আধুনিক বাংলা কাব্যের এক স্বতন্ত্র ভুবনের রূপকার জসীমউদ্দীনের প্রতিভার মূল্যায়ন কর।

ভূমিকা: বাংলা সাহিত্যে জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-৭৬] পরিচয় পল্লিকবি হিসেবে। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে সাহিত্যঙ্গনে তাঁর আবির্ভাব। এ সময়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিত্য-নতুন সৃষ্টি নিয়ে পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত, বিদ্রোহী কবি তাঁর রক্তমাতাল গান-কবিতার সাহায্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গ শীর্ষে, তিরিশের দশকের পঞ্চ-পাণ্ডব করিরা তাঁদের রচনাতে নাগরিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত- সে সময় দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির ন্যায় পল্লিকবির কবিতা আমাদের পল্লির মাধুর্যময় রূপের দিকে আকর্ষণ করার প্রয়াস পেয়েছিল। ভাবে, ভাষায়, অলঙ্কার ব্যবহারে তাঁর কবিতা যেন পল্লিরই সৌন্দর্যের এক চাদর বিছানো।

গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, মানুষ আর তার জীবন জীবিকা জুড়ে যে প্রেক্ষাপট সে প্রেক্ষাপট নিয়েই জসীমউদদীনের কবিতা-কাব্য রচনা করেছেন। ফলে বাংলার জনগণের কাছ থেকে তিনি ‘পল্লি কবি’ খেতাব পেয়েছেন। জসীমউদ্‌দীন পল্লির কবি, পল্লির নাড়ী-নক্ষত্রের সঙ্গে তাঁর সংযোগ থাকায় তিনি তাঁর কাব্যে পল্লির আবহকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। রবীন্দ্র যুগে কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে বাংলা কাব্য ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তেমনি কবি জসীমউদ্‌দীন সম্পূর্ণ নতুন কাব্যচেতনার পোষকতা করে বাংলা কাব্যাঙ্গনে আর্বিভূত হয়েছিলেন। পল্লি বাংলার সহজ সরল ও অনাড়ম্বর জীবন ও প্রকৃতিকে তিনি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। জন্ম ও ঐতিহ্য সূত্রে তিনি ছিলেন গ্রামীণ সাহিত্যের সাথে সংযুক্ত। তাঁর সম্পর্ক ছিল চণ্ডীমঙ্গল, মৈমনসিংহ গীতিকা এবং লোক সাহিত্যের অজস্র কাব্য-গীতিকার সঙ্গে। ফলে তাঁর কবিতায় কবিতার উপকরণ পল্লির। তবে পরিবেশনা ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আধুনিক।

সমকালীন কাব্যধারার গতি-প্রকৃতি ছিল জসীমউদ্‌দীনের নখদর্পণে। আধুনিক কাব্য আঙ্গিকের শিক্ষাও তাঁর কম ছিল না। পল্লির জীবন প্রবাহকে কবিতায় ঠাঁই দিতে গিয়ে তিনি গ্রাম্যতা প্রশয় দেননি। তিনি আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের চাহিদা ও রুচিকে মূল্য দিয়ে প্রকরণগত দিক থেকে পল্লি কবিতাকে আধুনিক শৈল্পিক পরিচর্যায় সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। এতদ্‌ প্রসঙ্গে সমালোচক ও কবি হাসান হাফিজুর রহমানের মন্তব্য- “জসীমউদ্‌দীনের হাতে লৌকিক জীবন ও উপকরণ আধুনিক আঙ্গিক ও রুচিতে সজ্জিত হয়ে পরিবেশিত।”

ড. দীনেশ চন্দ্র সেন পল্লি কবি জসীমউদ্‌দীন সম্বন্ধে বলেছেন, “দূরাগত রাখালের বংশী ধ্বনির মত তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করিয়াছে। তোমার কবিতা পড়িয়া আমি কাঁদিয়াছি।” -(বিচিত্রা: বৈশাখ সংখ্যা ১৩৩৯)।
এ বিষয়ে অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্তের ভাষা, “জসীমউদ্‌দীন মনে প্রাণে পল্লিদরদী বলে পল্লি জীবনের সুখ-দুঃখের চিত্র তাঁর লেখনীতে যেমন চমৎকার ভাবে রূপ পরিগ্রহ করেছে, বাংলার আর কোনো কবির লেখায় তেমনটি হয়নি।”
আধুনিক কালের নিষ্ঠাবান শিল্পী জসীমউদ্‌দীন। তাঁর রচনায় সচেতন শিল্পপ্রয়াস লক্ষণীয়। তাঁর কবি প্রতিভার মূল্যায়ন এবং আধুনিক বাংলা কবিতায় অবদানের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে হলে তাঁর বিচিত্র সৃষ্টিকর্মের সাথে আমাদের
পরিচয় সাধন প্রয়োজন। নিচে তাঁর কবিকর্মের রূপবৈচিত্র্য বিন্যস্ত করা হলো:

