সমুদ্র মন্থনে শুধু অমৃত ওঠেনি—উঠেছিল বিষ। এককালে পাশাপাশি সম্প্রীতির বাঁধনে ভাই-ভাই হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে ৪৬এর দাঙ্গায় উঠল সেই রক্তাক্ত সংশয় সন্দেহের হলাহল। আশ্চর্য সহমর্মিতায়ক ও বাস্তববোধ দুটি মানুষের মধ্যে দাঙ্গার ছবি ও সম্প্রীতির আলো জ্বালাল ‘আদাব’।
‘১৯৪৬-৪৭’-এর জীবনানন্দ দেখেছিলেন, সকলেই আড়চোখে একে অপরকে দেখে—তাই তাঁর মনে হয়েছিল—“সৃষ্টির আদি কথা মনে হয়—দ্বেষ”। ছিন্নমস্তা রাজনীতি সেদিন সাম্প্রদায়িক মাতলামি এনেছিল—হিন্দু-মুসলমান একে অপরকে দেখতে শুরু করল। শত্রুর আক্রমণের ভঙ্গিতে, সংশয়ের ইঙ্গিত। এমনই অবিশ্বাসের বাতাবরণে সাক্ষাৎহল হিন্দু সূতাকল শ্রমিকের সাথে মুসলমান মাঝির। প্রথমে ‘জাতি’ পরিচয় ফাঁস হয় মাঝির—দেশলাই জ্বালিয়ে বিড়ি খাবার কল্যাণে সে “সোহান আল্লা’ বলে ওঠে। অবিশ্বাসে ভয়ে সংশয়ে বিড়ি নিভিয়ে সে দপ্ করে যেন জ্বলে ওঠে—“হ আমি মোছলমান। কি হইছে ?” তার বগলের পুঁটলি নিয়েও ভয়—তবে তাতে অস্ত্র নেই, পরদিন ঈদে বউ-ছেলেকে দেবার জন্য কেনা শাড়ি জামা আছে ওতে। সূতামজুর ও ভগবানের দিব্যি দিয়ে জানায় সেও নিরস্ত্র। অবিশ্বাসের বাতাবরণ বিশ্বাস নিয়ে বসে দুই মানুষ। ওঠে দাঙ্গার কথা—লিগকে দায়ী করে গা ঝড়ে হিন্দু বন্ধু। মাঝি ঝাঁকিয়ে ওঠে—“হেই সব আমি বুঝি না। আমি জিগাই মারামারি কইবা হইব কি? তোমাগো দুগা লোগ মরব, আমাগো দু’গা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইল ?” দেশের কথা কি আর নেতাদের ভাবলে চলে, ভাবে মানুষ—ভুগেও মানুষ। না কি মানুষও নয় ? “মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি, নইলে এমুন কামড়া কামড়ীটা লাগে কেমবায় ?” তার চোখে ভাসে হিন্দু নায়েবের কৃপায় তার মাসের খোরাকি চলত, আর স্বপ্ন দেখে পরবে ছেলে মেয়ের সাথে আনন্দ উৎসব করার। সব স্বপ্ন শেষ হয় পুলিশের গুলিতে-হাহাকার করে ওঠে মাঝি—“পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিন। দুশমনরা আমাকে যাইতে দিল। না তাগো কাছে।” করুণম মর্মস্পর্শী। দাঙ্গায় স্বপ্নের সমাধি, জীবনের অকালমৃত্যু সেই নেতাদের পাপের বোঝা বাড়িয়ে তাদের নরকে টেনে আনে।
মাঝির কথিত সেই “কুত্তারা” তাড়িয়ে মারল একটি মানুষকে—’আদাব’ জানানো মানুষটি যেন জ্বলে তাদের বিরুদ্ধে—যেমন কবি পাউল সেলান গর্জে উঠেছিলেন নেতারা বিপক্ষে—’He hunts us down with his dogs in the sky / he gives us a grave [Figure of Death] তাই “he” (নেতা) ও তার dogs (পুলিশ) জীবন নাশ করে। মাঝি বাঁচতে চায়—বাঁচতে চায়—’মেঘে ঢাকা তারা’র নীরার মতো—“আমি বাঁচতে চেয়েছিলুম।”
Leave a comment