এনসাইক্লোপিডিয়ায় বলা হয়েছে যে, আধুনিক উপনিবেশবাদের জয়যাত্রা শুরু হয় পঞ্চদশ শতকে। নবজাগরণের প্রভাবে ইউরােপের মানুষ অচেনা ও অজানাকে জয় করার উদ্দেশ্যে জলপথে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়ে। এর ফলে তারা বিভিন্ন নতুন ভূখণ্ডে পৌঁছােয় এবং এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে সর্বপ্রথম উপনিবেশ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। উনবিংশ ও বিংশ শতকে এই দুই মহাদেশের অধিবাসীর সংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার ২/৩ অংশ হলেও এই সময়ের সিংহভাগ জুড়েই এখানকার অনেকখানি ভূখণ্ড ইউরােপীয় ঔপনিবেশিকদের দখলে ছিল। তাই অরগ্যানস্কি তাঁর ‘ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স’ গ্রন্থে বলেছেন যে, আধুনিক উপনিবেশবাদ হল একটি ইউরােপীয় বিষয়।

[1] ইউরােপীয়দের যাত্রা শুরু: ইউরােপীয় শক্তিগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম পাের্তুগাল ও স্পেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। পাের্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে জলপথে আফ্রিকা মহাদেশের উপকূল অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছােন। পরবর্তী এক শতাব্দীর মধ্যে ইউরােপের বিভিন্ন রাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পৌঁছােয় এবং এসব স্থানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পঞ্চদশ শতকের পরবর্তী সময় থেকে বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাড়ে চারশাে বছরে ইউরােপের ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, পাের্তুগাল, স্কটল্যান্ড, জামানি প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের প্রসার ঘটলে শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করা এবং উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে ইউরােপের শিল্পোন্নত বিভিন্ন দেশ উপনিবেশের বাজার দখলে এগিয়ে আসে। এই সময় উপনিবেশের অধিকার নিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়।

[2] এশিয়ায় অবস্থিত বিভিন্ন উপনিবেশ: আধুনিককালে এশিয়ার ভারতীয় উপমহাদেশ, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, মালয়, এডেন, হংকং, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি এশীয় দেশগুলিতে ইউরােপের বিভিন্ন দেশের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশিষ্ট জাপান, চিন, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান, ইরান প্রভৃতি কয়েকটি রাষ্ট্র নামেমাত্র স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।

[3] আফ্রিকায় অবস্থিত বিভিন্ন উপনিবেশ: ষােড়শ শতকের পরবর্তীকালে আফ্রিকা থেকে ইউরােপ ও আমেরিকায় ক্রীতদাস রপ্তানি করা হত। ইউরােপীয় শক্তিগুলি উনবিংশ শতকের শেষদিকে এখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। প্রথমদিকে ইথিওপিয়া এবং লাইবেরিয়া ছাড়া আফ্রিকার অবশিষ্ট ভূখণ্ডে (ঘানা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, রােডেশিয়া, উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, মরক্কো, টিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মাদাগাস্কার, কঙ্গাে, রােয়ান্ডা, বুরুন্ডি, অ্যাঙ্গোলা, মােজাম্বিক প্রভৃতি অঞ্চল) পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইথিওপিয়াও ইতালির উপনিবেশে পরিণত হয়।

[4] আমেরিকায় উপনিবেশ: ইংল্যান্ড যােড়শ শতকে আমেরিকায় ত্রয়ােদশ উপনিবেশ গড়ে তােলে। পরবর্তীকালে আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলে ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। লাতিন আমেরিকায় ইউরােপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসনের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র আমেরিকায় ইউরােপীয় উপনিবেশের প্রসার ঘটে।

বিভিন্ন উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রাম

দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণের শিকার বিভিন্ন উপনিবেশ আন্দোলনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হয়ে আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

  • [1] ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ত্রয়ােদশ উপনিবেশে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। শেষপর্যন্ত ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার ত্রয়ােদশ ব্রিটিশ উপনিবেশ মুক্ত হয়। আমেরিকার অন্যান্য ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলি ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করে।

  • [2] এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) পর থেকে বা বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে।

  • [3] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) পরবর্তীকালে এশিয়া মহাদেশের ভারত, সিংহল, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচিন, মালয়, ফিলিপিনস প্রভৃতি দেশে, আফ্রিকা মহাদেশের নাইজিরিয়া, আলজেরিয়া, উগান্ডা, মরক্কো, কেনিয়া, গােল্ডকোস্ট প্রভৃতি দেশে জাতীয়তাবাদের দ্রুত প্রসার ঘটে এবং পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়।