  1. খণ্ডকাব্যসমূহ: ‘রাখালী’ (১৯২৭), ‘বালুচর’ (১৯৩০), ‘ধানক্ষেত’ (১৯৩২), ‘রূপবতী’ (১৯৪৬), ‘মাটির কান্না’ (১৯৫১), ‘হলুদ বরণী’ (১৯৫৬), ‘জলের লিখন’ (১৯৫৯), ‘ভয়াবহ সেই দিন গুলিতে’ (১৯৭২), ‘মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো’ (১৯৭৬)।
  2. . কাহিনি কাব্য: ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৩), ‘সকিনা’ (১৯৪৯), ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩)।
  3. শিশু কাব্য: ‘হাসু’ (১৯৩৮), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৪৯)।
  4. গীতি নকশা: ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ (১৩৫০)।
  5. কাব্যানুবাদ: ‘পদ্মা নদীর দেশে’ (১৯৬৯)।
  6. . গীতিনাট্য: ‘বেদের মেয়ে’।
  7. উপন্যাস: ‘বোবা কাহিনী’।

জসীমউদ্‌দীনের সবকটি কাব্যেই (রাখালি, বালুচর, ধানক্ষেত, নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট) পল্লী মানুষেরই প্রতিফলন ঘটেছে। এসব কাব্যে পল্লি প্রকৃতির পটভূমিতে পল্লি মানুষের জীবন চিত্র, জীবন কাহিনী রচনা করেছেন কবি। অবশ্য বালুচর ও রূপবতী কাব্যের কিছু কিছু কবিতায় রবীন্দ্র ও নজরুলের রোমান্টিক সৌন্দর্যানুভূতি ও প্রেম ব্যাকুলতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিছু কাব্যে নাগরিক-জীবনের নানা ভাবনা প্রকাশেও তিনি তৎপর ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ ‘রূপবতী’, ‘মাটির কান্না’, ‘জলের লিখন’, ‘হলুদ বরণী’ ইত্যাদি কাব্যের উল্লেখ করা যায়। ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশী’ প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত শিশু কাব্যের অনেক কবিতা আধুনিক যুগের যেকোনো কবির রচনার সঙ্গে তুলিত হতে পারে। তাঁর পল্লী গীতি সমূহও বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ। ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ কাব্যের বহু গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ সকল গান রচয়িতা হিসেবে বিশেষ একটা প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। তাঁর কাব্যানুবাদ ‘পদ্মা নদীর দেশে’ ও গীতি নাট্য ‘বেদের মেয়ে’ যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে।

অনেকে মনে করেন-গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি যেভাবে জসীমউদদীনের কাব্যে রূপায়িত হয়েছে তাতে তিনি লোককবি না হয়েই যান না। সত্যিকার অর্থে, বাংলা কাব্যের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে স্থির ধারনায় অবর্তীন জসীমউদ্‌দীন। তথাকথিত লোককবি ছিলেন না। ছিলেন না অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত পল্লি কবি। একথা ঠিক যে, গ্রামীণ জীবন ধারার যে স্বাভাবিক গতি-যে গতিই জসীমউদ্‌দীনের কবিতাকে গতিশীল করেছে। যে কারণেই গ্রামের মানুষের সহজ-সরল অনুভূতি আর যে অনুভূতির ফসল হিসেবে যে প্রেম-ভালোবাসায়, সুখ-দুখ-বেদনায় বিজড়িত জীবন-যে জীবনের ভেতর- বাহির চিত্রিত হয়েছে জসীমউদ্‌দীনের কবিতায়। এক্ষেত্রে কবি চিত্র শিল্পীর দৃষ্টি ও যোগ্যতা নিয়ে কলম ধরেছিলেন। ফলে, গ্রামের মানুষকে নিয়ে সে কবিতা, যে কবিতা হয়ে উঠেছে ছবির মতো। দৃষ্টান্ত,

১. দূর্বা বনে রাখলে তারে দূর্বাতে যায় মিশে,

মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।

………………………………………………………

বনের মাঝে বনের লতা, পাতায় পাতায় ফুল,
কেও জানে না নমু মেয়ের শ্যামল শোভার চুল।’                    -(সোজন বাদিয়ার ঘাট)।

২ . বউদের আজ কোন কাজ নাই, বেড়ায় বাধিয়া রথি,
সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখি বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।                  -(পল্লী বর্ষা: ধানক্ষেত)।

৩. দশ খান্দা জমি রুপার, তিনটি গরু হালে,
ধানের বেড়ি ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে।                    -(নকসী কাঁথার মাঠ)।

