বাংলা সাহিত্যে তরুণ কথাশিল্পী সােমেন চন্দের নামটি সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। বিশ শতকের চতুর্থ দশকের মধ্যভাগ থেকে পঞ্চম দশকের সূচনাকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে পদচারণার সুযােগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যেই তার গল্প অসাধারণ পরিণতির চিহ্ন বহন করেছে। তাছাড়া প্রগতিসাহিত্য আন্দোলন ও ফ্যাসিবিরােধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কালে মার্কসবাদী জীবনদৃষ্টি, রাজনৈতিক সক্রিয়তার পরিণাম হিসাবে সােমেন চন্দের রাজনৈতিক নিহত হবার ঘটনাটিও তাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

তার প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’ ১৯৩৭-এ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই পর্বেই লেখা ‘ভালাে না লাগার শেষ’, ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ ইত্যাদি গল্প। তার মােট গল্পের সংখ্যা বেশি নয়। মাত্র বাইশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে (১৯২০-৪২) এবং মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের সাহিত্যজীবনে তাঁর গল্পের সংখ্যা মাত্র ২৪/২৫ টির মতাে।

‘শিশু তপন’ একান্তই আবেগপ্রবণ রচনা। কিন্তু সমকালেই লেখা পূর্বে উল্লেখিত অন্য গল্পদুটিতে যথেষ্ট পরিণতির ছাপ আছে। ‘ভালাে না লাগার শেষ’ একটি রােম্যান্টিক প্রেমকাহিনি। স্বাতন্ত্রাসন্ধানী আধুনিকা নারী শেষ পর্যন্ত কেমন করে প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তা-ই গল্পটির বিষয়। ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেকদিনের একদিন’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েব রচনার কথা স্মরণ করায়। অন্ধ শ্রীবিলাস তার অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে চায় ক্লান্ত অনিচ্ছুক স্ত্রীর উপর উগ্র কামনার প্রকাশে। এই বিকৃত মনস্তত্ত্বের গল্পটি সােমেন চন্দ লিখেছেন মাত্র সতেরাে বছর বয়সে— এটাই আশ্চর্যের।

সােমেন চন্দের শ্রেণিচেতনার প্রকাশ ঘটেছে ‘অমিল’ গল্পে। ধনী ঘরের কন্যার সঙ্গে দরিদ্র বান্ধবীর সম্পর্কটি এখানে উন্মােচিত। কেননা ধনী-কন্যাটি তার দরিদ্র বান্ধবীকেই শেষ পর্যন্ত চোর বলে মনে করেছে এই গল্পে। ‘রাণু ও স্যর বিজয়শংকর’ গল্পেও ধনী বিজয়শংকর কী এক অতৃপ্তি বহন করে চলেন। স্বপ্নে দেখেন দরিদ্র কন্যা রাণুকে।

সােমেন চন্দের মনস্তত্ত্বমূলক গল্প ‘স্বপ্ন’। নৌকোর স্বপ্ন দেখলে মৃত্যু সুনিশ্চিত এই কুসংস্কার ভর করে গল্পের নায়ক শঙ্করের মাথায়। সেও একদিন নৌকোর স্বপ্ন দেখে। মৃত্যু আসন্ন জেনে জীবনসম্ভােগের পথ হিসাবে সে দোকানের খাবার খায় যথেচ্ছ এবং কলেরায় মারা যায়।

সােমেন চন্দের রাজনৈতিক গল্প ‘দাঙ্গা’ ও ‘একটি রাত’। ‘দাঙ্গা’ গল্পে সােশালিস্ট ও কমিউনিস্ট মতাদর্শের দ্বন্দ্বের মধ্যেও বড়াে হয়ে ওঠে মানবিক বােধ। ‘একটি রাত’ গল্পে গাের্কির ‘মা’ পড়ে সুকুমারের সাধারণ গৃহবধূ ‘মা’ কেমন করে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন তা দেখানাে হয়েছে।

সােমেন চন্দের অতি পরিচিত এবং বিখ্যাত গল্প ‘ইঁদুর’। মধ্যবিত্ত শ্রেণির আত্মপ্রবঞ্জনা এই গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আগ্রাসনে মধ্যবিত্তের নৈতিকতা, মূল্যবােধের বিনষ্টি যেন ইঁদুরের আক্রমণে সম্পদের বিনষ্টির সদৃশ্য। সেই বিনষ্টিকে প্রতিরােধ করতে পারে না মধ্যবিত্ত চেতনা। এই গল্পের নায়ক শ্রমিক আন্দোলনের পথে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু নায়কের পিতা দু’একটি ইদুর ধরা পড়েছে ভেবেই যথেষ্ট আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন।

জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সােমেন চন্দ তার ছােটোগল্পে যে পরিণত ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যই বিস্ময়কর। আরাে লক্ষ্যণীয়, প্রগতিসাহিত্য ভাবনার ও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে লালিত হলেও সােমেন চন্দের গল্প রাজনীতি কখনও আরােপিত হয় নি। অর্থাৎ মানবমন, মানুষের আবেগ, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ইত্যাদি সমস্ত বিষয়েই সােমেন চন্দ গল্প লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেই সঙ্গে রাজনীতি প্রসঙ্গও এসেছে অনিবার্যভাবে। কমিউনিস্ট আদর্শ বা প্রগতিসাহিত্যের নীতি প্রচার করতে গিয়ে কথাশিল্পকে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত করেন নি। এখানেই সােমেন চন্দের বিশিষ্টতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র বাইশ বছর বয়সেই দুষ্কৃতীদের আক্রমণে নৃশংসভাবে মৃত্যু হয় সােমেন চন্দের। ফলে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ সাহিত্য প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের পরিচয় পেতে বঞ্চিত হয়ে গেল বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি পাঠক।