বীরাঙ্গনা কাব্যে গৃহীত হয়েছে মোট এগারোটি পত্র নিয়ে। প্রত্যেকটা পত্রেই পৃথক এবং বিভিন্ন পৌরাণিক নায়িকা প্রতি পত্রে ভিন্নতর রূপে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। অর্থাৎ বলা যেতে পারে পুরাণের ধূসর জগৎ থেকে কিছু স্মরণীয় নারী চরিত্রকে পরিবর্তন, পরিমার্জন ঘটিয়ে অর্থাৎ Revaluation of post করে মধুসূদন নতুন করে আবিষ্কার করেছেন ৷ এগারোটি পৃথক পত্র নিয়ে যে কাব্যে তিনি রচনা করেছেন তার বিশেষ কোনো ধারাবাহিকতা না থাকলেও এগারোটি পৃথক অধ্যায়কে তিনি একই রাতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে এগারোটি সর্গে বিভক্ত করেছেন। দ্বিতীয় সর্গে আমরা পাই সোমের প্রতি তারার পত্র, যেটি একটি আদর্শ প্রেমপত্রের নিদর্শন।
সোমদেব ছিলেন শিষ্য এবং তারাদেবী তাঁর গুরুপত্নী, সুতরাং তাদের মধ্যে যে প্রেম সঞ্চার হয়েছিল তা একদিকে যেমন দুঃসাহসীয় অন্যদিকে তেমনি নিভৃত ও অস্ফুট। দুঃসাহসিক এই কারণেই সে সময়ে বিবাহিতা নারীর পর পুরাতনের প্রতি আকর্ষণকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হত। সেই সময় সন্তান প্রতীম স্বামী শিষ্যের প্রতি প্রেম সামাজিক দৃষ্টিতে এক অবিশ্বাস্য ও জঘন্যতম অন্যায়। কিন্তু মানুষের হৃদয় সমাজের নির্দেশিত কোনো বিধি নিষেধের মধ্যে বন্ধ নয়। এটাই মানবিক সত্য এবং এই সত্যানুসারেই দুটি হৃদয় অথবা সম্ভব একটি হৃদয় নিজের দুঃশাসন চিত্তের নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে অন্য হৃদয় সান্নিধ্য চেয়েছে। যখন এসেছে হয়তো তা স্বপ্নের মতোই নিঃশব্দ চরণে অস্ফুট ও কোমলতার সঙ্গে এসেছে। অতিমাত্রায় এবং তা স্বীকার না করে তারা দেবীর উপায় নেই।
তাহার এই প্রেম যেহেতু অতি ধীরে এবং নিরুচ্চারে ঘটেছিল অতএব প্রথমেই তা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু যে অনুভূতি তার মনে সঞ্চারিত হয়েছে তার সে নির্ভুল প্রেম সেকথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সোমদেব আসার পর তারার হৃদয়ে বৈপ্লবীক পরিবর্তনের চিত্রটি তুলে ধরা যেতে পারে। যেদিন প্রথম সোমদেব দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রমে পদার্পণ করেন সেদিন থেকেই তারাদেবীর হৃদয়ে এক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। এতদিন নিজের রূপ এবং যৌবন সম্বন্ধে বিশেষ কোনো সচেতনতা তার ছিল না। কিন্তু সোমদেব আসার পরেই এ বিষয়ে তিনি অতি সতর্ক হয়ে উঠেছেন। কেন মনের এই পরিবর্তন প্রথমে তা বুঝতে পারেননি তিনি, কিন্তু পরে তাঁর একথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি,—
“পাইলে মধুর,
সোহাগে বিবিধ সাজে সাদেবনরাজী!
তাহার যৌবন বন ঋতুরাজ তুমি!”
