কাব্য মেজাজের বিচারে সমর সেন বিশ শতকের প্রথম প্রহরে জাত কবিদের থেকে স্বতন্ত্র। অথচ এমন নয় যে তিনি শিক্ষায় অপরদের চেয়ে পশ্চাৎপদ বরং ইংরেজিতে সাম্মানিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণির প্রথম স্থানাধিকারী, বিদেশবাসের সুযােগও যথেষ্ট পেয়েছে। শিক্ষায়, মেজাজে, রুচিতে, আভিজাত্যে বিশিষ্ট, সেই সমর সেন কিন্তু ঐতিহ্যবর্জিত এই অত্যাধুনিক প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন না।

সমর সেনের কাব্যের যথার্থ রস গ্রহণ করতে হলে তাঁর কবি মেজাজটির যথার্থ স্বরূপ উপলদ্ধি যথেষ্ট প্রয়ােজনীয়। এ বিষয়ে কবি নিজে তার সম্বন্ধে কিছু বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্য রেখে গেছে, তাতে স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে তিনি ছিলেন একান্তই মধ্যবিত্তের গণ্ডিভুক্ত, তার বন্ধন এড়িয়ে তিনি কখনাে জনগণের কাছে পৌছতে পারেননি। অতএব তাঁকে বিপ্লবী বলে কেউ মনে করলে তিনি এই ‘বিপ্লব’ ব্যাপারটাকেই তুচ্ছ করে দেখছেন—এই তার স্পষ্ট স্বীকৃতি কোনও বিনয় ভাষণ নয়। পূর্বে ‘অবক্ষয়ের সমর্থনে’-সূচক প্রবন্ধে তিনি যথার্থ প্রগতিশীলদের বর্তমান সময়ে দেশের বর্তমান অবস্থায় কীভাবে চলা উচিত বলে যে সমস্ত নির্দেশ দান করেছেন, তার ব্যক্তিজীবনের সামগ্রিক আচরণে এবং কাব্য রচনায়ও তারই পরিপ্রকাশ ঘটেছে। তাই তিনি মেকি জনগণের কবি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাননি। ফলত মনে হয়, এই সমস্ত কারণেই একালের অন্যতম বুদ্ধিজীবী লেখকবূপে পরিচিত সুসমালােচক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেনঃ “Samar sen is an upto date representative poet. He needs to be progressive informing himself with a sense of history.” অর্থাৎ সমর সেন আধুনিক কালের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি হলেও ইতিহাস-বােধ-বিষয়ে আরাে অবহিত হয়ে প্রগতিশীল হওয়া প্রয়ােজন। সমর সেন আধুনিককালের কবি কিন্তু যুগধর্ম থেকে যেন পিছিয়ে পড়েছেন। সমকালের অনেক সমালােচকই সমর সেন বিষয়ে এ জাতীয় অভিমত পােষণ করেন।

সমর সেন রচিত কাব্যগ্রন্থঃ ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৩৭), ‘গ্রহণ’ (১৯৪০), ‘নানা কথা’ (১৯৪২), ‘খােলা চিঠি’ (১৯৪৩), ‘তিন পুরুষ’ (১৯৪৪) এবং পরে সংকলিত ‘সমর সেনের কবিতা’ (১৯৫৪)। সমর সেন স্বল্পজীবী ছিলেন না, ৭১ বৎসরের মাত্র ১২ বৎসর (১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত) তিনি কবিতা রচনা করেন, তারপরই কাব্যজগৎ থেকে অন্তর্হিত হন। কেন তার আর কোনাে সদুত্তর পাওয়া না গেলেও এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই-হয়তাে বা সমকালের যুদ্ধোন্মত্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে বঙ্গদেশের বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত যে রূঢ় বাস্তব চিত্র, তার সঙ্গে কবি তার মধ্যবিত্ত জীবনবােধের স্বপ্নকে মেলাতে না পেরে আর নিজের সঙ্গে আত্মবঞ্জনা করেননি, তিনি কাব্যজগৎ থেকেই সরে গেলেন। রােম্যান্টিকতাকে তিনি বর্জন করেছিলেন প্রথম জীবনেই,—এ বিষয়ে তার নিজস্ব বক্তব্য- “যৌবনের শুরুতে দু-একবার হোঁচট খেয়ে রােম্যান্টিক হাবভাব ছিল না।” প্রথম গ্রন্থেই তিনি নেমে এসেছিলেন বাস্তবের বৃঢ়তায়।

