সাধারণভাবে মনে করা হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনে যে সংস্কার, নিয়ম ও নীতিবােধগুলি জড়িয়ে থাকে তা হল সংস্কৃতি। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ই.বি. টাইলর তঁার ‘প্রিমিটিভ কালচার গ্রন্থে লিখেছেন—“সংস্কৃতি হল এমন এক জটিল বিষয় যার মধ্যে মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পবােধ, নৈতিকতা, আইন এবং বিভিন্ন রীতিনীতিগুলি বিকশিত হয়।”
[1] আদিম আফ্রিকার জনগােষ্ঠী: আদিম আফ্রিকায় একাধিক জনগােষ্ঠীর বসবাস ছিল। এরকম কয়েকটি জনগােষ্ঠীর নাম হল—নুবা, নগেনী, লিবিয়ান, বান্টু, সুদানিক, পিগৃমি, বুশম্যান, খইখই, সােথাে ও টসােঙ্গা প্রভৃতি। এই সমস্ত জনগােষ্ঠীগুলির আলাদা আলাদা সংস্কৃতি ছিল।
[2] সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
-
পেশাগত: আদিম আফ্রিকার বুশম্যান জনগােষ্ঠীর জীবিকা ছিল শিকার করা। আবার খইখই (হটেনটট) জনগােষ্ঠীর জীবিকাছিল পশুপালন, আবার সােথােজনগােষ্ঠীভুক্ত আদিম আফ্রিকাবাসী পশুপালনের পাশাপাশি কৃষিকেও জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। টসােঙ্গারা আবার সম্পূর্ণরূপে মৎস্য শিকারের ওপর নির্ভর করে জীবিকা চালাত।
-
ভাষাগত: আফ্রিকার আদিম জনগােষ্ঠীগুলির মধ্যে ভাষাগত বৈচিত্র্য ছিল। বুশম্যান জনগােষ্ঠীর অধিবাসীরা একাধিক আঞ্চলিক ভাষায় কথাবার্তা বলত। আবার খইখই জনগােষ্ঠীর ভাষার নাম ছিল হটেনটট। সােথাে জনগােষ্ঠীর লােকেরা নিজেদের সােথাে ভাষাতে মনের ভাব আদানপ্রদান করত।
-
আচার-অনুষ্ঠানগত: আদিম আফ্রিকার জনগোষ্ঠী আলাদা আলাদা আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলত। বুশম্যান জনগােষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ের সময় পরিবারের মধ্যে একাকী থাকতে হত। এ ছাড়াও বুশম্যান বালক বা বালিকারা যৌবন প্রাপ্ত হলে নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান আয়ােজিত হত। খইখই জনগােষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বর তার শ্বশুরকে কতকগুলি মেষ বা বৃষ উপহার দিত। সােথাে জনগােষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞাতি ও ভাই- বােনের মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল। টসােঙ্গা জনগােষ্ঠীর বিয়েতে কন্যা পক্ষকে গােরু দানের রেওয়াজ ছিল।
-
আদিম শিল্পকীর্তি: বুশম্যান জনগােষ্ঠীর মধ্যে কেউ কেউ পাথরের গায়ে, উটপাখির ডিমের খােলায় ছবি আঁকতে শিখেছিল। তাদের চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল নৃত্য ও পশুশিকার খইখই জনগােষ্ঠীর লােকেরা ভেঁদড়ের চামড়া দিয়ে পােশাক, নলখাগড়া দিয়ে মাদুর তৈরি করতে পারত। এ ছাড়াও খইখই অধিবাসীরা উটপাখির পালক লাঠিতে বেঁধে ছাতা বানাতে শিখেছিল। নগােনী জনগােষ্ঠীর লােকেরা নলখাগড়া দিয়ে ঘর বানাত। নগােনীরা বৃষের চামড়া দিয়ে মােটা কোট ও জুতাে তৈরি করতে পারত। নগােনী জনগােষ্ঠীর মেয়েরা মাটির পাত্র তৈরি করতে পারত। সােথাে জনগােষ্ঠীর লােকেরা চামড়া, কাঠ এবং হাতির দাঁত দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে জানত।
পৃথিবীর কোনাে একটি অঞ্চলে আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাব সভ্যতা গড়ে তােলায় বিশেষ ভূমিকা নেয়। মার্কিন ভূগােলবিদ এলসওয়ার্থ হান্টিংটন-এর ধারণায় বিশ্বের সমস্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির গঠনে প্রধান নিয়ামক শক্তি ছিল জলবায়ু।
[1] প্রাথমিক পর্যায়: প্রাচীন আফ্রিকায় প্লেইস্টোসিন যুগে হিমযুগ বা তুষার যুগ বিরাজমান ছিল। এই তুষার যুগে গড় বার্ষিক উন্নতা কমে উয়ুমণ্ডলের বৃহৎ অংশ বরফে ঢেকে যাওয়ায় সেখানে আর্দ্রতা বাড়ে। ফলে বৃষ্টিপাতও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। প্লেইস্টোসিন যুগের শেষার্ধে তুষার যুগের অবসান ঘটে। ফলে দক্ষিণ অঞ্চলে ধীরে ধীরে শুষ্ক জলবায়ু দেখা দেয় এবং মরুভূমির সৃষ্টি হয়।
[2] পরবর্তী পর্যায়: খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কাল আফ্রিকার ইতিহাসে প্রাগৈতিহাসিক যুগ। আর খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল আফ্রিকার ইতিহাসে প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগ নামে পরিচিত। এই প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগের আবহাওয়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়।
-
প্রাগৈতিহাসিক পর্বে আফ্রিকার জলবায়ু (খ্রিস্টপূর্ব ও হাজার অব্দ পর্যন্ত): প্লেইস্টোসিন যুগের শেষের দিকে অর্থাৎ উচ্চ পুরা পাথরের যুগে দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বদিকে বৃষ্টিজনিত চারটি শীতল পর্ব বিরাজমান ছিল। এই পর্বের সমাপ্তির পর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে হ্রদ ও নদীনালা শুকিয়ে যায়। মধ্য পাথরের যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮ হাজার অব্দ পর্যন্ত) আফ্রিকায় তীব্র শুফতার যুগ শুরু হয়। নতুন পাথরের যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৮ হাজার অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার অব্দ পর্যন্ত) আবহাওয়ার শুষ্কতা আরও বাড়ে। ফলে শুষ্ক সমতলভূমি ও মরুভূমির সৃষ্টি হয়।
-
আদি ঐতিহাসিক পর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত): এই পর্বে অতি শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে সাহারা মরুভূমি বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলে পরিণত হয়। এ সময়কালে দক্ষিণ আফ্রিকার আবহাওয়ায় বৈচিত্র্য আসে। শুষ্ক আবহাওয়া ধীরে ধীরে আর্দ্র হয়। বৃষ্টিপাতের তারতম্য দেখা দেয়। দক্ষিণ অক্ষাংশের ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু আবহাওয়ায় এই বৈচিত্র্য আনে।
Leave a comment