একথা বোঝার পর তারা হয়ে উঠেছেন উদভ্রান্ত প্রেমিকা। সোমদেবের বিদ্যাচর্চার সময় তিনি গৃহের কাজ ভুলে যেতেন, তার মধুমাখা কণ্ঠস্বর তিনি শুনতেন বিমুগ্ধ হৃদয়ে। তার হৃদয়ে নেচে উঠত সোমদেবের ঘন আস্ফালন। রোদ্দুরে গাভী বেড়াতে গেলে তারাদেবীর পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা অসম্ভব হয়ে উঠত। বাইরের ঘটনা লোকে দেখে তাই সেখানে অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হয় কিন্তু কল্পনার জগত বাইরের লোকের চোখে পড়ে না তাই সেখানে কোনো বাধাও নেই। সোমদেব গুরুর সঙ্গে যখন গুরুপত্নীকে প্রমাণ করতেন তারাদেবী নিজেকে মনে করতেন নায়িকা এবং সোমদেবের স্পর্শে রোমান্টিক হতেন তিনি।
“মুদি আঁখি, ভাবিতাম মন
মালিনী যুবতী আমি, তুমি প্রাণপতি,
মনে ভঙ্গ আসে নত দাসীর চরণে।”
সোমদেবের অক্ষেল সর্বক্ষণ এই গোপন চারিণী ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করতেন। প্রতিটি আচরণ অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। আশ্রমের ছাত্রদের খাদ্যতালিকা খুব আহার্যনীয় ছিল না তাই গুরুদেবের ভোজন হলে তার প্রসাদ অন্ন খাবার আগে সোমদেব যখন গুরুদেবের হাতে জল দিতেন তখন তার পাতে যাবতীয় ব্যঞ্জনাদি রেখে আসতেন। শয্যার পাশে মুখসুদ্ধি হিসাবে সোমদের পাওয়ার কথা হরিতকি কিন্তু তারাদেবী রাখতেন তাম্বুল গোপনে। কুশাসনের তলে পুষ্পবিছিয়ে রাখতেন তিনি। বরাঙ্গে বিদ্ধ হবে মনে করে তিনি একাজ করতেন এবং এই ফুলসজ্জার রচনাকালে খুব কাল্পনিক সুখ উপভোগ করতেন।
তারাদেবীর এই গোপন পরিচর্যা এবং নিঃশব্দে সোমদেবের শ্রমলাঘবের এখানেই শেষ নয়। পাছে পুষ্পচরণে সোমদেবের কষ্ট হয় এইজন্য তিনি কাননে আসার আগে তারাদেবী ফুল তুলে রাখতেন। সোমদেব একথা বুঝতে পারতেন না ভাবতেন বনদেবী তার কষ্ট লাঘবের জন্য ফুল ছড়িয়ে রেখেছেন। সেসব সোমদেবের হাতে পড়বে তাদের সঙ্গে কত কথা হত তারাদেবীর। তিনি শুনেছেন মৃগশিশু অঙ্গে বারণ করেন সোম সেকথা শুনে নিজের মৃগশিশু কোলে নিয়ে কতদিন বিরলে অশ্রুবিসর্জন করেছেন তিনি।
তারাদেবী মৃদু অথচ অব্যর্থ প্রেমের নিঃসংশয় প্রমাণ তার ঈর্ষার মধ্যে লুকিয়ে আছে আকাশের তারা প্রতিভার ঈর্ষা, কারণ সোমদেব তারাকান্ত। মেঘকে আহ্বান জানিয়ে বলতেন যেন রোহিণীর স্বর্ণকান্তি চিরতরে ঢেকে দেয়। রোহিণীকে তার মনে হত স্বপত্নী, কেবল রোহিণীকেই নয় পদ্মফুলকে দেখেও প্রচণ্ড ঈর্ষা হত তার। কারণ আর কিছুই না—পদ্ম চন্দ্রের প্রেমিকা, সরোবরের চণ্ডালকে উচ্ছসিত পদ্ম দেখলে রাগ করে ছিঁড়ে ফেলতেন তারা এবং নিজের রূপ যৌবনের সঙ্গে তার তুলনা করতেন। এই ঈর্ষার জ্বালাও অভ্রান্তভাবে লক্ষ্য প্রমাণ করে তারা প্রণয় যা দীর্ঘকাল সদগোপনে রেখে শেষ পর্যন্ত এক অব্যক্ত, ভীষণ মধুর যন্ত্রণা তিনি পত্রে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই প্রশ্নের অনুকরণে লেখা যায়—
(১) নারী হৃদয়ের বিচিত্র জটিল কামনা বাসনাকে কবি মধুসূদনের তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন—সোমের প্রতি তার পত্রিকা অবলম্বনে আলোচনা করো। অথবা (২) তারার দ্বন্দ্বজর্জর জীবনের ট্র্যাজেডিই তাকে আধুনিকা নারী করে তুলেছে— আলোচনা করো। অথবা (৩) সোমের প্রতি তার পত্রিকাটি একটি রোমান্টিক প্রেমের আলেখ্য—আলোচনা করো। অথবা (৪) ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকার বিষয়বস্তু। অথবা (৫) সমাজধর্ম ও হূদয় ধর্মের স্বপ্ন তারার পত্রিকায় কীভাবে প্রকাশিত আলোচনা করো। অথবা (৬) ‘পুরাণের তারার নবজন্ম ঘটেছে মধুসূদনের হাতে। সোমের প্রতি তারা পত্রিকা অবলম্বনে আলোচনা করো।
Leave a comment