আধুনিক বাংলা কবিতায় চারের দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত কবি অরুণ মিত্র। জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের যশােহরে। শিক্ষালাভ কলকাতায়। কিছুদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেন। পরে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ নেবার জন্য চলে যান ফ্রান্সের রাজধানী সৌন্দর্যনগরী প্যারিসে। সেখানে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফেরেন। ১৯৫২ তে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে যােগ দেন। শেষ বয়সে আবার ফেরেন কলকাতায়।

দীর্ঘদিন দেশের বাইরে এবং কলকাতার বাইরে থাকলেও কবি চিরকাল কলকাতার প্রতি এবং দেশের প্রতি নিবিড় টান অনুভব করেছেন। সেই সঙ্গে ফ্যাসীবিরােধী আন্দোলনের সূত্রেই কবি ক্রমে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আদর্শে। ফলে শিকড়ের টান ও মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠতা কবি অরুণ মিত্রের প্রকৃতিগত বলা যেতে পারে।

সময়ের ও জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার পাঠগ্রহণের পাশাপাশি কবি অরুণ মিত্র নিঃশব্দ নির্জনে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মবীক্ষণে নিজেকে শুদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে চান। তিনি একই সঙ্গে জীবনরসে মত্ত ও আত্মধ্যানে মগ্ন কবি।

রবীন্দ্রনাথের ভয়ংকর আগ্রাসী প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার আতিশয্যবহুল প্রচেষ্টা পূর্ববর্তী আধুনিক কবিদের ভাষা-ছন্দ-বিষয়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল, চারের দশকে সেই অস্থির আবর্তের ক্লেদ ফেনা অনেকটা অবসিত। এর মধ্যে কবিরা পেয়ে গেছেন আধুনিক কবিতার একটা স্বতন্ত্র শৈলী, ভাষা, বিষয়, ভঙ্গি। এ সময় তাই বাহ্যপােশাকে আধুনিক হবার সচেতন কৃত্রিম প্রয়াস ছেড়ে কবিতা আত্মজিজ্ঞাসার আত্মবিশ্লেষণের সুযােগ পেয়েছিলেন।

এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে, অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্নীতি, বেকারত্ব, কালােবাজারির থাবায়, পুঁজিবাদের আগ্রাসী ক্ষুধায় মানবত্বের ক্রমাগত অবনমনে আধুনিক কবিতায় যে অনিবার্য নৈরাশ্য ও শূন্যতাবােধের সৃষ্টি হচ্ছিল সেই নৈরাশ্য থেকে, নিরুপায় আত্মসমর্পণ ও মৃত্যুর গ্রাস থেকে মুক্তির ইশারা মিলল সেভিয়েতের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়েই নির্মিত হল মানবমুক্তির স্বপ্ন, ঝংকৃত হল আশাবাদী সুর।

জার্মানী-জাপান-ইতালির ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী আক্রমণে পিষ্ট দলিত হওয়াই যে মানবতার শেষ পরিণাম নয়, সম্মিলিত মানবাত্মার বিজয়ই যে অবশ্যম্ভাবী, সেই আশাবীজ সােভিয়েত বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনা তৎকালীন মার্কসবাদে বিশ্বাসী কবিবৃন্দের সঙ্গে সঙ্গে কবি অরুণ মিত্রকেও দিয়েছে এক শান্ত অচল বিশ্বাসের ভূমি। তাই তাঁর কবিতায় এল শাস্ত সংহত উচ্চারণ, বাহ্যদৃষ্টির বাহুল্য থেকে শােনা গেল আত্মসন্ধানের আর্তি, নৈরাশ্যের কুহেলিকা ভেদ করে সদর্থক চেতনা বিকাশের উজ্জ্বল সুর।

বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, কালােবাজারী, ফ্যাসিবাদ, মৌলবাদের পাশবিকতায় কবি যেমন ক্রোধে ঘৃণায় শিহরিত হন, তেমনি সােভিয়েতের মধ্যেই দেখতে পান মানবমুক্তির ইশারা, শুনতে পান নবপ্রভাতের অনুচ্চ ভৈরবী সুর। তাঁর কবিতায় তাই মিশে যায় চড়া ও স্নিগ্ধ বর্ণ, কড়ি ও কোমল সুর। কখনাে তাঁর কবিতা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে ওঠে, আবার কখনাে হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ কল্যাণময় সাঁঝবাতি। নির্জন প্রকৃতির ঘাস-পাতা-সোঁদা মাটির মিঠে গন্ধ যেমন উঠে আসে, তেমনি উঠে আসে জনবহুল কলকাতা নগরীর খণ্ডচিত্র, মুটে-মজুরের জীবনের ঘাম ও কান্না। তার কবিতায় যেমন মেলে উজ্জ্বল মানবিক দিকগুলির জলছবি, তেমনি যন্ত্রণার্ত সময় ও শােষণ-পীড়নের দগ্ধচিত্র।

ফ্যাসিবিরােধী আন্দোলন ও মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্কে অংশগ্রহণ করে কবি কমিউনিজমে দীক্ষিত করেছিলেন নিজেকে। তাই বিশ্বমানবমুক্তির স্বপ্ন তার মনে দানা বেঁধেছিল উজ্জ্বল বর্ণে। “হিটলারের নৃশংস বিভীষিকাময় সাম্রাজ্যবাদী চেহারা তাঁকে শিহরিত করে, প্রতিনিয়ত বিবেক দংশনে তিনি ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন।…এ কারণে কবি অরুণ মিত্রের কবিতায় কবিমনের ভাবাদর্শের স্ফুরণ কঠোরে-কোমলে মাখামাখি। হিটলারের বিরােধী মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার ভূমিকাকে তিনি একরকম শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষের আগামীদিনের মুক্তির ইশারা হিসেবে দেখেন।”

‘কসাকের ডাক : ১৯৪২’ কবিতায় রাশিয়াকে সামনে রেখেই কবি বিশ্বমানবমুক্তির ডাক দেন। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এই স্বপ্নপূরণের জন্যই তিনি রাশিয়ার পাশে দাঁড়ানাের জন্য আহ্বান জানান। তার এই আহ্বান তাই অনায়াসে স্বদেশ বা রাশিয়ার আপামর মানুষের মুক্তির কথাই শুধু বলে না, তা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক হৃদয়ের স্বপ্ন

“কৃষ্ণসাগরের কাল ফণায় অপূর্ব আক্রোশ

দুশমন।

আজভের মাথার উপরে ঝাপট,

ডনের রক্তস্রোতে ডাক ;

সাথী, কাধে কাঁধ মেলাও

সাদা রুশিয়ার ভাই হাে

বড় রুশিয়ার ভাই

সারা দুনিয়ার ভাই হাে

একসাথে দাঁড়াই।”

সমালােচক লিখেছেন— “ধ্বস্ত সময়ের জ্বালা যন্ত্রণা, বুর্জোয়াশ্রেণির শােষণ ও তার প্রতিরােধ, দুর্ভিক্ষ-মহামারীর কথা যেমন কবি অরুণ মিত্রের কবিতায় উঠে এসেছে চিত্রিত ছবি হয়ে দগ্ধ-আগুনের সাম্যবাদী চেতনার বাঁশির সুরের মূর্ছনায়, তেমনি উঠে এসেছে তাঁর কাব্য নাগরিক চেতনাবােধও। কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনযন্ত্রণাকে তিনি যেমন নিপুণ চিত্রকরের মতাে তাঁর কবিতায় শব্দ-বন্ধনে তুলে ধরেছেন জীবনরসের সুধা মাখিয়ে, তেমনি কলকাতাকে কেন্দ্র করে তিনি করেছেন…কবি আত্মার প্রীতি-প্রেম-ভালােবাসার আত্মউন্মােচন।” কিন্তু কবি অরুণ মিত্রের কবিমানসের মূল বৈশিষ্ট্য এই বাহ্যচিত্র অঙ্কনে নয়, আত্মবীক্ষণে।


