আদিম সমাজের অবসান:

মানবসমাজের প্রগতির ধারায় দাস-ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার অস্তিত্ব দীর্ঘকাল অব্যাহত থাকেনি। এক সময় আদিম সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটে। কালক্রমে নতুন উৎপাদন শক্তির উদ্ভব হয়। তারফলে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে আদিম সাম্যবাদী সমাজ অবলুপ্ত হয়। দাস-সমাজব্যবস্থার আবির্ভাবের বীজ আদিম সাম্যবাদী সমাজের অবসানের মধ্যেই বর্তমান ছিল। অধ্যাপিকা ড. বেলা দত্তগুপ্ত তাঁর ‘সমাজবিজ্ঞান’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্বানুযায়ী ‘আদিম সমাজ’-এর পরবর্তী স্তর / অধ্যায় হল ‘দাস সমাজ’। ‘আদিম সমাজ’-এর মধ্যেই উৎপাদন ব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তনের ফলে ঘটল এক ‘সাংস্কৃতিক রূপান্তর’। এ রূপান্তর প্রাথমিক পর্যায়ের হলেও, এর মূল্য কিন্তু অমেয়।

নতুন উৎপাদন শক্তির আবির্ভাব:

আদিম সমাজব্যবস্থার অনুন্নত উৎপাদন ধারাকে অতিক্রম করে মানুষ পশুপালন ও কৃষিকার্য সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করেছে। পাথরের হাতিয়ারের পরিবর্তে ধাতুনির্মিত হাতিয়ারের ব্যবহার রপ্ত করেছে। এই ধাতুর ব্যবহার আদিম সমাজের অধিবাসীদের জীবনধারায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করে। ধাতু দিয়ে মানুষ উৎপাদনের উন্নত সরঞ্জাম এবং আত্মরক্ষার নতুন হাতিয়ার তৈরি করল। কাঠ-পাথরের তৈরি সরঞ্জাম ও হাতিয়ারের দিন চলে গেল। নতুন উৎপাদন শক্তির আবির্ভাব ঘটল। এবং তারফলে যুগান্তকারী সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হল। বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে খাদ্যসংগ্রাহক ও শিকারী মানুষ পশুপালন শিখল। তখন সাধারণ বর্বর মানবগোষ্ঠী থেকে পশুপালক উপজাতি আলাদা হয়ে গেল। মার্কসের মতানুসারে এটাই হল প্রথম উল্লেখযোগ্য সামাজিক শ্রমবিভাগ।

