আদি-মধ্যযুগের ভারতে জগন্নাথ উপাসনা :
জগন্নাথদেব ও জগন্নাথ উপাসনার উদ্ভব ও বিকাশের প্রেক্ষাপটে উড়িষ্যা রাজ্যের ভৌগোলিক বিন্যাস ও আদি-মধ্যযুগের সূচনাপর্বে নানা ধর্মমতের আবির্ভাব, সমাবেশ ও পরিণতিতে সমন্বয়ের ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মহাপ্রভু জগন্নাথের ক্ষেত্র বর্তমান উড়িষ্যার নানা অংশ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বৈতরণী নদীর উপত্যকাসহ গোটা উপকূলভাগ ‘কলিঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল। মৌর্যরাজা অশোকের আমলেও ‘কলিঙ্গ’ নামটি প্রচলিত ছিল। অশোক কলিঙ্গ বিজয়ের পর একে উত্তর ও দক্ষিণ দুটি অংশে বিভক্ত করেন। যথাক্রমে ‘তোমালী’ ও ‘সোমপা’ ছিল এই দুই অংশের প্রধান কর্মকেন্দ্র। আদি-মধ্যযুগে ভৌম রাজাদের তাম্রশাসন থেকে জানা যায়— তোমালী, কোঙ্গদসহ উত্তরাংশ ভৌম শাসনাধীন ছিল। এবং কলিঙ্গসহ দক্ষিণভাগ শাসন করত আদি গঙ্গ রাজবংশ। পরবর্তীকালে তোসালীকেও উত্তর ও দক্ষিণ—এই দু ভাগে ভাগ করা হয়। বর্তমান উড়িষ্যা নামকরণ হয়েছে ‘ওড্রবিষয়’ নাম থেকে, যা আদি-মধ্যকালে উত্তর তোসালীর অংশ ছিল। বর্তমান উড়িষ্যার পশ্চিমাংশ (মহানদী উপকূল ভাগ) দক্ষিণ কৌশল নামে পরিচিত ছিল। সোমবংশী শাসনকালে এটি তোসালীর অন্তর্ভুক্ত হয়। একইভাবে উত্তর ভাগ পরিচিত ছিল ‘উৎকলদেশ’ নামে। বর্তমানে গঞ্জাম ও পুরী জেলার নাম ছিল ‘কোঙ্গদ’। উড়িষ্যার এই সমগ্র ভৌগোলিক একক শ্রীজগন্নাথ ধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাথমিক পর্বে এই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে জগন্নাথ উপাসনা আবদ্ধ ছিল ; গঙ্গবংশের রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ উপাসনাও সন্নিহিত অঞ্চলগুলিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পুরুষোত্তম জগন্নাথ উপাসনার বিকাশের পশ্চাৎপটে উড়িষ্যা ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মমতের আবির্ভাব, প্রসার ও পরিণামে একটি সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির উদ্ভবের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতাত্বিক উপাদান ও সাহিত্যসূত্রের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, যীশুখ্রিস্টের আবির্ভাবের আগে থেকেই কলিঙ্গ নানা ধর্মের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের সাথে এই অঞ্চলের আত্মিক যোগ স্থাপিত হয়। জৈন গ্রন্থ ‘হরিভদ্রীয় বৃত্তি থেকে জানা যায় যে, কলিঙ্গরাজের আমন্ত্রণে মহাবীর স্বয়ং সেদেশে গিয়ে ধর্মমত প্রচার করেন। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক ও খারবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় যথাক্রমে বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম কলিঙ্গ দেশে প্রসার লাভ করে। বর্মার উপকথা অনুযায়ী তপসু ও ভল্লিক নামক দুই স্থানীয় বণিক (উৎকলদেশীয়) সরাসরি গৌতম বুদ্ধের কাছে দীক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। চণ্ডাশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পরেই রূপান্তরিত হয়েছিলেন ধর্মাশোকে। ড. কানুচরণ মিশ্রর মতে, অশোকের এই মানসিক পরিবর্তন কোনো আকস্মিক