জসীমউদ্‌দীনের হাতে লৌকিক জীবন ও উপকরণ আধুনিক আঙ্গিকে ও রুচিতে সজ্জিত হয়ে পরিবেশিত। লোক সাহিত্যের মাল মশলা, ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার প্রভৃতিকে তিনি ব্যাপকভাবে উপকরণ হিসেবে কাজে লাগিয়েও আধুনিক শিল্প রুচির প্রয়োগ দেখিয়েছেন। কতিপয় উদাহরণ,

১. উপমা :
(ক) মেয়ে ত নয় হলদে পাখির ছা।
(খ) লাল মোরগের পাখার মতো উড়ে তাহার শাড়ী।
(গ) শুকনো ঢেলা কাঠের মতই শুকনো মাঠের ঢেলা।                        -(নক্সী কাঁথার নাঠ)।

২. রূপক:
(ক) তোমার লাগিয়া মন মোমবাতি পুড়ায়ে করিল শেষ।                  -(রূপবতী)।
(খ) বিহতা কুসুম সহস্র ঘুরে ফুটিল বনের ছায়।                                -(মাটির কান্না)।

৩. উৎপ্রেক্ষা :
(ক) সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, পথে যদি দেখা হয়,

যেন রাঙা ঘুড়ি আকাশে উড়াল, যেন তার মনে লয়।                      -(সোজন বাদিয়ার ঘাট)।

(খ) দুখাই ঘটক নেচে চলে, নাচে তাহার দাড়ি
বুড়ো বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি।                                    -(নক্সী কাঁথার মাঠ)।
লোকজ জীবনের অনুষঙ্গজাত শব্দমালা তার কবিতায় ঝরে পড়েছে,
‘সাঁঝ হয়ে গেল আসে নাকো আই-চাই মার প্রাণ,
এক কোঁচ ভরা বেসুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে’,                        -(পল্লী জননী: রাখালী)।

কবির মার্জিত রুচি ও প্রয়োগ নৈপুণ্যের গুণে আঞ্চলিক শব্দমালা গ্রাম্যতা মুক্ত হয়ে শিল্প রুচির পরিচয় রেখেছে। শুধু আঞ্চলিক শব্দই নয়, গ্রাম্য বাক্যভঙ্গিকেও তিনি ব্যবহার করেছেন আশ্চর্য নিপুণতায়:

‘ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি,

এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকী?’                              -(নক্সী কাঁথার মাঠ)।

জসীমউদ্‌দীন তাঁর কাব্য-কবিতায় গ্রাম্য গীতি ছন্দের প্রয়োগ যেমন করেছেন, তেমনি আধুনিক ছন্দেরও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। যেমন,

স্বরবৃত্ত:

গরুর গাড়ী/ চলে সেহায়

পদ্মা নদীর/ পারে,

পুটি মাছের/ ধাক্কা লেগে

চাকা নড় বড় করে।                                                                     -(এক পয়সার বাঁশী)।

মাত্রাবৃত্ত :

চাঁদের মতন/ মুখখানি নয়/ তবু মনে হয় চাঁদ

একাদশী রাতে/ আকাশে যে ওঠে তারেই করিয়া/ সাধ           -(মা যে জননী কান্দে)।

জসীমউদ্‌দীন মনে প্রাণে পল্লি দরদী বলে পল্লি জীবনের সুখ দুঃখের চিত্র তাঁর লেখনীতে যেমন চমৎকার ভাবে রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু তাই বলে তিনি গ্রাম্য কবি নন। তার কারণ উপমা-রূপক প্রয়োগ তিনি যথেষ্ট অনুশীলনের পরিচয় দিয়েছেন। পল্লির জীবন প্রবাহকে কবিতায় ঠাঁই দিতে গিয়ে তিনি গ্রাম্যতা প্রশ্রয় দেননি। গ্রামীণ জীবনকে উপজীব্য করলেও পল্লি বৃত্তের মধ্যে সব সময় সীমিত থাকেননি। তাঁর কবিতার ভাব ও বিষয় সম্পর্কে যেমন রচনাভঙ্গি সম্পর্কেও একথা তেমনি সত্য। কাজেই বলা যায় জসীমউদ্‌দীন পল্লি কবি, কিন্তু গ্রাম্য কবি নন। জসীমউদ্‌দীন আধুনিক যুগের কবি। আধুনিক শব্দটি জসীমউদ্‌দীনের কাব্য মূল্যায়নে অবাস্তব নয়-এ কারণে যে,

“জসীমউদ্‌দীন যে সমস্ত উপমা ব্যবহার করেছেন সেগুলোর উপাদান গ্রাম হতে সংগৃহীত কিন্তু উপমার ব্যাখ্যা সূত্র প্রধানত নাগরিক।”

