আদিম সাম্যবাদী সমাজের প্রকৃতি:

মানবসমাজের প্রায় আবির্ভাব থেকেই শুরু করে পরস্পর-বিরোধী শ্রেণীর উদ্ভব পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরকে আদিম সমাজব্যবস্থা বলা হয়। দীর্ঘকালব্যাপী বিস্তৃত এই সামাজিক স্তরকে প্রচলিত উৎপাদিকা শক্তি, উৎপাদন সম্পর্ক ও সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আদিম সাম্যবাদী সমাজ বলা হয়। আদিম মানুষের পক্ষে একক প্রচেষ্টায় বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব। জীবনের নিরাপত্তা এবং খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের স্বার্থে আদিম মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করত। গোষ্ঠীভুক্ত সকলেই প্রকৃতি থেকে শ্রমের দ্বারা ফলমূল, মাছ, মাংস প্রভৃতি সংগ্রহ করে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করত। সামর্থ্য অনুসারে যে যার কাজ করত। দৈহিক শক্তিই ছিল মানুষের জীবনধারণের একমাত্র ভিত্তি। পুরুষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যে স্বাভাবিক শ্রমবিভাগ ছিল। বলা হয় যে এই সময় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। মায়ের রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে গোষ্ঠীপ্রথা গড়ে উঠেছে। মার্কস বলেছেন: “In order to gather the fruits of the forest, to catch fish, to build some sort of habitation, men were obliged to work in common, if they did not want to die of starvation, or fall victim to beasts of prey, or to neighbouring societies.” যৌথ শ্রমের মাধ্যমে যা কিছু সংগৃহীত হত তা সকলে সমানভাবে ভোগ করত।

সাম্যভিত্তিক সমাজ:

শ্রমশক্তিই ছিল আদিম সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের প্রধান উপাদান। তা ছাড়া পাথর, কাঠ বা হাড়ের তৈরি কিছু অত্যন্ত সাধারণ ও স্থূল ধরনের হাতিয়ার মানুষের হাতে ছিল। উৎপাদনের উপাদান এবং উৎপাদিত সামগ্রী প্রভৃতি সব কিছুর উপর ছিল গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানা। এই হল আদিম সমাজব্যবস্থার উৎপাদন সম্পর্কের মূল ভিত্তি। এই সময় সমবেতভাবে শ্রম করার জন্য সকলেই ছিল উৎপাদনের উপাদান ও উৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রীর মালিক। উৎপাদন সম্পর্কও ছিল সাম্যভিত্তিক। সমাজবিকাশের এই স্তরে একদিকে সমবেত শ্রম এবং অপরদিকে উৎপাদনের সকল উপাদান ও সম্পদ-সামগ্রীতে সামাজিক মালিকানা ছিল স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা তখনও সৃষ্টি হয়নি। অধ্যাপিকা ড. বেলা দত্তগুপ্ত তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে এ বিষয়ে বলেছেন: “আদিম সমাজের বৈশিষ্ট্য হল, মার্কস-এর মতে, সাম্য অর্থাৎ মানুষে-মানুষে সাম্য। এ সমাজে কোন ভেদাভেদ নেই পুরুষ ও নারী ছাড়া। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে বর্তমান ‘সভ্য’ সমাজের মত, পুরুষ ও নারীতে কোন অসাম্য নেই। উভয়ের কাছে উভয়েই সমান। একে অন্যকে পীড়ন করে না, শোষণ করে না। শিকার, নদী, হ্রদে মাছ ধরা, পশুপালন ইত্যাদির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ হয় এই সমাজে। খুব নিম্নমানের তবে ঐ সমাজের উপযোগী যন্ত্রপাতি (কাঠ ও পাথরের তৈরী) তারা ব্যবহার করত।” তিনি আরও বলেছেন: “ উপাদানের এই হাতিয়ারগুলি তৈরী বা জোগাড় করার জন্য বিশেষ কোন দক্ষতার প্রয়োজন হত না। প্রয়োজন হত সমবেত প্রচেষ্টা ও পেশীশক্তির। ফলে, যুথবদ্ধ হয়ে শিকার অন্বেষণ আদিম সমাজের একান্ত বৈশিষ্ট্য ছিল।”

আঞ্চলিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ অপর্যাপ্ত পাওয়া যেত না। স্বভাবতই জীবিকা নির্বাহর জন্য খাদ্যের সন্ধানে আদিম সমাজের মানুষকে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে হত। অর্থাৎ জীবনযাত্রা ছিল যাযাবরী।