বা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সমকালীন কলিঙ্গ দেশের উদার ও সহনশীল কিছু পণ্ডিতের সান্নিধ্য ও পরামর্শ সম্রাট অশোকের মনন ও কর্মের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। বিখ্যাত জৈন শাসক খারবেলও তাঁর ধর্মীয় উদারতা ও সহিষ্ণুতার জন্য খ্যাত ছিলেন। গুপ্তযুগে উড়িষ্যা ভূখণ্ডে বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠা পায়। সমকালীন তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, গুপ্তরাজারা বিষ্ণুরূপী শ্রীমাধবের উপাসনা করতেন। আদিত্য সেনের ‘অপসদ্’ স্তম্ভলিপিতে গুপ্তরাজা মাধবগুপ্তকে শ্রীমাধবের উপাসক বলা হয়েছে। মাধবগুপ্ত কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্কের সমসাময়িক ছিলেন। কোঙ্গদ মণ্ডল (উড়িষ্যা)-এর শাসক মাধব বর্মন ছিলেন রাজা শশাঙ্কের অধীনস্থ সামন্ত। সম্ভবত, শিলোদ্ভববংশীয় মাধববর্মনও বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। খ্রিস্টীয় ৪র্থ বা ৫ম শতকের আগে কলিঙ্গতে মথরা (Matharas) বংশের শাসন ছিল। এই বংশীয় শক্তিবর্মনের তাম্রলেখ থেকে জানা যায় যে, তিনি ভগবান নারায়ণ-এর উপাসক ছিলেন। সিংহলী বৃত্তান্ত অনুসারে জনৈক সিংহবাবু কলিঙ্গ থেকে সিংহলে গিয়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে সিংহল ও কলিঙ্গর মধ্যে যোগ স্থাপন হয়। এই সম্পর্কের সূত্রে শবর, পুলিন্দ ইত্যাদি উপজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব সিংহল ও কলিঙ্গের ওপর আরোপিত হয়। তাম্রলেখ থেকে জানা যায়, মথরাবংশীয় রাজারা ছিলেন নারায়ণের উপাসক ও পরমভাগবত। কলিঙ্গের মথরা শাসকগণ সেখানে প্রথম বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন এবং ‘পরমাদ্বৈত’ উপাধি নেন। এই বংশের শাসনকালে মহেন্দ্র পর্বতের ওপর যে মন্দিরটি নির্মিত হয়, সেটিকে “সিদ্ধাই’, ‘সাধক’ ও ‘তপস্বী’-দের সাধনক্ষেত্র বলে সমকালীন তাম্রলেখতে বলা হয়েছে।
খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে মধ্য ও পূর্ব উড়িষ্যায় (তোসালী) ‘মনীনাগেশ্বর’ নামক দেবতার উপাসনা প্রচলিত ছিল। উড়িষ্যার খোন্দ উপজাতির কাছে নাগদেবীর উপাসনা জনপ্রিয় ছিল। হিন্দুরা শেষ নাগ বা অনন্ত নাগের অবতার হিসেবে বলবেদের উপাসনা করতেন। বালেশ্বরে এখনও বলবেদের পূজা প্রচলিত আছে। সম্ভবত, শৈলোদ্ভবদের পতনের পর কোঙ্গদ ও তোমালী ভৌমকারদের শাসনাধীনে এলে পুরুষোত্তম, বলদেব ও দেবী স্তত্তেশ্বরী রাষ্ট্রদেবতা হিসেবে আরাধ্য হন। এই ঘটনাকে পুরুষোত্তম জগন্নাথের ত্রয়ী রূপ—জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার রূপকল্পনার সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায়। পুরুষোত্তম এবং বলভদ্র নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৭ম শতকে ভৌমকারবংশীয় প্রথম শুভকরদেবের তাম্রলেখতে। সম্ভবত, বৌদ্ধ ভৌমকার বংশ নীলমাধব ওরফে পুরুষোত্তমের উপাসক ছিলেন এবং প্রভু পুরুষোত্তমের রথযাত্রা উৎসব অংশ ও বৌদ্ধধর্মাচার পদ্ধতিরই অনুসরণ। হেমচন্দ্র বিরচিত ‘অভিধান চিন্তামনি’ গ্রন্থের ভিত্তিতে বলা যায়, নীলমাধব তথা পুরুষোত্তম বৌদ্ধদের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ ও জৈনদেরও উপাস্য দেবতা ছিলেন। জৈনরা তাঁকে তীর্থঙ্কর রূপেই উপাসনা করতেন।