তিনি বারবার সমস্ত দৃষ্টিকে সংহত করে ধ্বস্ত সময় ও আলােড়িত কালের চঞ্চলতার মধ্যেও অন্তরের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। মধ্যবিত্ত মানসের যাবতীয় সুযােগ সন্ধান ও দ্বিচারিতার আগাছাকে নিজের সত্তার ভিতর থেকে উপড়ে ফেলতে চান। মানবিক চৈতন্যের আলােয় তিনি মানবত্বের শুদ্ধ পথটির সন্ধান করেন। সেই আলােয় সমস্ত ভ্রান্তি ও উৎকেন্দ্রিকতা থেকে তিনি নিজেকে বদলাতে চান। সেই আত্মবিবেকের মশালের আলাে জ্বেলে তিনি রচনা করেন এক আলােকিত স্বপ্নভুবন। তার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম— ‘উৎসের দিকে’। যথার্থই তিনি বারবার ফিরতে চান সেই উৎসের দিকেই। এই কাব্যগ্রন্থের ‘আমার কাছে বদলে যায়’ কবিতায় কবি পরম মমতায় নির্মাণ করেন সেই স্বপ্নের ভুবনটিকে

“আমার কাছে বদলে যায়।

কান্নার দুটি চোখ, রাত্রি

যেখানে আরাে রাত্রির দিকে দরজা খােলা,

টুপটাপ ফুল আর শিশিরের মাঝখান দিয়ে যে নিরুদ্দেশ

তার সামনে আমার অবস্থান,

ঘণ্টা বেজে বেজে যখন ঝিমিয়ে পড়ে 

আমি নাড়া দিয়ে নতুন কণ্ঠ জাগাই

প্রেম আর বাসনার চিত্রপট আলাের গুচ্ছে সাজাই।”

কবি ও প্রাবন্ধিক জহর সেনমজুমদার অরুণ মিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেন—“শান্তির শিশির মুক্তা-ঝলমলে এক পৃথিবী তিনি চেয়েছেন, যেখানে মানুষের উচ্ছল বেঁচে থাকার শ্রোতে উচ্ছাসের সমস্ত আলাে জ্বলে ওঠে। পৃথিবী, ধুলাে, নদী, ফসল, ধানশিষ, অশ্বারােহী সেনা ইত্যাদির অজস্র রূপ দেখতে দেখতে একসময় বিভাের হয়ে যান। সেই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সঙ্গে যােগস্থাপনে আগ্রহী অরুণ মিত্রের চারপাশে ক্রমে ঘনিয়ে আসে ধুলাে-মাটির গান।”

কবির ঘরে ফেরার নিশানা হয়

“দুৰ্বোয় কয়েকটা ছােপ

ধানের গুচ্ছের একটু ছটা

কয়েকটা দোয়েল ফিঙে টুনটুনি…”

নৈরাশ্য নয়, অরুণ মিত্রের কবিতায় কেবলই উচ্চারিত হয় সঞ্জীবনের—উজ্জীবনের সুর। সাতের দশকের ভয়ংকর বীভৎসতা ‘শুধু রাতের স্বপ্ন নয়’ কবিতায় অঙ্কিত হলেও সেখানেও কবি রাত্রিজয়ী প্রভাতকেই বরণ করেছেন। শিকড়ের টান, দেশ মাটিকে ভালােবাসা, মানবত্বের প্রতি বিশ্বাস, শুভদিনের সােনালি স্বপ্ন কবির কাব্যে হয়ে ওঠে এক জাদুকাঠি-

“দরজাটা শুধু ভেজানাে

আমি হাত দিতেই পাল্লা সরে যায়।”