১৯৩৫-এ বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ‘কবিতা’ মাসিক পত্রটি প্রকাশিত হয়, সমর সেন ছিলেন এর সহকারী সম্পাদক এবং এতে তার ৪ টি কবিতা প্রকাশিত হয়। সম্ভবত কবি-বৃপে এই তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। ‘কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত সমর সেনের কবিতা কয়টি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “সমর সেনের কবিতা কয়টিতে গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে কাব্যের লাবণ্য প্রকাশ পেয়েছে এবং আরও বলেছিলেন, সাহিত্যে এঁর লেখা ট্যাকসই হবে বলেই বােধ হচ্ছে।” কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কবি সমর সেন অল্পদিনই কাব্যজগতে বর্তমান থাকায় তার পরিণত জীবনেও কাব্যস্বাদ থেকে পাঠকগণ বঞ্চিত হলেন। তৎসত্ত্বেও এ কথা অবশস্বীকার্য যে মাত্র ৩০ বৎসর বয়সেই অর্থাৎ যথেষ্ট অপরিণত অবস্থাতেই তার কাব্যজীবন সমাপ্ত করলেও কিন্তু তাতে পরিণতির পরিচয় বর্তমান। তার প্রথম কাব্যের ধূসরতা, মােহ বিষন্নতা ও অবক্ষয়িত জীবনের স্বরূপ উপলদ্ধি, এবং পরিণতিতে তা থেকে মুক্তির আকাঙক্ষা ও আশায় আলােময় জগতে উত্তরণ ঘটেছিল। এই পরিণতির জন্য কবিকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়নি। অবশ্য এ বিষয়ে লক্ষণীয় যে জীবনবােধের এই পরিবর্তনের জন্য কবিকে কাব্য-বিরােধিতার আশ্রয় নিতে হয়েছিল কবিতার আঙ্গিক আর বিষয়ের সংগতি বিধানে। এইখানেই কবি সমর সেন সমকালের অপরাপর কবিদের থেকে স্বতন্ত্র। তিনি সমকালের কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়কে গ্রহণ করেননি এবং সম্ভবত এই কারণেই তার কাব্যে একদিকে যেমন প্রথমাবধি গদ্যচ্ছন্দেরই প্রায় একাধিপত্য, তেমনি মাত্র ১২ বৎসরের মধ্যেই তাঁর কাব্যজীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তিনি একেবারেই গদ্যের জগতে চলে গেলেন।

কবির দ্বিতীয় কাব্য গ্রহণে’ই কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে এসে তিনি প্রথম রক্তপতাকা’র সন্ধান পেয়েছে। এই নবজাত আশ্বাসেই তিনি উচ্চারণ করেন-

“তবু জানি,

জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে জন্ম হবে

আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে।”

তবু এ কথা সত্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল ছায়ায় সমাচ্ছন্ন পৃথিবীর আসন্ন ভবিষ্যৎ কবিকে সংশয়ী করে তুলেছে—সূর্যে যে ‘গ্রহণ’ লেগেছে।

পরবর্তী দুই বৎসরের কবিতার সংকলন তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নানা কথা’। ‘নানা কথায়’ কবি প্রকরণের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। হ্রস্বায়ত ভাবগূঢ় কবিতা রচনার পরিবর্তে কবি এবার দীর্ঘযায়ত কবিতা রচনা করেন। এই পর্বেও কবি আশাবাদী, কারণ, সম্ভবত বিশ্বযুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়াও যুক্ত হবার ফলে কবি ভরসা করেছেন-

“অপরের শস্যলােভী, পরজীবী পঙ্গপাল

পিষ্ট হবে হাতুড়িতে, ছিন্ন হবে কাস্ততে।”

বলা বাহুল্য, ‘হাতুড়ি’ ও ‘কান্তের’ প্রতীকটি যথেষ্ট অর্থবহ।

পরবর্তী বৎসরই ৭ টি মাত্র কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘খােলাচিঠি’। সমকালের বিশ্ব ইতিহাসে যে বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, কবির তজ্জনিত মানস-প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ও রূপায়ণ ঘটেছিল আলােচ্য কাব্যের কবিতা কয়টিতে। তবে কবি যে দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ, তার স্বীকৃতি পাওয়া যায়— ‘আমার রক্তের ছন্দে আজো বাজে জাতির ধমনী।’

কবির পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘তিনপুরুষে’ কোনাে কোনাে দিক থেকে কিছুকিছু পরিবর্তন-চিহ্ন বর্তমান। সমর সেন আগাগােড়াই গদ্যকবিতা রচনা করেছেন, যদিও অনেক সময় তাদের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট ছন্দোবােধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কোনাে কোনাে কবিতায় সামান্য পরিবর্তনেই তা পদ্যছন্দে রূপায়িত হতে পারে। কিন্তু ‘তিনপুরুষে’র বেশ কয়েকটি কবিতায় তিনি পদ্যছন্দই ব্যবহার করেছেন, তবে সেই পদ্য এক রীতির নয়। সেখানে তিনি যথেষ্টই বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। যদি সেই পদ্যের জাতি অবিমিশ্র অক্ষরবৃত্ত তথা মিশ্রবৃত্ত, কিন্তু সর্বত্র তার ব্যবহার নির্দোষ নয়, কখনাে কখনাে যেন গদ্যছন্দের ছোঁয়া লেগেছে অথবা শব্দমধ্যস্থ যুক্তব্যঞ্জনকে বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে পড়তে হচ্ছে। তাই মনে হয়, গদ্যছন্দই সমর সেনের কবিতার প্রকৃষ্ট বাহন এবং তার কাব্যভাব স্বচ্ছন্দে ও সাবলীল গতিতে বয়ে যাবার পরিপূর্ণ অবকাশ লাভ করে গদ্যছন্দেই।