অর্থাৎ জগন্নাথ বলভদ্র, সুভদ্রা ও সুদর্শন—এই চার দেবদেবীর উপাসনাতত্ত্ব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। উপরোক্ত আলোচনার নিরিখে এই জগন্নাথ উপাসনার বিবর্তনকে নিম্নলিখিত উপবিভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় খ্রিস্টীয় ৩৫০ থেকে ৫০০ শতক। এই সময় মাথরা বংশ কলিঙ্গ শাসন করতেন এবং মহেন্দ্র পর্বতে তাঁদের বংশদেবতা নারায়ণকে প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা করতেন। দ্বিতীয় পর্বের পরিধি ৫০০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রসারিত। এই পর্বে আদি গঙ্গা বংশ ও শৈলোদ্ভবদের অধীনে যৌগিক দেবতা পুরুষোত্তম-জগন্নাথের ধারণা বিকাশ লাভ করে। তৃতীয় পর্বে অর্থাৎ অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে এগারো শতকের মধ্যভাগে ভৌম ও সোমবংশীয় শাসকদের অধীনে উড়িষ্যায় সমন্বয়ী ধর্মভাবনা জনপ্রিয়তা পায়। অবশেষে এগারো শতকের পরবর্তীকালে পরবর্তী গঙ্গা ও সূর্যবংশীয়দের আমলে জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা ও সুদর্শনের উপাসনা প্রসার লাভ করে (The theology of Jagannath as found today, developed actually during the Ganga and Suryavamsi periods)। ড. কে. সি. মিশ্রের মতে, এই পর্বে বৌদ্ধ মহাযানবাদের সাথে ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিকধর্মের মিশ্রণ ঘটে এবং এর সাথে শৈব ও বৈষ্ণব ধ্যানধারণা যুক্ত হয়ে জগন্নাথ উপাসনার উদ্ভব ঘটে। তিনি লিখেছেন, “The cult which is not derived from any particular religious system, is a combination of many religious thoughts and ideas current in this and the adjoining regions.”
মাদলাপঞ্জি’র বিবরণ থেকে অনুমিত হয় যে, সোমবংশীয় রাজা যযাতি কেশরী উত্তর ভারত থেকে ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রিত করে এনে রাজধানী জাজপুরে যাগযজ্ঞ পরিচালনা করেন ও বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ মন্দির নির্মাণ করেন। সম্ভবত, তাঁর আমলেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু হয়। তবে তিনি তা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। গঙ্গাবংশীয় রাজা চোড়গঙ্গ মন্দিরের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ করেন।
আধুনিক জগন্নাথ ধর্মতত্ত্ব মূলত গঙ্গা ও সূর্যবংশের আমলে বিকাশ লাভ করে। বৌদ্ধ মহাযানবাদের সাথে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমন্বয় এবং শৈব ও বৈষ্ণববাদের দর্শনতত্ত্বের মিলনে জগন্নাথ উপাসনার নতুন ধর্মতত্ত্ব গড়ে ওঠে। ড. কানুচরণ মিশ্র লিখেছেন : “It was doing this period (Ganga and Suryavamsi periods) that some Mahayanist elements mixed with tantricism were combined with the Shivite and vaisnavite ideologies and gave rise to a new theological conception of the Jagannath cult.” জগন্নাথ উপাসনায় ‘তন্ত্রযোগ’ পদ্ধতি নাথ ধর্ম থেকে গৃহীত হয়েছে। ‘হরি হর’ সম্পর্কিত ধারণা উড়িষ্যার প্রচলিত প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে এসেছে। জগন্নাথ ও বলভদ্র ‘হরি-হর’ ধারণার প্রতীক এবং সুভদ্রা হলেন শাস্ত তথা তান্ত্রিকবাদের প্রতীক। বলভদ্র মাঝে মাঝে নাগতন্ত্রের প্রতীক বলে বিবেচিত হন। তবে আসলে তিনি বৈষ্ণব মতবাদের হলধরের প্রতিভূ বলেই বিবেচিত হন।
উড়িষ্যার মহাকবি সরলা দাস ও ‘পঞ্চসখা তত্ত্ব’ জগন্নাথ উপাসনার ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করেন। শ্রীচৈতন্যের পাঁচজন শিষ্য বলরাম, জগন্নাথ, যশোবন্ত, অনন্ত ও অচ্যুত ত্যাগ ও যোগতত্ত্ব প্রচার করেন। জগন্নাথ উপাসনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পশ্চাতে এঁদের অবদান স্মরণ করে ড. কানুচরণ মিশ্র লিখেছেনঃ “These five poet sages are not only regarded as the five elements constituting Jagannatha but also are considered as the very essence of the Lord, a living god enshrined in the hearts of the children of the soil.” Bengal past and present’ 22 বলা হয়েছে যে, মানুষের হৃদয়ে ও মননে জগন্নাথতত্ত্বের প্রভাব এতটাই গভীর যে, কেবল সমগ্র উড়িষ্যাকে উদ্বেলিত করেনি, মুসলিম শাসনাধীনে ভারতে হিন্দুদেরও অনুপ্রাণিত হতে সাহায্য করেছিল।’ ‘পঞ্চসখা সম্প্রদায়’ জগন্নাথ উপাসনার সাথে শূন্যবাদের ধারণাকে গভীরভাবে যুক্ত করেন। বৌদ্ধ-বজ্রযান ধর্মের এই শূন্যবাদ বৈষ্ণববাদের মধ্যে আরোপিত হয় এবং বৈদান্তিক দর্শনের ‘নির্গুণ ব্রহ্ম’র ধারণার সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বলরাম দাস তাঁর সারস্বত গীতা’ গ্রন্থে শূন্য’ও ব্রহ্ম কে একই ধারণার প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন। অচ্যুতানন্দ দাস ‘শূন্য সংহিতা’ গ্রন্থে বলেছেন যে, শূন্য হল সৃষ্টির কারণ, শূন্য পুরুষ হলেন আদি, নির্গুণ ও নিরাকার। জগন্নাথ সেই আদি পুরুষ। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মতে, জগন্নাথ হলেন শূন্য পুরুষ। সুভদ্রা হলেন ‘যোগমায়া’ (Union of space) এবং বলভদ্র হলেন ‘কালরূপ’ (Time)। ড. রাধাকৃষ্ণের ব্যাখ্যানুযায়ী, পুরীধামে বৌদ্ধধর্মের রূপান্তর ঘটে বৈষ্ণবধর্মে এবং গৌতম বুদ্ধকে উৎসর্গীকৃত মন্দিরের কৃষ্ণরূপী জগন্নাথের অধিষ্ঠান ঘটে। উপনিষদ ও পুরাণ-কথিত গুরুবাদ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। এই গুরুবাদ জগন্নাথ উপাসনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জগন্নাথ হলেন ব্যক্তি ও সমগ্র জগতের ‘পরমগুরু’ ও ‘স্রষ্টা’। বৈষ্ণব ধর্ম বিশ্বাসের মত ‘ধর্মপূজা বিধান’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে যে, নবম অবতারে ঈশ্বর (হরি) জগন্নাথ নাম নিয়ে ধরায় অবতীর্ণ হন এবং সমুদ্রতীরে নিজ আবাস প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই তিনি জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলকে ‘প্রসাদ’ বিতরণ করে মুক্ত করেন (“In the Ninth incarnation god was born as Jagannath, who was none but Lord Buddha, and he settled his residence on the sea coast, where he was relieved the whole world by distributing to all his prasada.”)। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রবেশপথে তাই নবম অবতার রূপে জগন্নাথকে বুদ্ধদেবের প্রতিনিধি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে জগন্নাথকে উড়িষ্যার হিন্দু-মুসলমান সকলেরই সমন্বয়কারী ও ত্রাতা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