অর্থাৎ জসীমউদ্দীনের কবিতার উপকরণ পল্লির হলেও পরিবেশনা আধুনিক। আধুনিক কাব্য আঙ্গিকের শিক্ষায় শিক্ষিত কবি আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের চাহিদাও রুচিকে মূল্য দিয়ে প্রকরণগত দিক থেকে পল্লি কবিতাকে আধুনিক শৈল্পিক পরিচর্যায় সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। সুতরাং জসীমউদ্‌দীন শুধু গ্রামীণ কবি ছিলেন না।

তিনি কাহিনী কাব্য পরিকল্পনায়, অলঙ্কার, ভাষা, ছন্দ ও গীতিময়তায় বাংলা কাব্যে নয়া দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। তাই জসীমউদ্‌দীন সম্পর্কে ‘পল্লী কবি’ শিরোপা যথেষ্ট নয়, তাঁর কবি প্রতিভা সম্পর্কে জনৈক সমালোচকের মন্তব্য,

“আধুনিক বাংলা কবিতার ভাব প্রকাশ ও আঙ্গিকে যাঁরা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি জসীমউদ্‌দীন ।… তাকে বাদ দিয়ে আধুনিক কবিতার কথা চিন্তা করা যায় না।”

জসীমউদ্দীন পল্লিবোধ ও আমেজের কবি। তাঁর কাব্যের অপরিহার্য উপাদান পল্লি জীবন ও পরিবেশ। লোককাহিনি, লোক সংগীত, ছড়া, ফোকলোর বিভিন্ন উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কাব্যে। তিনি লোক সাহিত্যের গীতি, গাথা, ছড়া ও পালা থেকে শব্দ, উপমা, রূপক, ভাষা এমনকি ছন্দভঙ্গি পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন তাঁর কাব্যদেহে। তবে এক্ষেত্রে জসীমউদ্‌দীনের স্বকীয়তা এখানে যে, তিনি প্রকতি উৎসারিত স্বাভাবিক ও মৌলিক লোকজ ধারার সঙ্গে আধুনিক কাব্য ধারার সমন্বয় সাধনে যে প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন তা অসাধারণ। গ্রামীণ প্রকৃতি ও জীবন জসীমউদ্‌দীন খুব কুশলী হাতে আঁকতে সক্ষম হয়েছেন, এবং সে অঙ্কন রীতিতে আধুনিকতার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। কয়েকটি কাব্য গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:

ক. ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির ঝরা ঘাসে,

সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই,
সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।                          -(রাখাল ছেলে: রাখালী)।

খ . নতুন চাষার নতুন চাষানী, নতুন বেঁধেছে ঘর,
সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়বড়।                       -(নক্সী কাঁথার মাঠ)।

গ. পথের কেনারে মোর ধান খেত, সবুজ পাতার পরে,

সোনার ছড়ায় হেমন্ত রাণী সোনা হাসি খানি ধরে।

…………………………………………………………………….

মাঝে মাঝে এর পাকিয়াছে ধান, কোন খানে পাকে নাই,

সবুজ শাড়ীর অঞ্চলে যেন ছোপ লাগিয়াছে তাই।                          -(ধানক্ষেত: ধানক্ষেত)।

ঘ. চাঁদের মতন মুখ খানি নয়, তবু মনে হয় চাঁদ

একাদশী রাতে আকাশে যে ওঠে, তারেই করিয়া সাধ।                  -(মা যে জননী কান্দে)।

৬. ধানের আগায় ধানের ছড়া, তাহার পরে টিয়া,

নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারির পাখা দিয়া।

দূর্বাবনে রাখলে তারে দূর্বাতে যায় মিশে,

মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।                              -(সোজন বাদিয়ার ঘাট)।

এভাবে উপমা, রূপক-প্রতীক আর চিত্রকল্পে পল্লি প্রকৃতির নানা উপকরণ আধুনিক মন ও মননে অনন্য মোড়কে প্রকাশ পেয়েছে। জসীমউদ্দীন পল্লির রূপকার হলেও তাঁর পরিবেশন গুণে কাব্যোপকরণ ও ভাষা সর্বদাই আধুনিক শিল্প রুচির পরিচয় বহন করেছে। এসব শৈল্পিক কারুকার্য ও বৈশিষ্ট্যের জন্যই জসীমউদ্‌দীন শুধু পাল্ল কবি নন, তিনি আধুনিক বৈদন্ধ্যের কবি এবং গ্রাম্যতা তাঁর কাব্য দেহে প্রশ্রয় পায়নি। কাজেই জসীমউদ্‌দীন পাল্ল কবি হলেও গ্রাম্য কবি নন। জসীমউদ্‌দীনের কাব্যের উপকরণ পল্লিকেন্দ্রিক, কিন্তু প্রকরণ আধুনিক। বাংলা কাব্যাঙ্গনে এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র। আর এ কারণেই বলা হয়, আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে জসীমউদ্‌দীন এক স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ধারার পোষকতা করেছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।