প্রশ্নঃ আধুনিক আইন বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান পরিধি চিত্রায়িত কর এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের সহিত তাহার সম্পর্ক নির্ণয় কর।

আধুনিক আইন বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান পরিধি এবং অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের সাথে এর সম্পর্কঃ আইনবিজ্ঞান আইনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ স্বরূপ। ইহা কোন দেশের আইন বা নির্দিষ্ট আইন পর্যবেক্ষণ করে না। সামগ্রিকভাবে আইনের সূত্রগুলিকে বিশ্লেষণ করে। আইনগত বিধানের প্রকৃতি, আইনগত ধারণার ব্যাখ্যা এবং আইন ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান আলোকপাত করে। এছাড়া আইনের প্রয়োজনীয়তা, নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের সাথে আইনের সম্পর্ক অনুসন্ধান করে আইনবিজ্ঞান। তাই আইনবিজ্ঞানকে আইনের দর্শন বলা হয়। আবার আইনবিজ্ঞানকে আইনের ব্যাকরণ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সামাজিক বিজ্ঞান কি তার কোন সহজ ও সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জনে নিয়োজিত বিষয়গুলিকে মোটামুটিভাবে সামাজিক বিজ্ঞান বলা যায়। সমাজ বলতে কতিপয় লোকের বা গোষ্ঠির বসবাস বা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠি বুঝায় না। সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য যারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি এগিয়ে আসে এবং যারা একটা অভিন্ন ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অধিকারী এরূপ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিকে সমাজ বলা যায়। আর বস্তুনিষ্ঠভাবে অর্থাৎ নিরপেক্ষভাবে তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষিত তত্ত্বের মাধ্যমে অধ্যয়ন করা হচ্ছে বিজ্ঞান। তাই সমাজ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়নই হচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান।

একটি সমাজ বেশ জটিল বিষয়। সমাজের বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করতে গিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সৃষ্টি হয়েছে। তাই সমাজতত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও আইনবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ কি করে এবং কেন করে এর জবাব খোঁজে সমাজ বিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞান বা সামাজিক মনোবিজ্ঞান। কিন্তু মানুষ তার নিজ খেয়াল খুশী মতো আচরণ করতে পারে না, তাহলে অন্যের অসুবিধা হতে পারে। আবার অন্যের অসুবিধা হতে পারে এ আশংকায় তার আচরণ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না। তাই পারস্পরিক সংঘাতকে পরিহার করার উদ্দেশ্যে যুক্তিসম্মত মাত্রায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। আইন এরূপ নিয়ন্ত্রণের একটি পন্থা। সমাজে বাস করতে হলে মানুষকে কি করতে হবে তার নির্দেশ দেয় আইন।

বিভিন্ন আইনবিজ্ঞানীগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। স্যামন্ড (Salmond) আইনবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, দেশের আইনের প্রাথমিক মূল নীতিগুলির বিজ্ঞান হচ্ছে আইনবিজ্ঞান (The science of the first principles of civil law)। রোমান আইনশাস্ত্রবিদ আলপিয়ানের মতে, মানবিক ও ঐশ্বরিক বিষয়বস্তুর পর্যবেক্ষণ এবং ন্যায় অন্যায়ের বিজ্ঞান হচ্ছে আইনবিজ্ঞান। বৃটিশ আইনবিজ্ঞানের জনক নামে পরিচিত স্যার জন অষ্টিন আইনবিজ্ঞানকে মনুষ্য কর্তৃক নির্ধারিত আইনের দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (A philosophy of positive Laws)। অপর একজন রোমান আইনবিশারদ সিসারো আইনবিজ্ঞানকে দর্শন শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন। তার মতে, দর্শন শাস্ত্রের নিরিখেই আইনকে অধ্যয়ন করতে হবে। বেনথাম বলেন যে, প্রচলিত আইনের বিস্তৃত আলোচনা ও আদর্শ আইনভিত্তিক সম্পর্কিত ধ্যান ধারণাই হচ্ছে আইনবিজ্ঞান। প্রখ্যাত জুরিস্ট প্যাটন আইনবিজ্ঞানকে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত আইনশাস্ত্র বা সমতার নীতি সম্পর্কিত আইনশাস্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেন অধ্যাপক হল্যাণ্ড (Holland)। তার মতে, যথার্থ আইনের আনুষ্ঠানিক বিধান হচ্ছে আইনবিজ্ঞান (The formal science of positive Law)। আইনের শাসন দ্বারা মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিধিই হচ্ছে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান।