জগন্নাথ মন্দিরের বিগ্রহগুলির অবয়ব অসম্পূর্ণ। এ প্রসঙ্গে একাধিক অলৌকিক লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, আদি উপজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব এবং শিল্পকলার অজ্ঞতা জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রের এরূপ অসম্পূর্ণ রূপকল্পের মূল কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হল, পরবর্তীকালে সভ্যতা-সংস্কৃতির রূপান্তরের পরেও পুরীর মন্দিরে সপার্ষদ জগন্নাথদেবের অবয়বের অসম্পূর্ণ রূপ কেন পরিবর্তন করা হল না। কেউ কেউ মনে করেন, কালাপাহাড়ের আক্রমণের ফলে প্রভুর মূর্তির এই অসম্পূর্ণ দেহরূপ ঘটেছে। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন জাগে যে, পরবর্তীকালে রাজপরিবার কেন নবরূপে তাঁদের প্রতিষ্ঠা করেননি। এ প্রসঙ্গে একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা অনেককে আকৃষ্ট করে। এই মতে, সপার্ষদ জগন্নাথের এই দেহরূপ প্রতীকী মাত্র। যিনি পরম ব্রহ্ম, যাঁর আকার নেই তাঁকে কীভাবে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই অসম্পূর্ণ রূপ পরম প্রভুর রূপ যে ব্যাখ্যার অতীত, বর্ণনার অতীত এবং চিন্তার অতীত, তাই প্রকাশ করে। এই অবয়ব অসীমকে অসীম রূপেই উপস্থাপিত করেছে। এঁদের সাথেই আছেন রূপহীন রূপধারী সুদর্শন। একাধারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অস্ত্র এবং অন্যধারে পরিবর্তনশীল জগতের প্রতীক হিসেবে সুদর্শনের কল্পনা। তিনটি মূর্তির স্বতন্ত্রগাত্র বর্ণ ও ব্যঞ্জনাময়। প্রকৃতি বা শক্তির প্রতীক সুভদ্রা পীতবর্ণা। অর্থাৎ তিনি ইহজাগতিক সকল জীব ও তাদের গতিপ্রকৃতির উৎস। সৃষ্টি ও কাল পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে ইহজাগতিক জীব ও বস্তুর বর্ণ পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আদিতে তা সবই পীতবর্ণ থাকে। বলভদ্র হলেন বিশুদ্ধতা বা বিশুদ্ধ অনির্ণীত আত্মার (Pure indeterminate spirit) প্রতীক। তাই তাঁর বর্ণ শ্বেতশুভ্র, যা একই সাথে সকল দৃশ্যমান বর্ণের সমন্বয় ও অস্বীকৃতি। মহাপ্রভু জগন্নাথ কৃষ্ণবর্ণ। এই বর্ণ সকল বর্ণের অস্বীকৃতি বা বর্ণহীনতার প্রতীক। জগন্নাথকে কেন্দ্র করে যে রহস্যময়তার আবরণ আছে, এই বর্ণ তারই প্রকাশ।
ভারতীয় সংস্কৃতির ধারায় জগন্নাথ উপাসনার গুরুত্ব অসীম। জগন্নাথ কোনো বিশেষ অঞ্চল বা জাতির দেবতা নয়। শাক্ত, শৈব, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও উপজাতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে জগন্নাথ প্রকৃত অর্থেই মানুষের দেবতায় পরিণত হয়েছে। ভারতের নানা ভাষায় তাঁর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। এতে সমৃদ্ধ হয়েছে আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য। বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব — এই দুটি সংস্কারবাদী ধর্মদর্শনের সমন্বয়ে জগন্নাথ উপাসনা উড়িষ্যা তথা ভারতের অন্যতম সংস্কারকামী আন্দোলনের পথপ্রদর্শকে পরিণত হয়েছে।
Leave a comment