শ্রেণীভেদ, শ্রেণীশোষণ রাষ্ট্র ছিল না:

অনুন্নত উৎপাদন শক্তির জন্য আদিম উৎপাদন ধারায় কেবল জীবনধারণের জন্য আবশ্যক খাদ্য সংগ্রহ করতেই মানুষকে প্রাণান্ত শ্রম করতে হত। সুতরাং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের প্রশ্ন এই অবস্থায় অবান্তর। তাই সমাজ বিকাশের এই পর্বে শ্রেণীভেদ বা শ্রেণী-শোষণ ছিল না এবং শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও ছিল না। আদিম সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। তাই মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণও ছিল না। শোষণ না থাকার জন্য শোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্র-যন্ত্র গড়ে তোলার দরকার হয়নি। অধ্যাপিকা ড. বেলা দত্তগুপ্ত তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে মন্তব্য করেছেন: “এই সমাজে কোন ক্রমেই একে অন্যকে শোষণ করার প্রশ্ন জাগে নি। কোন দমনমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ ‘রাষ্ট্র’-এর মত সংগঠন গড়ে ওঠেনি।” মানুষ যতদিন শুধু প্রয়োজন মেটানোর জন্য যতটা দরকার ততটা উৎপাদন করেছে ততদিন উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ের প্রশ্ন আসেনি। উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং সঞ্চয় শুরু হওয়ার পর সমাজে আর্থনীতিক অসাম্য, শ্রেণী-ভেদাভেদ এবং শ্রেণী-শোষণের সূত্রপাত ঘটে।

এই আদিম সমাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই সময় গোষ্ঠীপ্রধান ও নারীর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা বর্তমান ছিল। এরই ভিত্তিতে সমাজের অনুশাসন বজায় থাকত। আদিম সমাজের যাযাবর মানুষদের মধ্যে পরিবারই ছিল প্রাথমিক সংগঠন। অর্থাৎ সমাজ ছিল পরিবার ভিত্তিক। এই সমাজে ‘পিতা’ বা পুরুষের থেকে ‘মাতা’ বা নারীর কর্তৃত্ব ছিল অধিক। পুরুষেরা শিকার বা সমজাতীয় জীবিকার্জনের কাজে অধিকাংশ সময় নিযুক্ত থাকত। নারীরাই সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করত। অধ্যাপিকা দত্তগুপ্ত মন্তব্য করেছেন: “এই আদিম সমাজ কতদিন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার সঠিক পরিমাপ সম্ভব নয়। কিন্তু এই আদিম সমাজের বুকেই জন্ম নিয়েছিল আগামী দিনের ‘মানব সমাজ’—এর সবকটি রূপরেখা, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি, ভাষা।”

আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

আদিম সমাজব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।

  • (1) আদিম সমাজে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করত। জীবনের নিরাপত্তা ও খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে যৌথ জীবন ছিল অপরিহার্য।

  • (২) শ্রমশক্তিই ছিল উৎপাদনের মূল উপাদান। তাছাড়া পাথর বা কাঠের তৈরি অতি স্থূল ধরনের কিছু হাতিয়ার ছিল।

  • (৩) উৎপাদনের সকল উপাদানের উপর গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানা ছিল। আদিম সমাজে যৌথ শ্রমের দ্বারা মানুষ তাদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করত। এই কারণে যৌথভাবে তারা উৎপাদন-উপাদানের মালিক ছিল। সকলেই উৎপাদন-উপাদানের সমান অংশীদার ছিল। 

  • (৪) উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সকলে সমানভাবে ভোগ করত।

  • (৫) এই অবস্থায় সুস্পষ্ট কোন শ্রমবিভাগ ছিল না। 

  • (৬) উৎপাদন ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল বলে শুধু জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদিত হত। তাই উদ্বৃত্ত উৎপাদন বা সঞ্চয় ছিল না।

  • (৭) সেজন্য সমাজ বিকাশের এই পর্বে আর্থনীতিক অসাম্য, শ্রেণীভেদ বা শ্রেণী-শোষণ ছিল না। স্বাভাবিক কারণে শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রও ছিল না। বস্তুত আদিম সমাজব্যবস্থায় কোন প্রকার অসাম্য ছিল না। এ কারণে একে আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা বলা হয়।