক্তির আচার-আচরণের মধ্যে অবিবেচনাপ্রসূত কাজকর্ম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে আচরণের ক্ষেত্রে অন্যায়-অবিবেচনা থাকে না। নরম্যান অ্যাঞ্জেলের বলিষ্ঠ অভিমত হল যে মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের স্বার্থে অধিকতর সুষ্ঠু ব্যবস্থা সংগঠন করা সম্ভব হবে এবং তখন রাষ্ট্রের আর দরকার হবে না; রাষ্ট্রকে বর্জন করা যাবে।

গ্রাহাম ওয়ালাসের অভিমত: গ্রাহাম ওয়ালাস তাঁর Great Society গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। ওয়ালাস সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য হল সমষ্টিগত চেতনা (collective mind) সৃষ্টি করা। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে সমষ্টিগত চেতনার সৃষ্টি হতে পারে না। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ভৌগোলিক ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় বিভিন্ন গণ মাধ্যমের দ্বারা জনগণের বিপথে পরিচালিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তা ছাড়া প্রভাবশালী আর্থনীতিক গোষ্ঠীসমূহও জনস্বার্থে আঘাত হানতে পারে। তিনি নির্বাচকদের বিভিন্ন পেশাদারী গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে পরিষদ গঠনের সুপারিশ করেছেন। বস্তুত গ্রাহাম ওয়ালাস কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের ব্যাপারে দ্বি-পরিষদীয় আইন সভার সুপারিশ করেছেন। তাঁর মতানুসারে এই আইনসভার প্রথম কক্ষ গঠিত হবে ভৌগোলিক ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। এবং দ্বিতীয় কক্ষ গঠিত হবে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে। এই দ্বিতীয় বা উচ্চকক্ষটি গঠনের জন্য সমগ্র নির্বাচকমণ্ডলীকে পেশাগত বিচারে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করতে হবে। প্রত্যেক গোষ্ঠী তাদের প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় কক্ষে নির্বাচিত করবে। এই কক্ষটি হবে পেশাগত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক। প্রকৃত প্রস্তাবে ওয়ালাস রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মত সংখ্যাগরিষ্ঠের অবাধ শাসনের আশংকাও করেছিলেন। এই কারণে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

বেলকের মতামত: বেলক (Belloc) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আর একজন প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম হল The Servile State। বেলক মধ্যযুগীয় গিল্ড (Guild) ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। গিল্ড সমাজতন্ত্রীদের প্রস্তাবগুলি হল আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বাদীদের মনোভাবের বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে বেলকের আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বক্তব্য স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। বেলকও সামাজিক গোষ্ঠীর উপর জোর দিয়েছেন।

উপসংহার: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দু’টি ধারাই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধিতা করেছে। ধ্রুপদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের মত আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদও ব্যক্তির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছেন। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠের অবাধ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল সংঘ স্বাতন্ত্র্যবাদেরই নামান্তর। ঊনিশ শতকের বিরোধী এই মতবাদ গোষ্ঠী বা সংঘের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং বহুলাংশে বহুত্ববাদী ধারণাকেই সমর্থন করেছে। এই কারণে জোড (Joad) আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে সংঘ-স্বাতন্ত্র্যবাদ বলার পক্ষপাতী।