প্রশ্নঃ কে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আইনগতভাবে যোগ্য? সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা কিভাবে হরণ করা যায়? সাক্ষ্য আইনের জেরা সংক্রান্ত বিধানাবলি কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত? বাংলাদেশের একজন বিচারক কি অবিচার রোধকল্পে অনুসন্ধানী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে?
আদালতে সাক্ষ্য দিতে যোগ্য কেঃ আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি সাক্ষ্য আইনের ১১৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদানে যোগ্য, যদি আদালত মনে না করেন যে অল্প বয়স, অধিক বয়স, দৈহিক বা মানসিক ব্যাধি বা অনুরূপ কোন কারণে তাদেরকে জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বুঝতে বা সেই প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে তারা অক্ষম। এই ধারা অনুসারে (ক) অপরিণত বয়স, (খ) অত্যধিক বাধক, (গ) শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা কিংবা (ঘ) অন্য কোন কারণে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে অক্ষম বলে প্রতীয়মান হলে সে ব্যক্তি সাক্ষী হবার যোগ্য হবে না। এছাড়া অন্যান্য সকলেই সাক্ষী হতে পারে। এই ধারার ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে যে, কোন বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তি ও যদি জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন বুঝতে ও এর যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে সক্ষম হয়, তবে সেই ব্যক্তিও সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্য। ১১৯ ধারার বিধান মোতাবেক বোবা ব্যক্তিগণও ইশারার মাধ্যমে ও লেখার মাধ্যমে সাক্ষ্য দিতে পারেন। ১২০ ধারায় বলা হয়েছে যে, সকল দেওয়ানী মামলায় পক্ষগণ এবং কোন পক্ষের স্বামী বা স্ত্রী অবশ্যই যোগ্য সাক্ষী হতে পারেন। কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় সেই ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী অবশ্যই যোগ্য সাক্ষী হবেন।
সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা কিভাবে হরণ করা যায়ঃ একজন সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা যায় মূলত দুভাবে। প্রথমত ১৩৭ ও ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক তাকে জেরা করে দেখানো যায় যে, তিনি যা বলেছেন তা সত্য বা স্বাভাবিক নয় এবং যথার্থ ঘটনার সাথে তার বক্তব্য মিলছে না। জেরার মাধ্যমে এটাও দেখানো যায় যে, চরিত্র ও সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে তিনি অনেক নিম্ন স্তরের ব্যক্তি। দ্বিতীয় জেরার উপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ এনে ১৫৫ ধারার বিধান মতে বিরুদ্ধ পক্ষের সাক্ষীর বিশ্বস্ততাকে নষ্ট বা খর্ব করা যায়। ১৫৫ ধারা মতে নিম্নোক্ত উপায়ে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা যায়ঃ
(১) অন্যান্য সাক্ষীদের মতে ঐ সাক্ষী বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে হলে তাদের দ্বারা সে মর্মে সাক্ষ্য দেয়ায়ে।
(২) সাক্ষীকে ঘুষ দেয়া হয়েছে বা সাক্ষী ঘুষের প্রস্তাব সম্মত হয়েছে অথবা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য কোনরূপ অবৈধ প্রলোভন প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে, তা প্রমাণ করে।
(৩) তার প্রদত্ত সাক্ষ্যে যা প্রতিবাদসাপেক্ষ তা তার পূর্ববর্তী বিবৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণবিহীন তা প্রমাণ করে।
(৪) কোন ব্যক্তি যখন বলাৎকার অথবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা বা ভ্ৰষ্টা।
এই ধারার ব্যাখ্যা বলা হয়েছে যে, একজন সাক্ষী যদি অপর একজন সাক্ষীকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে উক্ত করে, তবে জবানবন্দীর সময় এর কারণ ব্যাখ্যা না-ও করতে পারেন। তবে জেরা করার সময় এরূপ বিশ্বাসের কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হতে পারে।
জেরা সংক্রান্ত বিধানাবলি কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত বিচারকার্য পরিচালনার জন্য বর্তমান বিশ্বে দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। এগুলি হচ্ছে— অনুসন্ধানী পদ্ধতি (Inquisitorial System) এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পদ্ধতি (Adversary বা Accusatorial System)। প্রথমটি মূলত: ফ্রান্সে এবং দ্বিতীয়টি ইংল্যান্ডে প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পদ্ধতির। এই পদ্ধতিতে পক্ষগণ নিজেরা আইনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং বিচার আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করে। এক পক্ষের সাক্ষীকে অপর পক্ষ যখন প্রশ্ন করে তখন তাকে ক জেরা বলে। জেরা করার উদ্দেশ্য মূলত: তিনটি প্রথমতঃ বিরুদ্ধ পক্ষের সাক্ষ্যকে ধ্বংস বা দুর্বল করা; দ্বিতীয়ত: বিরুদ্ধ পক্ষের সাক্ষীর নিকট হতে নিজ পক্ষের কিছু বক্তব্য আদায় করা এবং তৃতীয়ত: সাক্ষীকে বিশ্বাসের অযোগ্য প্রতিপন্ন করা। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৬৫ ধারায় বিচারককে সত্য উদ্ধারের জন্য সাক্ষীকে প্রশ্ন করার অধিকার দেয়া হয়েছে। সাক্ষীর জেরা-জবানবন্দী শেষ হলে আদালত সাক্ষীকে যে কোন প্রশ্ন করতে পারেন। সাক্ষী বিভ্রান্ত হতে থাকলে আইনজীবীকে থামায়ে আদালত প্রশ্ন করতে পারেন। তবে জেরা, জবানবন্দীর মাঝখানে সাক্ষীকে যদি বিচারক একাদিক্রমে প্রশ্ন করতে থাকেন তবে তা বিচারকের আচরণ বহির্ভূত আচরণ হবে, কেননা আদালতের কাজ এবং আইনজীবীর কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই বলা যায় যে, জেরা সম্বলিত বিধানাবলী সম্পূর্ণরূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নয় বা অনুসন্ধানীমূলক নয় বরং উভয় পদ্ধতির সংমিশ্রণ মাত্ৰ।
বাংলাদেশের একজন বিচারক অনুসন্ধানী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন কিনাঃ আইনজীবী তার মক্কেলের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাবেন, কিন্তু বিচারক উভয় পক্ষের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখেন। এ উদ্দেশ্যে প্রয়োজনবোধে বিচারক সাক্ষীকে প্রশ্ন করে সত্য উদঘাটনের চেষ্টা চালাতে পারেন। এ বৈশিষ্ট্যটি অনুসন্ধানী পদ্ধতির। তবে এই অনুসন্ধানীমূলক কার্যের সীমা রয়েছে। আইনজীবীর কাজে অযথা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। সাক্ষীগণ যে সাক্ষী দিয়েছে তাতে বিবেচ্য বিষয়ে কোন সংশয় দেখা দিলে বিচারক প্রশ্ন করে তা নিরসন করতে পারেন। ১৩ ডি. এল. আর ২৮৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে আদালতের অধিকার আছে সাক্ষীকে যে কোন প্রশ্ন করার। কিন্তু আদালত সকল সাবধানতার সহিত তাঁর এই ক্ষমতার ব্যবহার করবেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যেটুকু অনুসন্ধান প্রয়োজনীয় তার অতিরিক্ত অনুসন্ধান কোন বিচারক করতে পারেন না।
Leave a comment