বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশক্ষেত্র কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পূর্ববঙ্গ-অধুনা বাংলাদেশও বাংলা সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে অখণ্ড বাংলায় ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা একসূত্রেই গ্রথিত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণেই ক্রমশ দুই ভূখণ্ডের ভাষা ও সাহিত্যে এক ধরনের অবাঞ্ছিত দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট পূর্ব বাংলার এক অভিজাত শিক্ষার আলােকপ্রাপ্ত বুচিমার্জিত পরিবারে ওয়ালীউল্লাহের জন্ম। পিতা আহমদউল্লাহ ছিলেন তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি ভাষা সাহিত্যের এম. এ. এবং একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি। এই কারণেই ওয়ালীউল্লাহের বাল্য ও কৈশাের কেটেছে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নানাস্থানে এবং এই নানাস্থানে ভ্ৰমণ জীবন ও মানুষ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।

সৃজনশীল সাহিত্যে কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পাক-ভারত উপমহাদেশের বাংলা সাহিত্যে অনন্য। তার প্রথম গল্প হঠাৎ আলাের ঝলকানি ১৯৪১ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এ্যানুয়ালে প্রকাশিত হয়।

সমাজ-সচেতন তথা কালসচেতন কথাসাহিত্যিক হিসাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য সৃজনকে বিলাসিতা মনে করেন নি এবং প্রত্যক্ষভাবে সাহিত্য রচনাকে যশ বা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেন নি। নিছক সাহিত্যিক হবার জন্যই সাহিত্যচর্চাকে তিনি ঘৃণা করেছেন— “সাহিত্যিক হতে হবে বলে লেখা-সে ঘৃণা করি। প্রাণের উৎস থেকে না বেরুলে সে আবার লেখা!”

জীবনের অসম্পূর্ণতা, গ্লানি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক বা ধর্মীয় অসাম্যকে আঘাত করতেই ওয়ালীউল্লাহ কলম তুলে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে নিজ অভিজ্ঞতাধীন মুসলমান সমাজের সমস্যা, ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকে তিনি তাঁর প্রগতিশীল চেতনার আলােয় প্রকাশ করেছেন অনবদ্য শিল্পিত ভাষাবন্ধনে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন- “I want to write মুসলমান সমাজ নিয়ে আমার সমগ্র মনের ইচ্ছে সে-দিক পানে।……মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে আমরা কেউ হয়তাে অজ্ঞ নই ; কিন্তু অধঃপতনের এই যে চূড়ান্ত অবস্থা, এই অবস্থা নিয়ে লিখে আমার লেখা কলঙ্কিত (१) করতে চাই।”

তবে তার কলম যথার্থ সাহিত্যিকের কলম। সাংবাদিকতার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের কলমকে তাই তিনি স্বীকার করতে পারেন নি। বলেছেন- “আমার ইচ্ছা সাংবাদিক কাগজের রিপাের্টারের ঊর্ধ্বে ওঠা।”

আমৃত্যু সময়-সচেতন ও জীবন-সচেতনভাবে মানুষের সপক্ষে থেকেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ‘জীবনের জন্য শিল্প’– এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও তার রচনা কখনাে নিছক সাময়িক সাহিত্যে পর্যবসতি হয় নি। বরং এক অসাধারণ সাহিত্যশিল্পে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে তার রচনা।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ‘চাদের অমাবস্যা’ কিংবা ‘কাদো নদী কাঁদো’ বিশ্বসাহিত্যের কালােত্তীর্ণ উপন্যাসগুলির সমগােত্রীয় শিল্পগুণসম্পন্ন। তার ‘লালসালু’ উপন্যাস অদ্যাবধি পূর্ববাংলার শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাস হিসাবে স্বীকৃত। ছােটোগল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর সৃষ্টিগুলি শিল্পমহিমায় ও বিষয় গৌরবে উল্লেখযােগ্য।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের জীবনের অনেকখানি সময় অতিবাহিত হয়েছে বিদেশে, বিশেষত ফ্রান্সে। ফলে ইউরােপীয় সাহিত্যের শিল্পমান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে তিনি যথেষ্ট গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন, এবং সেই অভিজ্ঞতাকেই তিনি যথাসাধ্য প্রয়ােগ করেছেন সাহিত্য সৃষ্টিতে।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর মস্তিষ্ক রক্তক্ষরণের কারণে এই মহান সাহিত্যিক প্রয়াত হন।