আদিম, যুগে শিক্ষা বলতে বােঝাত সেইসব দক্ষতাকে যা মানুষকে জীবনধারণের প্রয়ােজনীয় উপাদানগুলি প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে সাহায্য করত। তখন শিক্ষার অর্থ ছিল, বেঁচে থাকার জন্য কৌশল আয়ত্ত করা। আর সেই শিক্ষা মানুষ লাভ করত প্রধানত পূর্বপুরুষের আচার-আচরণ অনুকরণ করে। যেমন বাসস্থান নির্মাণ, পোশাক তৈরি এবং খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদি। এইসব কৌশল আদিম যুগে শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত হত।

প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন গ্রন্থ ও বছু বিশিষ্ট চিন্তাবিদের মতানুসারে শিক্ষার একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন

  • ঋগবেদ : শিক্ষা হল এমন এক প্রক্রিয়া যা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মত্যাগী হতে উদ্বুদ্ধ করে।

  • উপনিষদ : শিক্ষা হল এমন কিছু যার অন্তিম পরিণতি মােক্ষলাভ (সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে)।

  • যাজ্বন্ধ্য : শিক্ষা হল তাই যা মানুষকে সৎ চরিত্রের অধিকারী করে এবং বিশ্বের কাছে গ্রহণ যােগ্য বা প্রয়ােজনীয় করে তােলে।

  • কৌটিল্য : শিক্ষার অর্থ দেশমাতৃকার জন্য প্রশিক্ষণ এবং জাতির প্রতি প্রীতি।

  • শংকরাচার্য : আত্ম-উপলব্ধির উপায় হল শিক্ষা।

  • কণাদ : শিক্ষা হল আত্মতৃপ্তির বিকাশসাধন

প্রাচীনকালে পাশ্চাত্যের বহুবিশিষ্ট চিন্তাবিদ নিজ নিজ আদর্শ ও ভাবধারার প্রেক্ষিতে শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন

  • প্লেটো : শিক্ষা হল এমন একটি ধারণাশক্তি যা সঠিক মুহূর্তে আনন্দ ও বেদনা অনুভবে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীর দেহ ও মনের সৌন্দর্য ও অন্তর্নিহিত পূর্ণতাকে বিকশিত করে।
  • অ্যারিস্টটল : সুস্থ দেহে সুস্থ মনের সৃষ্টিই হল শিক্ষা। এটি মানুষের মধ্যে এমন এক সত্তার আবির্ভাব ঘটায় যার দ্বারা মানুষ শাশ্বত সত্য, মহত্ব এবং সুন্দরের আরাধনায় নিজেকে নিয়ােজিত করতে সমর্থ হয়।
  • কমেনিয়াস : শিক্ষা হল এমন কিছু যা সাধারণ মানুষদের প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
  • মন্টেগু : শিক্ষা হল মানুষের বিভিন্নপ্রকার মানসিক শক্তির বিকাশসাধন ও উপযুক্ত অনুশীলন।

আধুনিক ভারতের বহুবিশিষ্ট চিন্তাবিদ তাঁদের নিজস্ব আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন—

  • স্বামী বিবেকানন্দ : শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ। সমস্ত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের শেষ কথা হল মানুষ তৈরি।
  • স্বামী দয়ানন্দ : শিক্ষা হল চরিত্রগঠন এবং ধার্মিক জীবনযাপনের উপায়।
  • মহাত্মা গান্ধি : শিক্ষা মানুষের দেহ, মন এবং আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায়।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য পরিবেশন করে না, বরং বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের মাধ্যমে মানবজীবনকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে গড়ে তােলে।
  • ঋষি অরবিন্দ : শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষকে দিব্য-জীবনের জন্য প্রস্তুত করা।
  • হুমায়ুন কবীর : শিক্ষা হল একটি গতিশীল প্রক্রিয়া যা সামগ্রিকভাবে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে এবং উন্নততর অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনে।
  • ড. জাকির হােসেন : শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনাে ব্যক্তির মনের সম্পূর্ণ বিকাশে সহায়ক হয়।

আধুনিককালে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন চিন্তাবিদ তাঁদের নিজস্ব আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন

  • রুশো : শিক্ষা হল শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ, যা মানবসমাজের সমস্ত কৃত্রিমতাবর্জিত একটি স্বাভাবিক মানুষ তৈরিতে সহায়ক হয়।
  • পেস্তালৎসি : শিক্ষা হল মানুষের সহজাত ক্ষমতাগুলির স্বাভাবিক, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ক্লমােন্নয়নমূলক বিকাশ।
  • ফ্রয়েবেল : শিক্ষা হল সেই বিকাশপ্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি প্রকৃতির রাজ্যে নিজের বিস্তৃতি ঘটায় ও মানবসমাজের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে।
  • জন ডিউই : শিক্ষা ব্যক্তির সেইসব গুণের বিকাশ ঘটায় যার দ্বারা সে তার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়।
  • রেমন্ট : শিক্ষা হল মানুষের শৈশবকাল থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনবিকাশের এক প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় সে ক্রমশ তার প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং আত্মিক পরিবেশের সঙ্গে সংগতিবিধানে সমর্থ হয়ে ওঠে৷
  • নান : শিক্ষা হল ব্যক্তির নিজস্বতার পূর্ণ বিকাশ, যার সাহায্যে ব্যক্তি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতানুযায়ী মানবজীবনে মৌলিক অবদান রাখতে পারে।
  • থম্পসন : শিক্ষা হল এমনই এক পরিবেশগত প্রভাব যা কোনাে ব্যক্তিকে তার অভ্যাস, আচরণ, চিন্তা এবং মনােভাবের স্থায়ী পরিবর্তনে সহায়তা করে।
  • স্যার জন অ্যাডামস : শিক্ষা হল একটি সচেতন ও ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া যার দ্বারা একজন ব্যক্তি যােগাযােগ এবং জ্ঞান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অপর ব্যক্তির বিকাশে সাহায্য করে।