অথবা, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ আধুনিক রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও ব্যাপক রাজনৈতিক কার্যকলাপ রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। উদারপন্থি রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পর্যন্ত সর্বত্রই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব স্বীকৃতিলাভ করেছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের ভূমিকাঃ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল বিভিন্ন ধরনের কার্য করে থাকে। তবে তাদের কার্যাবলী বা ভূমিকা আলোচনা করার আগে বিরোধী দল কি তা আলোচনা করা দরকার।
বিরোধী দলের ভূমিকাঃ আধুনিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল যে ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে তা নিম্নরূপ-
(১) সরকারকে নিয়ন্ত্রণঃ সরকার বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। সরকার যাতে কোনো রকমে কুপথে চলতে না পারে তার জন্য বিরোধী দল সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। তবে তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমালোচনা করে থাকে৷ বিরোধী দল গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে সরকারের আপত্তিকর নীতির বিরোধিতা করে এবং সরকারের বিভিন্ন দোষত্রুটি উদঘাটন করে। জনগণের অভাব-অভিযোগ সরকারের কাছে তুলে ধরে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপের মুখে রাখে। জাপানে বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনার মুখে সাম্প্রতিককালে কিচি মিয়াজাওয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
(২) রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোঃ দেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষার সাথে সাথে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো কিছু কিছু মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। আইনসভায় বিরোধী দল কর্তৃক সরকারি নীতির ও কর্মসূচির সমালোচনা বিশেষ করে বাজেট অধিবেশন, আমদানি-রপ্তানি নীতি প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিষয়াবলির আলোচনা, সেমিনার প্রভৃতি অনুষ্ঠান করে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলে।
(৩) জনমত গঠনঃ বিরোধী দল জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবাদ পত্র, সভা সমিতি ও অন্যন্য উপায়ে বিরোধী দল তাদের নীতি ও কর্মসূচি প্রচার করে থাকে। তারা সরকারি দলের দোষ-ত্রুটি জনসমক্ষে তুলে ধরে এবং নিজ দলের কর্মসূচি প্রচার করে জনগণকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
(৪) শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল হচ্ছে বিকল্প সরকার। কেননা নির্বাচনে জয়লাভ করলে বিরোধী দল ক্ষমতালাভের বা সরকার গঠনের সুযোগ পায়। এতে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের বিরোধী দলের উচিত শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিবর্তনের চেষ্টা করা।
(৫) স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনঃ দেশের বিরোধী দল সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে স্বৈরাচারের পথকে রুদ্ধ করে দেয়। সরকারি দল বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে স্বৈরাচারী হতে পারে না। স্বৈরাচারি সরকার কিছু করলে জনসমর্থন হারায়। ফলে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(৬) সমস্যা নির্ধারণ ও প্রতিকারঃ দেশের বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নির্ধারণ ও তার প্রতিকারের সঠিক উপায় নির্ণয় করে বিরোধী দল সমগ্র জাতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
(৭) জনগণকে সচেতন করাঃ বিরোধী দল জনগণকে সচেতন করে রাখে। সরকারি দলের কাজ হলো নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন। এ সময় বিরোধী দল মূলত জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তপ্ততা বজায় রাখে এবং জনগণকে সচেতন করে তোলে।
(৮) আইন প্রণয়নে সহায়তাঃ বিরোধী দলের উচিত জনগণের স্বার্থে রচিত আইনগুলি বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য ও সহযোগিতা করা। আইনসভার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরোধী দল অনন্য ভূমিকা পালন করে।
(৯) গণতন্ত্র রক্ষাঃ বিরোধী দল গণতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কোনো রকমে সরকারের পতন হলে এবং শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে রাষ্ট্র পরিচালনায় এক প্রকার অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে গণতন্ত্রের ধারা কোনোরকম ব্যাহত হয় না।
(১০) জাতীয় ঐকমত্যঃ দেশের জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি গঠন করার জন্য সর্বদা বিরোধী দল সচেষ্ট থাকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ তথা সকল মানুষের জন্য সমভাবে অধিকার দিতে হবে। দলীয় নীতি ও কর্মসূচি সবার জন্য সমানভাবে ভোগের সুযোগ দিতে হবে।
(১১) জনগণের অধিকার রক্ষাকরণঃ বিরোধী দল আবার জনগণের বিভিন্ন অধিকার রক্ষা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় অবৈধভাবে সরকারি দল জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার প্রয়াস পায়। তখন বিরোধী দল বাধা দেয়। এ ধরনের ঘটনা সরকারি দল স্বাভাবিকভাবে ঘটায় না।
(১২) বিকল্প সরকারঃ দেশের বিকল্প সরকার বলতে বিরোধী দলকে বোঝায়। কোনো নির্বাচনে বিরোধী দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তবে তারা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আর এজন্য তারা সর্বদা তৎপর থাকে। তারা সরকারের প্রতিটি দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে। এ নিয়ে কীভাবে কি করা যাবে না যাবে তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন।
(১৩) সরকারের সমালোচনাঃ এটি বিরোধী দলের প্রধান কাজ। দেশের সরকার যখন বিভিন্ন ধরনের ভুল-ত্রুটি করে চলে তখন বিরোধী দল তা ফলাও করে জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে। এর ফলে জনগণ সরকারের বিভিন্ন দোষ ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে; যাতে করে তারাও সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিপ্ত হয়। তবে এটি সাধারণত গঠনমূলক, মানবিক, কল্যাণমূলক হয়ে থাকে।
(১৪) সংসদের কাজকর্মে অংশগ্রহণঃ দেশের কাজকর্মের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না তা তারা তদন্ত করে। এ জন্য তারা দেশের সংসদীয় কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে। বিরোধী দলের সদস্যগণ সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আইন পাশ, বাজেট পাশ, আলোচনা বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দল রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্যদিকে বিরোধীদলকে সংসদে গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলে চলবে না।
Leave a comment