উৎপাদন ব্যবস্থার প্রসার

দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থার সূত্রপাত: আবার কালক্রমে কিছু মানুষ গার্হস্থ্য বা হস্তশিল্পের কলাকৌশল আয়ত্ত করেছে। এইভাবে উৎপাদনের একাধিক উৎস এবং উন্নত উৎপাদন শক্তির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে লাগল। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সৃষ্টি হল। ক্রমে কৃষিযুগের সূত্রপাত ঘটে। প্রথমে পশু-খাদ্যের জন্য শস্য চাষ শুরু হয়। তারপর কৃষি মানুষের খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য করা হয়। কালক্রমে মানুষ তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার শেখে। তারফলে হাতিয়ার, অলংকার ও অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর উৎপাদন শুরু হয়। এইভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা প্রসারিত হতে থাকে। তারফলে বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশার সৃষ্টি হয়। এবং এইভাবে সমাজে শ্রমবিভাজনের সূত্রপাত হয়। আবার এই সময়েই সমাজে দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। অধ্যাপিকা দত্তগুপ্ত এ বিষয়ে বলেছেন: “….. ধাতুর ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখলাম জীবনধারণের বিভিন্ন ব্যবস্থা অনেক জটিল হল। নতুন যন্ত্রপাতির প্রবর্তন হল যা কিনা একমাত্র ধাতুর ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব। ধাতুর ব্যবহার উদ্ভূত নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশাতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটল যা কিনা কোন পরিবার বা গোষ্ঠী একা ব্যবহার করে শেষ করতে পারত না। প্রয়োজন হল বিনিময় (exchange) ব্যবস্থার।” গোড়ার দিকে গোষ্ঠীসমূহের মধ্যেই এই দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর সমগ্র সমাজ জুড়ে এই বিনিময় ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। এই সময় গোষ্ঠীর ভাঙ্গন দেখা দেয় এবং পরিবার ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এই পরিবার অন্যতম স্বাধীন আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতীয়মান হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে যৌথ শ্রম ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি: গোড়া থেকেই পশুপালক সমাজ বা কৃষি-সমাজে অসাম্য বর্তমান। প্রাকৃতিক উৎপাদন থেকে ব্যবহার্য সামগ্রী প্রস্তুত করার কলাকৌশল ও জ্ঞান-বুদ্ধি মানুষ আয়ত্ত করতে লাগল। ফলশ্রুতি হিসাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে লাগল। হাতিয়ার ও সাজ-সরঞ্জামের বিকাশ ও উন্নয়নের ফলে উৎপাদনের পরিমাণ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। স্বভাবতই উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সৃষ্টি হয়। উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হয় এবং দাসপ্রথার পথ প্রশস্ত হয়েছে। এই পর্যায়ে সমাজের সকলকে আর একযোগে কাজ করতে দেখা যায় না। এই অবস্থায় উৎপাদনের উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর উপর যৌথ মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানা দেখা দিল। অধ্যাপিকা বেলা দত্তগুপ্ত এ বিষয়ে বলেছেন: “…..গোষ্ঠীর হাত থেকে উৎপাদন ক্রমে ক্রমে চলে যেতে থাকল ব্যক্তির হাতে। অর্থাৎ সূত্রপাত হল ব্যক্তি মালিকানার। ব্যক্তি মালিকানা চালু হবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যক্তির লোভ বেড়ে গেল অনেকগুণ। সে এখন অন্যের শ্রম ব্যবহার করে তার ফল নিজেই আত্মসাৎ করতে মনোযোগী হয়ে উঠল।”

নতুন উৎপাদন-সম্পর্ক: আদিম সাম্যবাদী সমাজে উৎপাদন শক্তির পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটে। উৎপাদন শক্তির উন্নতি সাধিত হয়। এই বিকশিত ও উন্নত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যহীন প্রতিপন্ন হয়। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর সমাজের সকলের সমানাধিকার বিলুপ্ত হয়। সমাজে বিত্তবান ও বিত্তহীন বা শোষক ও শোষিত এই দু’টি শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। সমাজে একদল মানুষের দ্বারা আর একদল মানুষের শোষণ শুরু হয়। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্যের অবসান ঘটে এবং অসাম্য প্রকট হয়ে উঠে। এই রকম এক অবস্থায় এক নতুন উৎপাদন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। শোষণ-অসাম্যের ভিত্তিতেই এই উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে উঠে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে অসাম্য এবং শোষণের উৎপত্তি হয়। সমাজের সম্পত্তিবান ব্যক্তিবর্গ শোষণের সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক আধিপত্য কায়েম করার জন্য বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই বিত্তবান শ্রেণী তাদের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ ও আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এই শ্রেণী তাদের শোষণের সুবিধা সংরক্ষণের স্বার্থে শোষণের এক বিশেষ হাতিয়ার সৃষ্টি করে। এবং শোষণ কায়েম করার এই হাতিয়ারই হল রাষ্ট্র।

দাস ব্যবস্থার উদ্ভবের মূল কারণ:

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমাজের সকল গোষ্ঠী বা উপজাতি উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমানভাবে উন্নতি লাভ করতে পারেনি। ফলে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত গোষ্ঠী উন্নত গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিনিময় প্রথার ভিত্তিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সংগ্রহে প্রবৃত্ত হল। যাইহোক্, এই পর্বে শ্রমবিভাগ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে বিনিময় ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে সম্পদ-সামগ্রী সঞ্চিত হয়েছে। অনেকের মতে এই আর্থনীতিক অসাম্য ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি দাস-ব্যবস্থা সৃষ্টির মূলীভূত কারণ। এই সময় উৎপাদন শক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও বিকাশ ঘটে। তার ফলে আদিম সাম্যবাদী সমাজের উৎপাদন-সম্পর্কের সঙ্গে তার অসংগতি দেখা দেয়। এই অবস্থায় আর্থনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন নতুন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি করল।

শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীশোষণের সূত্রপাত:

এই পর্যায়ে যুদ্ধবন্দীদের হত্যার পরিবর্তে উৎপাদনকার্যে নিয়োগ শুরু হল। এইভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির স্বার্থে অতিরিক্ত শ্রমশক্তির প্রয়োজন মিটল এবং ক্রীতদাস প্রথার সূচনা হল। সেই সময় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ছিল নিত্যকার ঘটনা। এই সংঘর্ষে যারা পরাজিত হত তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করা হত। তাছাড়া অনুন্নত জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত মানুষকেও ক্রীতদাস হিসাবে গণ্য করা হত। প্রাচীনকালের গ্রীস ও রোমে এই ধরনের ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। সমাজের অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দরিদ্র ব্যক্তিদের শোষণ করতে আরম্ভ করল। কালক্রমে দেখা গেল যে এই দরিদ্র ও দুর্বল ব্যক্তিগণ সম্পদশালী ব্যক্তিদের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করছে এবং তাদের পরিশ্রমের ফসল, উদ্বৃত্ত সম্পদসামগ্রী পরশ্রমভোগী বিত্তবানরা অর্জন ও সঞ্চয় করছে। এখানে সমাজ পরিষ্কার দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে—দাস-মালিক ও দাস, শোষক ও শোষিত। দাস-সমাজব্যবস্থায় সামাজিক জীবনের ভিত্তি হল শোষণ। লেনিনের কথায়, “প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীবিভাগ হল—দাসমালিক ও দাস। উৎপাদনের উপায় জমি এবং হাতিয়ার, তখনকার দিনে যতই আদিম হউক না কেন—প্রথমোক্ত দল যে শুধু সেই সমস্তরই মালিক ছিল তাই নয়, তারা মানুষেরও মালিক ছিল। এই দলকে বলা হত দাসমালিক, আর যারা পরিশ্রম করত ও অন্যদের শ্রম সরবরাহ করত তাদের বলা হত দাস।”

দাসদের দুরবস্থা:

গোড়ার দিকে দাসরা উৎপাদনব্যবস্থায় সাহায্যকারীর ভূমিকাই পালন করত। পরবর্তী কালে তারা মনিবের অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে যখন টাকাকড়ির সৃষ্টি হয়নি, তখন অনেকক্ষেত্রে দাসদের পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত। দাস-ব্যবস্থার সঙ্গে সামন্তব্যবস্থার গভীর যোগাযোগ ছিল। কারণ সামন্ত-প্রভুরাই ছিল দাস-ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। দাসদের ব্যক্তিগত বলে কিছুই ছিল না। অমানুষিক পরিশ্রমেই ছিল তাদের অধিকার। এই অধিকারের কোন সীমা ছিল না। দাসদের মর্মন্তুদ অত্যাচারের কাহিনী ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। লেনিন (Lenin) বলেছে: “In slave-owning society the slave enjoys no rights whatever and is not regarded as human being….”

শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব:

এই দাস-সমাজব্যবস্থায় দাস-মালিকের স্বার্থে শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। অধ্যাপিকা দত্তগুপ্ত এ বিষয়ে বলেছেন: “ এ সমাজ ব্যবস্থা সাম্যের উপর নির্ভর নয়; নির্ভর শ্রেণী সম্পর্কের উপর (প্রভু ও দাস—দুটি শ্রেণী) এবং এই ‘দাস সমাজ’ থেকেই জন্ম হয় পরবর্তী কালের ‘রাষ্ট্র’ নামক প্রতিষ্ঠানের।” দাস-মালিকদের অধীন উৎপাদনের উপকরণ এবং শোষণমূলক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে উপরি-কাঠামোতেও স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন এল। দাস-সমাজব্যবস্থায় দাস-মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং সমাজ-শাসনের স্বার্থে নতুন একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হল। উদ্ভব হল রাষ্ট্রব্যবস্থার এবং রাষ্ট্রক্ষমতার হাতিয়ারসমূহের। দাস-সমাজে দাস মালিকদের স্বার্থেই আইন-কানুন, রীতি-নীতি প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়। দাস-সমাজব্যবস্থার উৎপাদন-সম্পর্ক সংরক্ষণ করাই ছিল এই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। তবে অসহ্য অত্যাচার থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে দাসদের বিদ্রোহের নজিরও ইতিহাসে বিরল নয়। এই প্রসঙ্গে প্রাচীন রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস-বিদ্রোহের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপিকা দত্তগুপ্ত মন্তব্য করেছেন: “প্রাচীন গ্রীস ও রোমে ‘দাস সমাজ’ থেকেই উদ্ভব হয় প্রাচীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের নগর সভ্যতা গড়ে ওঠে সেখানকার ‘দাস সমাজ’-এর উপর। ‘দাস’দের কোন আর্থ-সামাজিক অধিকার ছিল না। ফলে, দাসদের মধ্যে বিক্ষোভ, বিদ্রোহের কথাও জানা যায়। রোম সাম্রাজ্যে স্পার্টাকাস (Spartakas)-এর নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহ অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।”

পিতৃতান্ত্রিক পরিবার: দাস-সমাজব্যবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের এই পর্বে পরিবার ব্যবস্থার উপর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং সমাজে শ্রেণীবিন্যাসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পশু পালন এবং কৃষিকার্যের জন্য মায়ের ভূমিকার জায়গায় পিতার ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য দেখা দিল। আদিম সাম্যবাদী সমাজে নারীর সমান মর্যাদা ছিল। পরিবারের মধ্যে নারী ও পুরুষের মধ্যে এই শ্রমবিভাগের ফলে তা আর থাকল না। এঙ্গেলসের মতানুসারে …স্ত্রীলোক হল পদানত, শৃঙ্খলিত। নারী হল পুরুষের লালসার দাসী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র।’ এইভাবে আদিম সাম্যবাদী সমাজের মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের জায়গায় দাস-সমাজব্যবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সৃষ্টি হল।

দাসসমাজের বৈশিষ্ট্য

দাস ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। 

  • (১) উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার, উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি, উদ্বৃত্ত উৎপাদন, সঞ্চয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর্থনীতিক অসাম্য, শোষণ প্রভৃতিকে অনুসরণ করেছে দাসব্যবস্থা। 

  • (২) দাস সমাজে দাস সমেত সকল উৎপাদন উপাদান এবং উৎপন্ন সামগ্রীর মালিক হল দাস-প্রভুরা।

  • (৩) সমাজবিকাশের এই স্তরে সামাজিক শ্রমবিভাগ, উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও বিনিময় প্রথার সৃষ্টি হয়। 

  • (৪) দাস-সমাজ দাস মালিক ও দাস বা শোষক ও শোষিত এই দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। 

  • (৫) দাস-সমাজেই শ্রেণী-শাসন ও শ্রেণী-শোষণের সূত্রপাত ঘটে। এই স্তর থেকেই শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস শুরু হয়।

  • (৬) দাস-সমাজব্যবস্থাতেই শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।

  • (৭) এই রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হল দাস-সমাজের উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখা।

  • (৮) এই পর্যায়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে মর্যাদার পার্থক্য শুরু হয়। এই সময় থেকেই নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব দেখা যায়।