সদা পরিবর্তনশীল সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধের উপর নির্ভরশীল আইনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আইনবিজ্ঞানকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আইনবিজ্ঞান শুধু আইন জানতে সাহায্য করে না; আইন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার, গবেষণা করার এবং প্রয়োগ সম্পর্কে শিখতে সাহায্য করে। ক্রমবর্ধমান আইনবিজ্ঞানের পরিধির মধ্যে মূলতঃ নিম্নোক্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভূক্তঃ- 

প্রথমতঃ প্রখ্যাত আইনবিজ্ঞানী প্যাটনের মতানুসারে আইনবিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে আইনের প্রকৃতি, আইনগত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রকৃতি, এগুলির বিকাশ এবং সমাজের সাথে এগুলির সম্পর্ক অধ্যয়ন করা। সামাজিক প্রয়োজনেই আইনের উদ্ভব এবং সামাজিক মূল্যাবোধের উপরই এই আইনের ভিত্তি। কাজেই আইন যে সকল সামাজিক প্রয়োজন মেটায় তা সকল সমাজে এক নয়। কাজেই এ সকল প্রয়োজনের কোন সমাধান আইনবিজ্ঞান দেয় না বটে, তবে এ সম্পর্কে আইনের তত্ত্ব বা নীতি সম্পর্কে আইনবিজ্ঞান নির্দেশ দেয়। আইন আইনগত ধারণাসমূহ এবং সমাজ জীবনের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে আইন বিজ্ঞান৷

দ্বিতীয়তঃ আইনবিজ্ঞান আইনগত ধারণাসমূহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। অন্যায় বা অবৈধ কার্য, আইনগত ক্ষতি, অভিপ্রায়, মোটিভ, অবহেলা, মালিকানা, দখল ইত্যাদি আইনগত ধারণা বিভিন্ন আইন গ্রন্থে আলোচিত হয়। কিন্তু এগুলির উৎপত্তি · ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয় আইনবিজ্ঞানে। ব্যাকরণ যেমন ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে, আইনবিজ্ঞান আইনের মৌলিক ধারণাসমূহ বিশ্লেষণ করে আইনকে সহজতর করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘অধিকার ও কর্তব্য’ সম্পর্কে যে তত্ত্বগত বিশ্লেষণ আইনবিজ্ঞান করে থাকে তার ওপর ভিত্তি করে সমাজের আইনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এ সকল আইনগত ধারণাসমূহও পরিবর্তিত হয় এবং এর উপর প্রভাব বিস্তারকারী সামাজিক উপাদানগুলি আইন বিজ্ঞানে আলোচিত হয়।

তৃতীয়তঃ আইনগত কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ও আইনবিজ্ঞান অনুসন্ধান করে। আইন প্রণয়ন, বিধিবদ্ধকরণ, বিচারের পূর্ব দৃষ্টান্ত অনুসরণ, বিচার কার্যে বস্তুনিষ্ঠ নীতি অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ও আইন বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত।

চতুর্থতঃ ন্যায় বিচার পরিচালনার জন্য এর মূল নীতিগুলিও আইনবিজ্ঞানে আলোচিত হয়। এছাড়া আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা করা এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করে আইন বিজ্ঞান।

পঞ্চমতঃ আইনের উৎস ও বিবর্তন ছাড়াও এর গবেষণামূলক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং নৈতিক বা দার্শনিক বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ।

আইনবিজ্ঞানের এরূপ ব্যাপক বিস্তৃত পরিধির কারণে একে সমাজ পরিচালনার প্রকৌশলগত দিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৌশলী যেমন তার জ্ঞানকে প্রকৌশল শাস্ত্র বিভাগে ব্যবহার করে, তেমনি আইনবিজ্ঞান একটি নিয়মতান্ত্রিক বিজ্ঞান হিসেবে আইনের বিভিন্ন দিককে বিকশিত হতে সাহায্য করে। যেহেতু মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে আইন সেহেতু অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান যথা সমাজতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, ইত্যাদি সকলের সাথে আইনবিজ্ঞানের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তাই আইনবিজ্ঞান যথার্থভাবে অধ্যয়ন করতে হলে এ সকল সামাজিক বিজ্ঞান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যেহেতু আইন মানুষের সার্বজনীন কল্যাণে নিবেদিত, সেহেতু আইনবিজ্ঞানের অধ্যয়ন অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাথে সংপৃক্ত করে বৃহত্তর সামাজিক গন্ডির মধ্যে অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে।